এই সেই ১৫ আগস্ট ’৭৫
প্রকাশিত : ১৬:৩৯, ২৪ আগস্ট ২০১৯ | আপডেট: ১৮:২৯, ২৪ আগস্ট ২০১৯
১৯৭৫ সালের পনের আগস্টের সেই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড। সেদিনের সেই ঘটনায় আমার ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা কয়টি আজ আবার বলতে ইচ্ছা হচ্ছে নিজের রোজনামচায় নিজের আবেগময় অনুভূতির কথা।
রোজনামচাটির শিরোনাম ছিল- ‘মহাত্মা গান্ধী, শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইন্দিরা গান্ধী’। সেই শিরোনামটিকে সামনে রেখে লিখেছিলাম:
মহাত্মা গান্ধী, শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইন্দিরা গান্ধী : এই যে এদের এমনভাবে কাতারবন্ধি করা হয়েছে এর দান-অবদান আমার নয়। আসলে এমনভাবে এরা কাতারবন্দি হবেন- একথা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। এদের এভাবে কাতারবন্দি দেখে আমার মনটা আলোড়িত হয়ে ওঠে।
বয়সের বিধানেই বোধহয় এখন আমার যখন তখন চোখে পানি আসে, গলা ধরে যায়। কারুর কাছ থেকে একটা ভালো কথা, আশার কথা, অনুপ্রেরণার কথা কিংবা বেদনার কথা শুনলেই চোখে গলায় আবেগের সৃষ্টি হয়। তখন সেই মুহূর্তে আর পরিস্কার করে বাক্য উচ্চারণ করতে পারিনে।
অথচ সচেতন বুদ্ধি দিয়ে বলি, আমি এ তিনজনের কারুরই অন্ধ ভক্ত কোনোদিন ছিলাম না। এটা কোনো বাহাদুরির কথা নয়। এদের তিনজনের কার্যকলাপকেই আমি নিজের জীবনে নিজের চোখে কিছুটা দেখেছি, নিজের কানে শুনেছি এবং বইপত্র পড়েছি। বলা চলে কিছুটা বিরুদ্ধভাবের পর্যালোচনামূলক মনোভাব।
গান্ধীজিকে হত্যা করা হয়েছে। শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা পশুতে করেনি। হত্যা মানুষেই করেছে। আমরা অবশ্য আমাদের অপছন্দের মানুষকে অনেক সময় পশুর সঙ্গে তুলনা করি। বলি : ওটা পশু। ও পশুর মতো আচরণ করেছে। অথচ এমন তুলনা অর্থহীন। মানুষ নিজের চরিত্রহীনকে পশুর ওপর আরোপ করতে চায়। অহেতুক, অযৌক্তিক এবং অপাশবিক আচরণের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। মানুষের মধ্যেই দেখা যায় অমানবিক আচরণ। অমানবিক এ কারণে যে, এমন আচরণ যে প্রজাতি হিসেবে মানবগোষ্ঠীর জন্য আত্মহত্যামূলক, এই কথাটা এই মানুষেরা বুঝতে পারে না।
গান্ধীজিকে কে হত্যা করেছিল? সে নামের উচ্চারণ বা অনুচ্চারণে কিছু আসে-যায় না। সে গডসে কিংবা নিডসে, তাতেও কিছু পার্থক্য হয় না। সে মানুষ। গান্ধীজি মানুষ ছিলেন। গডসেও মানুষ। গান্ধীজি জীবনব্যাপী নানা আচরণে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। রাজনীতি, অর্থনীতি বা সমাজনীতি, যে ক্ষেত্রের কথাই বলি না কেন, গান্ধীজির আচরণের মধ্যে তার আদর্শ প্রকাশিত হয়েছে। তার এই সব আদর্শকে কি আমি বা আমরা সব সময় সমর্থন করেছি? তা নয়।
