জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু
প্রকাশিত : ০৯:১৬, ১০ আগস্ট ২০১৯
নয়ন সম্মুখে তুমি নাই,
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই
১৯২৯ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে একবছর পড়ি। তার আগে ১৯২৭-এ ফাঁসিতে শহীদ রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সান্নিধ্যে এসে বিপ্লব মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী দলে ঢুকেছি। সখারাম গণেশ দিউস্করের ‘দেশের কথা’ এবং শরৎ চন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ এ দুটি বাজেয়াপ্ত করা বই পড়ি। ক্লাসে অধ্যাপক ... একদিন ... এর ... নামক একটি কবিতা পড়াচ্ছিলেন। মন দিয়ে শুনছিলাম। শেষের চারটি লাইন ভুলতে পারিনি।
... ... ...
... ... ... কথাটির ওপর জোর দিচ্ছিলেন। আমার চোখ খুলল- মৃত্যুরও মৃত্যু হবে, মানুষ মৃত্যুকে জয় করতে পারেন। তারা মৃত্যুঞ্জয়ী হতে পারেন। মৃত্যুঞ্জয়ী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী, প্লেটো, এরিস্টটল, রুশো, ভলতেয়ার, পাবলো পিকাসো ও আরও অনেকে মৃত্যুকে জয় করেছেন। কবির ভাষায়, ‘সেই ধন্য নরকুলে, লোকে যারে নাহি ভুলে, মনের মন্দিরে নিত্য সেবে সর্বজন।’
জাতির পিতার মৃত্যু নেই। তিনি অমর। আমাদের স্মৃতিপটে তিনি অম্লান। আমাদের প্রতিনিয়ত দেশপ্রেম ও মানুষের সেবায় উৎসাহিত করেছেন, অনুপ্রাণিত করেছেন। তাকে ভুলে নাই, ভুলতে পারব না। স্বামী বিবেকানন্দের কোন এক লেখায় পড়েছি- যে জাতি তাদের মাতৃজাতিকে শ্রদ্ধা করে না, সম্মান জানাতে শেখেনি সে জাতি বড় হতে পারে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বর্বর পাকবাহিনী আমাদের দুই লক্ষ নারীকে লাঞ্ছিত করেছে, সম্ভ্রম নষ্ট করেছে এবং পরিণামে ৯০ হাজার সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু সেই নারীদের সম্মানিত করে পরম মমতায় আখ্যায়িত করেছেন ‘বীরাঙ্গনা’ নামে। এ থেকে জাতির জনকের অন্তর বৈভবের পরিচয় পাই। আমাদের মা-বোনদের সম্মান দিতে হবে। আমরা পৌরাণিক মহাকাব্য থেকে জেনেছি নারীর অবমাননা কতখানি সর্বনাশ বয়ে আনে। বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যৎবাণী বাংলাদেশ সোনারবাংলা হবে। তিনি সারাজীবন যুদ্ধ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের আগে করেছেন, পরে করেছেন। তার জীবন নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামেরই ইতিহাস। বাংলার মানুষকে ভালোবেসেছেন তাই ক্ষমাও করেছেন তার বিপক্ষীয়দের অন্তরের ঔদার্য দিয়ে।
বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে। অন্তরঙ্গভাবেই কথা বলেছি। দীর্ঘ সুঠাম বলিষ্ঠ তেজোদীপ্ত দেহসৌষ্ঠবের অধিকারী! প্রাণখোলা হাসি তো ভুলবার নয়। আমাদের ধর্মগ্রন্থ গীতায় আছে যিনি সুখে-দুঃখে অবিচলিত, যিনি ভয় ও ক্রোধশূন্য তিনিই স্থিতধী প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। জাতির পিতাকে আমি স্থিতধী প্রাজ্ঞ বলে মনে করি। ১৯৭২ সালের একটা সাক্ষাৎকারের কথা বলে আমার ছোট লেখা শেষ করব।
প্রথমে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। সঙ্গে ছিলেন মন্ত্রী শ্রীযুক্ত ফণী মজুমদার, আমাদের চট্টগ্রাম শারদীয় পূজা কমিটির সম্পাদক শ্রী পরিমল সাহা, আমার বন্ধু আর.এন দত্তগুপ্ত এবং আরও দু’তিনজন। দূর্গাপূজার সময় বিভিন্ন জেলায় প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে। এ বিষয়ে কিছু কথা বলেছিলাম। কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধু জুলিও কুরি পুরস্কার পেয়েছেন। আমি একটি ফুলের স্তবক নিয়ে গিয়েছিলাম। ফুল দিয়ে করজোড়ে তাকে প্রণাম জানালে তিনি বললেন, দাদা, আপনি কেন এসেছেন? আপনার কি চাই বলুন। আমি হেসে হেসে বলেছিলাম, আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি কোন লাইসেন্স পারমিটের জন্য আসিনি।
আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আপনাকে সাবধান করতে এসেছি। এখনও চট্টগ্রাম রাতের আঁধারে রাজাকার-আলবদর বাহিনী ট্রাকে করে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিচ্ছে। তাদের কঠোর হাতে দমন করা না হলে ভবিষ্যতে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে।
স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন ১ কোটি মানুষ পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নেয় এবং নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। আনুমানিক ২ কোটি লোক দেশে থেকেই পাকিস্তানিদের বিরোধিতা করেছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছে। কিছু লোক নিষ্ক্রিয় ও উদাসীন ছিল। আর বাদবাকিরা পাকিস্তানপন্থী তারা রাজাকার আল-বদর বাহিনীর সঙ্গে জড়িত। তাদের সম্পর্কে সজাগ থাকা আমাদের উচিত নয় কি? এ কথাটি আপনার কাছে নিবেদন করতে এসেছি। আর একটি প্রার্থনা আপনার কাছে আমাকে দেশের সেবা করার সুযোগ দেবেন।
বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ একটি মহাকাব্য। এ মহাকাব্যের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ মহাকাব্যের সূচনা বাঙালির জাতীয়তাবোধের উন্মেষকাল থেকেই। বাহান্নার ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬-র ৬-দফা আন্দোলন, ’৬০-এর গণ-আন্দোলন এবং তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলন। প্রতিটি আন্দোলনেরই অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস কিছু বাঙালি বিশ্বাসঘাতকদের হাতে সপরিবারে নিহত হলেন বঙ্গবন্ধু।
বিশাল এক নক্ষত্রের বিচ্যুতি ঘটল। বাঙালির ভাগ্যাকাশে মেঘ ঘনীভূত হতে লাগল। কিন্তু আমাদের শাস্ত্রে আছে ‘ন হন্যতে, হন্যমানে শরীরে।’ স্থূল শরীরের মৃত্যু হলেও তার আদর্শের তো মৃত্যু নাই। আমি আশাবাদী। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন তার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাস্তবায়িত হবেই। পরিশেষে বলি, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই। নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
(এই লেখাটি ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু থেকে নেয়া)
এএইচ/
আরও পড়ুন