‘জনগণ অধিনায়ক’
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিতর্পণ
প্রকাশিত : ১৫:৪২, ৬ আগস্ট ২০১৯ | আপডেট: ১৬:০৩, ৬ আগস্ট ২০১৯
আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে এই মহামানবের পবিত্র স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের সুযোগ পেয়ে নিজেকে গর্বিত বোধ করছি।
বিশেষভাবে ষাটের দশকে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ তথা স্বাধিকারের সংগ্রাম ও শোষণমুক্তির আকাঙ্ক্ষায় যে বিশাল যুবশক্তির উত্থান ও জাগরণ ঘটে তার প্রধান পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছেন সকলের প্রিয় মুজিব ভাই। বিপ্লবী ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, সুভাষ বসু প্রমুখদের জীবন সংগ্রাম থেকে ওই সময়কালে যুবসমাজ যে উদ্দীপনা পেয়েছিলেন, বিপ্লবীদের যথার্থ উত্তরসূরি মুজিব ভাইয়ের তেজোদীপ্ত সংগ্রামী কর্মকাণ্ডে তাদের প্রতিচ্ছায়া দেখেছেন। দলীয় নেতার সীমানার ঊর্ধ্বে উঠে, দলীয় রাজনীতির সীমা সরহদ্দ ছাপিয়ে তিনি ক্রমে ক্রমে সমগ্র জাতির আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।
গণতন্ত্র, বাঙালিত্ব, ধর্মনিরপেক্ষ শোষণহীন সমাজের জন্য আন্দোলনরত দল-মত নির্বিশেষে কর্মী বাহিনীর কাছে তিনি প্রকৃত জাতীয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তার অনন্য সাহস, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা, দুঃসহ দুঃখ-কষ্ট ও কারাযন্ত্রণা ভোগ ও ত্যাগের নজির হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে জনমনে মুজিব ভাই হিমালয়ের উচ্চতা অর্জন করেন। অন্যদল এমনকি ভিন্নমতের নেতাকর্মীদের সাথে তার আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক তাকে একান্নবর্তী রাজনৈতিক পরিবারের অভিভাবকত্বে ভূষিত করেছিল। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ যে কোন কর্মী মুজিব ভাইয়ের কাছে পেতেন সস্নেহ প্রীতিপূর্ণ উদ্দীপনা।
কয়েকটি স্মৃতিচারণের বিষয় তুলে ধরে এই মহামানবের প্রতি স্মৃতিতর্পণ নিবেদন করতে চাই।
১৯৬৩ সাল। ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন এবং ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য পরামর্শ এবং আর্থিক সহায়তার জন্য একাধিকবার মুজিব ভাইয়ের কাছে হাজির হয়েছি। মুজিব ভাইয়ের পুরাতন ৩২নং বাসভবনে রেজা আলী, মানিক ভাই, মর্তুজা খানসহ আমি বেশ কয়েকবার গেছি, গেছি তার গুলিস্তানের আলফা ইন্স্যুরেন্সের অফিসেও। মুজিব ভাই নিজ দলের ছোটখাটো তহবিল থেকে যখনই গেছি ১ হাজার কখনও ২ হাজার টাকা চাঁদা দিয়েছেন, বাড়তি প্রয়োজনে মানিক মিয়া এবং মিজানুর রহমান চৌধুরীর কাছে আমাদের পাঠিয়েছেন। ৩২নং রোডের বাড়িতে যাওয়া-আসার সুবাদে দেখেছি মফস্বলের গরিব কর্মীদের তিনি ১০০ এবং ২০০ টাকার পুরিয়া পকেটে গুঁজে দিয়ে মায়ামমতার সাথে তাদের বিদায় দিতেন। আজকের দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির দাপটের মধ্যে এই নজিরটা কল্পকাহিনীর মতোই শোনাবে।