সেই ’৪৫, ’৪৬, ’৪৭ সালে নানা ব্যক্তি, দল-উপদল নানাভাবে গান্ধীজিকে ব্যাখ্যা করেছে। সমালোচনা করেছে। আবার অসংখ্য তার অনুসারীও ছিল। তার সহযোগী সাথীরা ছিলেন। তারা সব সমাজনীতি বা ধর্মীয় নীতিকে আমি সমালোচনা করতে পারি। আমরা করেছিও। কিন্তু একটা মৌলিক সত্যকে তিনি তার আচরণ দ্বারা প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন : মানুষকে মানুষের সঙ্গেই বাস করতে হবে। তাদের পারস্পরিক বৈষম্য এবং বিভেদকে দূর করতে হবে। মানুষের ওপর মানুষের নির্যাতনের অবসান আবশ্যক।
আমাদের মতপার্থক্য ছিল তার উপায়ের ক্ষেত্রে। কিন্তু তার লক্ষ্যের ক্ষেত্রে নয়। কিন্তু গান্ধীজিকে যারা হত্যা করেছে তাদের আচরণে তাদের কি আদর্শের প্রকাশ ঘটেছে? যা ঘটেছে সেটা এই যে, মানুষ মানুষের সঙ্গে বাস করতে পারে না এবং কারুর যদি অপর কাউকে অপছন্দ হয় তাহলে তাকে অবিলম্বে হত্যা করতে হবে। গান্ধীজির হত্যাকারীরা অদূরদৃষ্টির লোক। তারা অর্বাচীন। আসলে তারা বোঝেনি : গান্ধীজিকে হত্যা করে তারা মানুষ হিসেবে নিজেদের অস্তিত্বকেই হত্যা করেছে। কারণ, তোমার যদি হত্যা করার অধিকার থাকে অপরকে, তাহলে অপরেরও অধিকার আছে তোমাকে হত্যা করার। এমন পারস্পরিক হত্যার ফলে পরিশেষে কাউকে হত্যা করার কিংবা কেউ নিহত হওয়ারই অবশিষ্ট কোনো মানবপ্রাণী থাকে না।
এই কথাটি এই অর্বাচীনরা বুঝতে পারেনি। এখানেই গান্ধীজিকে হত্যা করা অমানবিক। এটা পাশবিক নয়। পশুরা অপর এমন কোনো নিরীহ পশুকে হত্যা করে না। গান্ধীজি যখন মানুষের হত্যার আঘাতেই ঢলে পড়লেন তখন তার মুখ দিয়ে কোন অভিযোগ বাণী উচ্চারিত হয়নি। তিনি নাকি কেবল বলেছিলেন- হে ঈশ্বর! হা রাম! সে উচ্চারণে বিস্ময়ের বেদনা থাকতে পারে, এতদিনের তার ভালোবাসার, তার প্রেমের এই প্রতিদানের জন্য বিস্ময় বা বেদনা। কিন্তু অভিশাপ ছিল না। সে উচ্চারণে প্রকাশিত হয়েছিল অধিকতরভাবে এই বিশ্বাস : মানুষের সমাজকে রূপান্তরের পথ অনেক দীর্ঘ। তাকে সহজ ভাবাই ভুল।
শেখ মুজিবকে যখন সে রাতে ঘেরাও করে অস্ত্রধারীরা হত্যা করল তখন সাহসী শেখ মুজিব ভীত হলেন না। যারা তাকে গুলি করল, তাদের তিনি চেনেন। তার মুখেও উচ্চারিত হয়েছিল বিস্ময়ের ধ্বনি : তোরা কি করছিস! এই কথা বলেই নিজের ঘরের সিঁড়ির ওপর তিনি গড়িয়ে পড়েছিলেন। হত্যাকারীরা তাকে স্তব্ধ করে দেবার জন্য নিশ্চয়ই আরও গুলি ছুড়েছিল। গুলিবিদ্ধ সে দেহকে দেশবাসী কেউ দেখতে পারেনি। যারা দেখেছিল তাদের কেউ যদি এখনও বেঁচে থাকে হয়তো তারা বলতে পারে, কটা বুলেট সে দেহে বিদ্ধ হয়েছিল, কেমন করে সেই দীর্ঘদেহী ফরিদপুরের এককালের গ্রামের যুবকটি ঢলে পড়েছিল।