ছাত্র আন্দোলনের স্বর্ণযুগের সেই দিনগুলোতে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা, সময়ে সময়ে বৈরিতাও ঘটেছে। কিন্তু জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলনের বিষয়টি গৌন ও উপেক্ষিত থাকেনি। মুজিব ভাইয়ের দূরদর্শী রাজনৈতিক উদ্যোগের কারণে এ ঘটনা ঘটেনি। শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা ১১ দফা আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান রচনায় মুজিব ভাই ছিলেন নেপথ্য নায়ক। এই কাজে মণি সিংহ, খোকা রায়, কমরেড ফরহাদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, পীর হাবিবুর রহমান, মানিক মিয়া, শহীদুল্লাহ কায়সার, মিজানুর রহমান চৌধুরী, তাজউদ্দীন আহমেদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম পালন করেছেন ইতিবাচক ভূমিকা।
১৯৬৪ সালের ১৪ জানুয়ারি। পাকিস্তানের স্বৈরাচারী প্রতিক্রিয়াশীল সরকার ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, সাভার, খুলনা প্রভৃতি অঞ্চলে শুরু করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। দিনকয়েক পূর্বে কাশ্মীরের হযরতবাল মসজিদ থেকে পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদের পবিত্র চুল চুরি হওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে পূর্ববঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। সেই সময়ে অন্যান্য স্থানের মতো জগন্নাথ হলে দূর্গত নর-নারী-শিশুর জন্য খোলা হয় আশ্রয় শিবির। সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার ভবনটিসহ বিভিন্ন কক্ষ খালি করে উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেয়া হয়। ক্যাম্পের সংগঠন হিসেবে আমি সেদিন পত্রবাহক আখলাখুর রহমানের মাধ্যমে মুজিব ভাই ও মহীউদ্দীন ভাইয়ের কাছে চাল, ডাল, হ্যাজাক এবং অর্থ প্রার্থনা করি। ৬ ঘণ্টার মধ্যে মুজিব ভাই পাঠান পাঁচ বস্তা চাল, দু’বস্তা ডাল, দুটি হ্যাজাক এবং ২ হাজার টাকা। মহীউদ্দীন ভাই অনুরূপ চাল, ডাল, নগদ অর্থ পাঠান পরের দিন।
১৫ জানুয়ারি ১৯৬৪। দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদসহ প্রধান পত্রিকায় পাঁচ কলামব্যাপী প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনাম প্রকাশিত হয় ‘পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও’। এক অভিন্ন সম্পাদকীয় কলাম প্রকাশের মাধ্যমে শুরু হয় দাঙ্গা প্রতিরোধের আন্দোলন। সকাল ১০টায় ৩৩ তোপখানা রোড থেকে শুরু করে বিশাল শান্তি মিছিল। নেতৃত্বদান করেন শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান খান, মহীউদ্দিন আহমেদ, পীর হাবিবুর রহমান, কবি সুফিয়া কামাল, শিল্পী কামরুল হাসান, শহীদুল্লাহ কায়সারসহ অনেকে। মিছিল শেষে নওয়াবপুর রেলগেটের কাছে হাক্কাগুণ্ডা নাগরিক আন্দোলনের নেতা আমির হোসেন চৌধুরীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। এছাড়া মহীউদ্দীন ভাই ছুরিসহ এক গুণ্ডাকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে মুজিব ছিলেন জীবন্ত প্রেরণা।
১৭ অক্টোবর ১৯৬৭ সাল। আমাকে গ্রেফতার করা হয় রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগে, দায়ের করা হয় আমার বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলা ষড়যন্ত্র মামলা। চার দিন ধরে একটানা গ্রীন রোডের হোয়াইট হাউস গোয়েন্দা দফতরে আমার ওপর চলে জিজ্ঞাসাবাদ। অতঃপর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের হাসপাতালে আমাকে পাঠানো হয়; দেখি আমাকে স্বাগত জানাতে মুজিব ভাই অপেক্ষারত। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের বিস্তারিত বিষয় জানালাম, এক্ষেত্রে সিংহভাগ অভিযোগ মুজিব ভাইয়ের বিরুদ্ধে। মানিক চৌধুরী, বিধান কৃষ্ণ সেন, ডা. জাফর, হান্নান প্রমুখদের সাথে বঙ্গবন্ধুর কল্পিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং সেনা ও আমলাদের সাথে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন জায়গায়। সব কিছু মুজিব ভাইকে অবহিত করে একটি ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হবে তার বিরুদ্ধে এই সংবাদ তাকে জানাই। পরবর্তীতে ১৯ জানুয়ারি ১৯৬৮ সালে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’য় মুজিব ভাইকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে স্থানান্তর করা হয়।
ওই মামলা শুরুর পূর্বে কারাগারে কথা প্রসঙ্গে মুজিব ভাইকে একটি বইয়ের কথা বলেছিলাম। বইটির নাম ‘এন এথনিক্যাল স্ট্যাডি- হিস্ট্রি অব পাকিস্তান’, লেখক অধ্যাপক গনকোভস্টা। পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতিসমূহের বিশেষত: বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিষয়টি বহু রক্তাক্ত সশস্ত্র সংগ্রামে নিষ্পন্ন হবে- এইরূপ মতামত বইটিতে ব্যক্ত হয়। কবি জসীমউদ্দীন রাশিয়া থেকে বইটি এনেছিলেন। কবিপুত্র জামাল আনোয়ার বাসুর সুবাদে বইটি আমি পড়ি। মুজিব ভাই বইটির মর্মবস্তু জেনে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কিংবা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি কেউ সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত নয়, হবেও না। তিনি এ ধারণা পোষণ করেন যে, প্রচণ্ড জনমত সৃষ্টি করে গণচাপ প্রয়োগ করে শাসকচক্র এবং তাদের মুরব্বীদের ৬-দফা মেনে নিতে বাধ্য করা হবে।’
পরদিনও অন্যান্য কথার সাথে ওই বইটির কথা পুনারায় ওঠে। মুজিব ভাই বললেন, ‘গত রাতে ভাই বিষয়টি নিয়ে আমি খুব ভেবেছি, যদি সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হয় আমি হিসাব করে দেখেছি প্রাণ দিতে প্রস্তুত এ রকম সারাদেশে ২৭ জন কর্মী পাব, বাকি উকিল, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, চাকরিজীবীরা তো এই কঠিন কাজে আসবে না। তিনি ওই ২৭ জনের মধ্যে মূলত ছাত্রনেতাদের নাম এবং তার একান্ত ঘনিষ্ঠ কিছু সার্বক্ষণিক কর্মীর কথা বলেন যারা প্রাণদানে কুণ্ঠিত হবে না। তাদের মধ্যে সন্দ্বীপের আবদুর রহমান বয়াতির নামও বলেন যিনি প্রায় সকল জনসভায় বক্তৃতার আগে লোকগান গাইতেন। যাক, কিছুদিনের মধ্যে আমি জামিনে মুক্ত হয়ে কারাগার থেকে বাইরে আসি। মুজিব ভাই আমাকে বিদায় জানিয়ে বলেন, ‘মামাকে (শহীদুল্লাহ কায়সার) দিয়ে ওই বইটা পাঠিয়ে দিস।’ আমি তাকে কথা দিয়েও এ কথা রাখতে পারি নাই। আন্দোলন-সংগ্রামে ঢেউয়ের তাড়ায় ভুলে যাই বইটির কথা।