’৭৫-এর ১৪ আগস্ট রাতে আমিও চিন্তা করেছিলাম পনের আগস্টের কথা। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বেশ কিছুটা উত্তেজনা বিরাজ করছে। শেখ মুজিব আসবেন ইউনিভার্সিটিতে। তিনি কোন কোন পথ দিয়ে যাবেন, কোন বিভাগ থেকে যাবেন কোন বিভাগে, উপাচার্য তাকে কীভাবে সংবর্ধনা জানাবেন- ইত্যাদি কর্মসূচি প্রচার করা হয়েছিল। দেশে তখন বেশ কিছুটা রাজনৈতিক উত্তপ্ত অবস্থা। আমি নিরীহ শিক্ষক। কেবল দুই চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করি। ঘটনা থেকে ঘটনার চমকে চমকিত হই। নিজের ক্ষুদ্র জীবনকে ধন্য মানি। কত ঘটনা দেখলাম। পঞ্চাশ বছর আগেও আমার পূর্বোক্তগণ এত দ্রুত সব ঘটনার সাক্ষাৎ পেতে পারতেন না।
ঘটনাই তো জীবন। যত ঘটনা তত সেই জীবনের চঞ্চলতা। ’৭১-এর ঘটনা শুধু দেখলাম না, ’৭১-এর পরে পঁচিশ মার্চ থেকে নিহত হলাম। মৃত্যুর পরে বাঁচা বলে যদি কিছু থাকে, তবে ’৭১-এর পরে মৃত্যুর পর বাঁচার সেই বোধ হলো। তাতে একটা লাভ আমাদের এই হলো যে, মৃত্যুর ভয়টা একেবারে চলে গেল। মৃত্যুর পর মরার আর কি ভয় থাকে? এবং সে জন্যই বোধ হয় ’৭১-এর পশ্চাৎকালে আমরা যেমন মারতে ভয় পাইনে, তেমনি মরতেও ভয় পাইনে।
আমাদের ইতিহাসে কোনো যুগে এত মানুষ কি মানুষকে মেরেছে এবং এত মানুষ মরেছে এবং এখনও চিন্তা করলে কৌতুকের এই বোধটা আসে যে, মৃত্যুর জন্য যদি ভয় না থাকে তবে মরনের আর তাৎপর্য কি রইল? আমরা আগে মানুষকে ভয় দেখাতাম, তোমাকে মেরে ফেলব। অর্থাৎ তুমি ভয় পাও। ভয় পেয়ে আমার অকাম্য কাজ থেকে তুমি নিবৃত্ত হও। কিন্তু আমরা উদিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা যখন যথার্থই বলে, মৃত্যুকে আমি ভয় পাইনে, তখন তাকে মারের ভয় দেখিয়েও যেমন কোনো লাভ হয় না, তেমনি তাকে মেরে ফেলেও না। কারণ মেরে ফেলে তা কোনো সমস্যার সমাধান করা যায় না।
কথাটি কেবল আমরা হত্যাকারীরা বুঝিনে। মেরে ফেলে কোনো সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয় না। সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের পথ হচ্ছে দীর্ঘ বিবর্তনের পথ। মুক্ত মোকাবিলার পথ। যুক্তির সঙ্গে প্রযুক্তির লড়াইয়ের পথ। এ পথের কোনো বিকল্প নেই।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় এই যে আমার অর্বাচীনের মতো মাথা কাটার পথ নিয়েছি, এ আমরা শিখেছি পাতা কাটা থেকে। আমাদের ছেলেরা পরীক্ষার সময় বইয়ের পাতা কেটে নিয়ে যায়। পরিশ্রম করে পড়বে না। সহজে ব্লেড দিয়ে পাতা কাটবে। তাই ঢাকা ইউনিভার্সিটির গ্রন্থাগারের প্রায় বইয়েরই পাতা কাটা। এখানের দশ পাতা, ওখানে বিশ পাতা। অথচ পাতা কেটে কি জ্ঞান অর্জন করা যায়? না, তা যায় না। অবশ্য এমন ভারি কথা বললে রাস্তাঘাটের এমনকি ক্লাসঘরের যুবকরা বলে : রাখেন স্যার আপনার দর্শনের কথা। জ্ঞান কি আমরা ধুয়ে খাব? পাস হচ্ছে আসল।
আমাদের পাস করতে হবে। ‘বাই হক অর বাই ক্রুক।’ যেমন করে হোক, পাতা কেটে, খাতা চুরি করে, মাস্টার মেরে : যে করেই হোক। কথাটার জোর আছে। পরীক্ষার পাস করতে হবে। কিন্তু আমার প্রশ্ন : পরীক্ষা পাস করেই বা কি হবে? এবং তুমি দর্শন বল, আর বড় কথা বল সত্য তো এই যেসব পরীক্ষা নিয়েই তোমার, আমার এবং দেশের জীবনের পরীক্ষা। সে পরীক্ষাতে পাতা কাটা, শটকাট বা ‘মইডইজি’র তো কোনো জায়গা নেই।
পনের আগস্ট বোর রাতেই কিছু গুলির শব্দ শুনেছিলাম। ভোরের দিকে একটা মাইকের আওয়াজ : ‘খুনি মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। খুনি মুজিব কথাটাতে তত চমক লাগেনি। খুন করতে গেলে উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে খুনি বলতে হয়। তবে অনেককাল আগের একজন জ্ঞানী বলেছিলেন : খুনি কেবল এই কথাটি খেয়াল করে না, খুনিকে যে খুন করে সেও একজন খুনি।’
আমি চমকিত হয়েছিলাম, ‘মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে’-এই আওয়াজটাতে। আর যে কিছুর জন্যই সেদিন তৈরি থাকি না কেন, এই চমকটির জন্য নয়। আওয়াজ শুনে ভয়ে ঘরের দরজা-জানালা একটু বন্ধ করে দিয়েছিলাম। পরে একটু আলো ফুটতে ভয়ে ভয়ে ঘরের পুবের জানালাটা একটু ফাঁক করেছিলাম। এই জানালা দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের মূল চত্বরটি দেখা যায়। আতঙ্কিত মনে চাইলাম সেই চত্বরটির দিকে। একেবারে জনশূন্য। হয়তো সকাল ছ’টা কিংবা সাড়ে ছ’টা। দেখলাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা উড়িয়ে একটি কালো রঙের গাড়ি নিউমার্কেট-নীলক্ষেতের রাস্তার পশ্চিম দিক থেকে এলো, কলা ভবনের দালানটিকে হাতের ডানে রেখে উত্তর মুখে ঘুরল, কোথাও গেল, হয়তো পরিস্থিতিটা পর্যবেক্ষণ করল। আবার কয়েক মিনিট পর গাড়িটা ফিরে এই পথ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। এও আমার সেদিনের অভিজ্ঞতার আর এক চমক।
আমি একটু-আধটু শ্রেণীগত বিশ্লেষণের চেষ্টা করি। অপর কারুর জন্য নয়। নিজে বোঝার জন্য। ‘ব্যাপারটি কি’- এই ধরনের আত্মপ্রশ্নের আত্মজবাব হিসেবে। শ্রেণীগত বিশ্লেষণ একেবারে নিরর্থক নয়। আসলে কোনো ব্যক্তিই তো পরিবেশ-বিচ্ছিন্ন কোনো অস্তিত্ব নয়। একজন ব্যক্তি হয় বড়লোক, নয় গরিব। নয়তো মাঝামাঝি এই বড়লোক, গরিব আর মাঝামাঝি- এ তো কেবল তার সম্পদের পরিমাণের ভিত্তিতে নয়। তার সম্পদ তো আহরিত হয় কোনো মাধ্যম, কোনো ব্যবস্থায় এবং সেই মাধ্যম বা ব্যবস্থাই হচ্ছে বিশেষ বিশেষ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
একেই একটু তাত্ত্বিকভাবে বলা হয় ব্যক্তির শ্রেণীগত অবস্থান এবং অর্থনৈতিক এই শ্রেণীগুলোর মধ্যে সম্পদ বা সুযোগের তারতম্যের কারণে বিরোধ বিদ্যমান। মানুষের স্বাভাবিক জীবন-বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে সুবিধা-বঞ্চিতরা সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। সুবিধাভোগীরা সে লড়াইকে প্রতিরোধ করতে চায়। তাদের সুবিধাকে অব্যাহত রাখতে এবং বর্ধমান করতে চায়। আসলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য-অসাম্য তথা এর মধ্যকার দ্বন্দ্ব মানুষের সমাজের অন্যতম চালকশক্তি। কিন্তু এ তত্ত্বের আলোচনাও আমার উদ্দেশ্য নয়।