১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি স্বদেশে বীরবেশে ফিরলেন বঙ্গবন্ধু। ১২ জানুয়ারি তাকে শুভেচ্ছা জানাতে গেলাম। তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে কোলাকুলি করলেন। কথার ফাঁকে বললেন, ‘কিরে বইটির কথামতো দেশ তো স্বাধীন করলাম, কিন্তু বইটা তো পাঠালি না’ বলে হো হো করে হাসলেন। আমাকে লজ্জা দিলেন। মুজিব ভাইয়ের ঈর্ষণীয় স্মরণশক্তির কথা প্রবাদতুল্য। শত শত কর্মীর নাম ১০-২০ বছর পরে তার মনে গাঁথা হয়ে থাকত। তার স্মরণশক্তি ছিল এতই প্রখর।
১৯৭৩ সালের শেষ দিকে মুজিব ভাইয়ের সাথে দেখা করি। রাষ্ট্রায়াত্ত জুট মিলের সাবেক মালিকদের তখন প্রশাসক বানিয়ে তাদের স্ব স্ব জুট মিল চালাবার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ওই মালিকদের ১৮ জন স্থির করেন পূর্বের তারিখ দেয়া চেকের মাধ্যমে তাদের পরিচালনাকৃত জুট মিল থেকে সমুদয় অর্থ তুলে নেয়া হবে। বিষয়টি সম্পর্কে ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা আমাদের জরুরি পদক্ষেপ কামনা করেন। মুজিব ভাই বিষয়টা জেনে তাৎক্ষণিকভাবে চট্টগ্রামের এই সকল জুট মিলের হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দেন।
এই সময়ে গড়ে ওঠে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট (গজ)। আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং কমিউনিস্ট পার্টির সমন্বয়ে। কয়েক মাসের কাজকর্মের মধ্যে মুজিব ভাইয়ের সাথে বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে- তার কথা শুনে মনে হয়েছে গভীর সঙ্কটের মধ্য দিয়ে দেশ চলছে। চরমপন্থিদের উত্থান, মুসলিম বাংলার নামে কার্যকলাপ বৃদ্ধি, পাটগুদামসহ বিভিন্ন নাশকতার ঘটনা, শ্রমিক নেতাকে প্রকাশ্য দিবালোকে তার বাড়িতে হত্যা করা প্রভৃতি ঘটনাবলি তখন ঘটে চলেছে। সরকারি দলের এমপি ও নেতৃত্বের একাংশ দুর্নীতিতে লিপ্ত এ কারণেও জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে।
যেসব কারণে এবং পরিস্থিতি মোকাবেলার স্বার্থে এবং জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় উদ্যোগ সৃষ্টির জন্য বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) গঠনের পথে তিনি অগ্রসর হন। রাষ্ট্রপতি পদ্ধতিতে ফিরে যেতে তিনি চিন্তা করছেন, এককথায় তেজোদীপ্ত ‘উন্নত শির’ মানুষটি তখন চিন্তাক্লিষ্ট বহুমুখী সঙ্কট উত্তরণে উদগ্রীব। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ যে অনেকটা পরিকল্পিত এবং মানবসৃষ্ট তথা মার্কিন সৃষ্ট তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে; এই সময়ে চিলিতে আলেন্দেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হত্যা করে সামরিকতন্ত্র চাপিয়ে দেয় সে দেশে। এমনকি সৌদি বাদশা তেলশিল্পের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে চাইলে মার্কিন চক্রান্তে বাদশাহের ভাতিজার হাতে তার নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।
দেশি-বিদেশি বহুমুখী চক্রান্ত ও সঙ্কট উত্তরণে তখন মুজিব ভাই উদগ্রীব অথচ উৎকণ্ঠিত।