আমার অনুভব হচ্ছে, ব্যক্তিশ্রেণী ঊর্ধ্ব কোনো অস্তিত্ব নয়। প্রত্যেক ব্যক্তিরই শ্রেণীগত একটা অবস্থান আছে। গান্ধীজির ছিল। শেখ মুজিবের ছিল। ইন্দিরা গান্ধীর ছিল। সেই অবস্থান থেকে তারা আচরণ করেছেন। তাদের বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সে চিন্তার সাথে অপরের বিরোধ থাকতে পারে। গান্ধীজির রাজনৈতিক বা ধর্মীয় নীতিকে আমি অসমর্থন করতে পারি। আমার, তথা তার বিপরীত পক্ষের যদি কোনো নির্দিষ্ট নীতি থাকে তবে গান্ধীজির যুক্তির বিরুদ্ধে পাল্টা যুক্তি দিয়ে জনসাধারণকে বোঝাতে হবে। গান্ধীজির পক্ষে যদি জনমত প্রবল থাকে, বিপরীত পক্ষকে তার নিজের যুক্তির জোর এবং কর্মের ব্যাপকতা ও গভীরতা দিয়ে সেই জনমতকে পরিবর্তিত করে নিজের দিকে নিয়ে আসতে হবে। অবশ্যই ব্যাপারটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার।
গান্ধীজির নিজের জীবনই এর উত্তম দৃষ্টান্ত। এ প্রক্রিয়ায় অধৈর্য হয়ে গান্ধীজির মাথাটি কেটে ফেলে প্রক্রিয়ার পথটিকে হ্রাস করা যাবে না, যায় না। শেখ মুজিবের একটা শ্রেণীগত অবস্থান ছিল। তার রাষ্ট্রনৈতিক পদ, দায়িত্ব এবং ক্ষমতা ছিল। তার কর্মকাণ্ডে, চিন্তা-ভাবনায় পদক্ষেপের বাস্তবতা কিংবা অবাস্তবতায়, চিন্তার গভীরতা কিংবা অগভীরতায়, সমস্যার মোকাবিলায় পারদর্শিতা কিংবা অপারদর্শিতায় মূলত তার শ্রেণীগত শক্তি এবং সীমাবদ্ধতা নিশ্চয়ই প্রকাশিত হয়েছে। তুমি বা তোমরা, যারা তার বিপরীত পক্ষ, যারা তার হত্যাকারী এবং তার হত্যায় ক্ষণকালের আনন্দ-উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত, তোমাদেরও একটি শ্রেণীগত অবস্থান আছে।
তোমাদের এমন আচরণেও তোমাদের শ্রেণীগত চরিত্রেরই প্রকাশ ঘটেছে। তোমার মূল অবিবেচনা এখানে, যদি তোমাদের কোনো আদর্শ থেকে থাকে, রাজনৈতিক বা সামাজিক, তবে তাকে অর্জন করার পথ শেখ মুজিব বা তোমার প্রতিপক্ষকে হত্যা করা নয়। অবশ্য আগে উল্লেখ করেছি যে, জ্ঞানীর কথা, তার উক্তিই খাঁটি। তুমি যদি শেখ মুজিবকে ‘খুনি’ বলে খুন করে থাক তবে তুমিও খুনি। ব্যক্তিগতভাবে কাউকে খুন করা সাংঘাতিক কোনো কঠিন ব্যাপারও নয়। ছুরি দিয়ে খুন করা যায়। লাঠি দিয়ে খুন করা যায়।
স্টেনগান-ব্রেনগান দিয়ে খুন করা যায়। কঠিন হচ্ছে আদর্শগতভাবে খুন করা। শেখ মুজিবের ওপর এবং তার স্ত্রীর ওপর এবং তার ছোট ছেলে রাসেলের ওপর স্টেনগানের ব্রাশফায়ার করে খুনিরা মনে করল, সাংঘাতিক সাহসী কাজ তারা করেছে। সশস্ত্র কাপুরুষের দল গোপন আক্রমণে শেখ মুজিব এবং তার পরিবার-পরিজনকে খুন করল।
ফরিদপুরের কৃষকের সন্তান শেখ মুজিবের এই একটা গুণ ছিল যে, সে জানের পরোয়া করত না। এই গুণটা আমাদের ক’জনার থাকে? মরতে হবে, তবু আমরা মৃত্যুর ভয় করি। কিন্তু শেখ মুজিব জন্মগতভাবেই বোধহয় একটু একরোখা ছিলেন, গোঁয়ার ছিলেন। কৃষকের সন্তানের সারল্য থেকে তিনি হয়তো এই বোধটি পেয়েছিলেন : মরছি তো আমরা হরহামেশা, নিত্যমুহূর্তে। তবে তার মৃত্যুর ভয় কী? এমন বোধ থেকেই সাত মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো মানুষের জমায়েতে শেখ মুজিব বলেছিলেন : ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব।’
সত্যি, লোকটির কথায় যেমন গেঁয়োমি ছিল, তেমনি জোর ছিল। শেখ মুজিব আমাদের প্রিয় এই কারণে যে, শেখ মুজিব আমাদের পরিচিত ছিলেন। বিদেশি নন। অপরিচিত নন। অনাত্মীয় নন। তার বাড়ি আর আমাদের বাড়ির মধ্যে মাইলের দূরত্বও যেমন বেশি ছিল না। এক দেশের লোক। পাশাপাশি জেলার লোক। আত্মীয়তাই ছিল কি-না? এবং এদিক থেকে আমি এবং আমরা বলতে পারতাম : ‘আমাদের শেখ মুজিব’।
’৭১ সালের শেষের দিকে যখন আমাকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে গিয়ে আটক রাখল জেলের ২০ ডিগ্রির একটা নির্জন সেলে এবং যখন হতাশায়, আঘাতে প্রায় মুষড়ে পড়েছিলাম, পাহারারত সিপাইটি আমাকে অভয় দিয়ে বলল : সাহেব, আপনি তো আগেও জেল খেটেছেন। মন খারাপ করেন কেন? এই সেলে একদিন শেখ মুজিব ছিলেন। আর যেদিন তাকে গভীর রাতে আগরতলা মামলার বিচারের জন্য ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়, সেদিন সিপাহিদের মধ্যে আমিও ছিলাম। নিশ্চিত ফাঁসির মঞ্চের দিকে যাওয়ার মুখে দেখলাম, শেখ সাহেব সেলের বাইরে এসে নত হয়ে এক মুঠো মাটি নিয়ে মুখে ছোঁয়ালেন, বলে উঠলেন : ‘বাংলা মা আমার, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ তারপর আমাদের পাহারাদার সিপাহিদের জড়িয়ে ধরে বললেন : ‘যাই ভাই, তোমরা আমায় দোয়া করো।’
অবশ্য ’৭১-এর ষোল ডিসেম্বর দেশের জীবনে এক নতুন পর্যায় শুরু হয়েছিল। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিব এসে যখন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন তার জীবনের একটি নতুন পর্বের শুরু। পেছনের পর্যায়ে ত্যাগ-তিতিক্ষা, সাহসের একটি আবেগের সমাধান হবে না। এখানে নতুন দক্ষতা এবং দর্শনের প্রয়োজন হবে। কিন্তু দক্ষতা এবং দর্শন যাই হোক, পর্যায়টি দীর্ঘ এবং কষ্টকর এক নতুন পর্যায়।