বঙ্গবন্ধুর সাথে সর্বশেষ সাক্ষাতের সুযোগ পাই ১২ জুলাই ১৯৭৫ সালে। বাংলাদেশে বুলগেরিয়ার রাষ্ট্রদূত বয়েজিদ, যার বয়স ৮৬ এবং যিনি হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নির্যাতিত হয়েছিলেন। তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে একটা গুরুতর সংবাদ জানালেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যে সেনাবাহিনীর মধ্যস্তরের অফিসারদের একাংশ একটা রক্তাক্ত অভ্যুত্থান ঘটাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ বিষয়ে মুজিব ভাইকে অবহিত করতে ছুটে যাই। প্রথমে খবরটা শুনে তিনি বলেন, ‘আমার বুকে অস্ত্র তাঁক করতে ওদের হাত কাঁপবে না।’ কথা প্রসঙ্গে তিনি মেজর ডালিম, রশিদ ও ফারুকদের বিষয়টি তুলে ধরেন। ওরা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে বলেই সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত, ওরা পুনরায় সেনাবাহিনীতে চাকরি ফিরে পেতে চায়, যা সেনানিয়মে সম্ভব নয়। তাই তাদের বলেছি ব্যাংকের লোন নিয়ে ব্যবসা কর, ওরা তো এখন লোন পেয়ে ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর দৌড়ঝাঁপ করছে।
আমি মুজিব ভাইয়ের মুখে তার ভাবী-হত্যাকারীদের নাম এইভাবে শুনি। মুজিব ভাই এ কথাও বলেন, ‘আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না, আমাকে ক্ষমতা থেকে হটাতে চাইলে আমি নিজেই ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে চাদরটা কাঁধে দিয়ে বাউলী মেরে আমার প্রিয় জনতার মধ্যে চলে যাব, আবার মানুষকে নিয়ে লড়াই-সংগ্রাম গড়ে তুলব। আমি তোদের জন্য ভাবি, মণিদা, মুজাফফর, পীর হাবিবদের সাবধান থাকতে বলিস।’
তারপর তিনি আমাকে আশ্বস্ত করার জন্য বলেন, ‘আমি একটা ব্যবস্থা নিচ্ছি, প্রতিষেধক ব্যবস্থাটি এসে যাবে এক মাসের মধ্যে। অমুককে পাঠিয়েছি। এই কথার মাঝখানে ঢুকলেন অতি সন্তর্পণে ফাইল হাতে এক ব্যক্তি। আমি মুজিব ভাইয়ের হাঁটুতে চাপ দিয়ে ইঙ্গিত করলাম, কিন্তু হিতে বিপরীত হলো।’ তিনি বললেন, ‘আরে ও তো আমার সচিব আবদুর রহিম ও আমার বিশ্বস্ত লোক।’ তিনি প্রতিষেধক আনার বিষয়টি পুনরায় উল্লেখ করলেন। সহাস্যে দাঁড়িয়ে থাকলেন পাকিস্তানের সাবেক পুলিশকর্তা আবদুর রহিম, যিনি আমার মতো অনেক আন্দোলনের কর্মীদের কড়া জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন।
মহা উদার মুজিব ভাইয়ের কথাগুলো আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। এক মাস। প্রতিষেধক আসবে। মনে হতে থাকে এক মাসের মধ্যে মহৎ প্রাণ মুজিব ভাইকে আমরা হারাব। এই মর্মে অধ্যাপক মোজাফফর, মণি সিংহ ও কমরেড ফরহাদকে বিষয়টি অবহিত করি অতিদ্রুত। কিন্তু আরও অলুক্ষণে ঘটনা অপেক্ষা করেছিল সেই দিন, যখন মুজিব ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরব তখনই দেখি মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দোরগোড়ায়। মুজিব ভাই বললেন, ‘আমাদের রি-অ্যাকশনারি নেতা এসেছেন।’ ক্রুর হাসি হেসে মোশতাক আহমেদ জবাব দিলেন, ‘নেতা আপনার জীবদ্দশায় আমি আপনার বিরোধিতা করব না।’ খুনি মোশতাক তার কথা রেখেছিল।
১৯৭৫-এর পনের আগস্টের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পরে মোশতাক বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেননি। বাংলার ইতিহাসে এইভাবে মোশতাক মীরজাফরের সমার্থক হয়ে উঠলেন।
আর আমাদের প্রিয় মুজিব ভাই শহীদি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী, মৃত্যুহীন চির অম্লান ও ভাস্বর হয়ে উঠছেন প্রতিদিন।
(লেখাটি ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু গ্রন্থ থেকে নেয়া)
এএইচ/
আরও পড়ুন