এই নতুন পর্যায়ের নতুন দল গঠিত হচ্ছিল। নতুন মোকাবেলার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছিল। সমাজ রূপান্তরের দীর্ঘপথে এ অনিবার্য। আমি চাচ্ছিলাম, মুজিবের বিপক্ষীয়রা যেমন, মুজিবও তেমনি পরস্পরের সঙ্গে রাজনীতিকভাবে মোকাবেলা করুন : মুক্তির ভিত্তিতে, গণতন্ত্রের ভিত্তিতে। ধৈর্য, ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে। এমন হলেই মাত্র শেখ মুজিবের যেমন রূপান্তর ঘটত : ভালো কিংবা মন্দ, যাই হোক না কেন, তেমনি তার শক্তি এবং সীমাবদ্ধতা প্রকাশিত হতো। সেই মোকাবেলার মধ্য দিয়ে তাকে অতিক্রম করে সমাজ রূপান্তরের ক্ষেত্রে নতুনতর সংগঠন ও শক্তি বিকশিত হতো। এমন পর্যায়েও পক্ষ-বিপক্ষের ক্ষয়ক্ষতির প্রশ্ন থাকে। একের বিরুদ্ধে অপরের ন্যায়-অন্যায়ের অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগের ব্যাপার থাকে। কিন্তু হত্যা করার নীতি কোনো বিবেচনার নীতি নয়।
আমি শেখ মুজিবের দলের সদস্য ছিলাম না। আমি শেখ মুজিবের সরকার গৃহীত অনেক সিদ্ধান্তকে ব্যক্তিগতভাবে সমর্থন করতাম না। কিন্তু মানসিকভাবে আমি চাইতাম, দেশ যেন অতিক্রম করতে পারে একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত নেতৃত্বের পর্যায়টি। ব্যক্তিটি অতিক্রম করে যেন সাধারণের যৌথ সংঘশক্তি প্রকাশিত হতে ক্ষমতা, অপার ক্ষমতাবান ব্যক্তির ওপর সব কিছুতে নির্ভর করার প্রবণতা : সাধারণ মানুষের এইসব চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য, ভালো-মন্দ, কটু কথায় নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে দূরীভূত হয়ে সংগঠনের যৌথ নেতৃত্বকে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সংগঠন, তথা যৌথ সাধারণ অতিক্রম করে উঠুক, সেই পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকুক, এই ছিল আমাদের চেতনা-অচেতন মনের কামনা।
শেখ মুজিবকে আয়ুদানের ক্ষেত্রে এখানেই হত্যাকারীদের অবদান। গান্ধীজি স্বাভাবিক মৃত্যুর পরে যতখানি অমর হতে তার হত্যাকারী ব্যক্তিবর্গ তার চাইতে অধিক আয়ু গান্ধীজিকে দান করেছে। শেখ মুজিব স্বাভাবিকভাবে প্রয়াত হলে তার দান-অবদান, শক্তি এবং সীমাবদ্ধতার যে মূল্যায়ন সম্ভব হতো এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে যে আয়ু এবং অবস্থান তিনি লাভ করতেন তার হত্যাকারীর দল তার সেই মূল্যায়নকে রুদ্ধ করে মুজিবের দিকে আয়ুকে দীর্ঘতর করেছে, মুজিবের অবস্থানকে দৃঢ়তর করেছে।
শেখ মুজিবের দিকে নিক্ষিপ্ত হত্যাকারীর বুলেটের আওয়াজ থেকে মুহূর্তের মধ্যে জন্ম নিয়েছে অপর এক আওয়াজ : ‘এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে।’ ইন্দিরা নেহেরুর কন্যা। কিন্তু আজ ভারতে ‘নেহেরু’ শব্দের যত না উচ্চারণ, তার অধিক উচ্চারণ ‘ইন্দিরা’ শব্দের। এখানে অবশ্যই কন্যা পিতাকে অতিক্রম করে গেছেন। এবং তার এমন অতিক্রমণে তার দেহরক্ষীদের নিক্ষিপ্ত বুলেটের যে একটি অবদান রয়েছে তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।
(লেখাটি ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু গ্রন্থ থেকে নেওয়া)
এএইচ/
আরও পড়ুন