ঢাকা, মঙ্গলবার   ০১ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

শ্যামলী নাসরীন চৌধুরীর স্মৃতিতে শহীদ আলীম চৌধুরী

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:১৪, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১৪:২৪, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭

Ekushey Television Ltd.

ডা. আলীম চৌধুরী। মেধাবী চিকিৎসক হিসেবে দেশে-বিদেশের নামকরা হাসপাতালগুলোয় কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল তার। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর, রাজাকারদের চক্ষুশূল হয়েছিলেন। তার মূল্য দিতে হয় নিজের জীবন দিয়ে। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র একদিন আগে তাকে নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর নেতা মাওলানা মান্নানের নেতৃত্বে থাকা বদর বাহিনী। ১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে আরও অনেকের সঙ্গে তার ক্ষত-বিক্ষত লাশ পাওয়া যায়।

বাঙালি নারীর সামনে থেকে তার স্বামীকে  তুলে নিয়ে যদি হত্যা করা হয় এবং পরে তার লাশ পাওয় যায় তাহলে কেমন লাগে তা একমাত্র ভুক্তভোগীই জানেন। যেমনটি জেনেছেন ডা. আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী। চোখের সামনে দেখেছেন স্বামীর খুনিকে মন্ত্রী হতে। দাপটে বুক ফুলিয়ে বেড়াতে। নীরবে চোখ মু্ছেছেন। আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছেন। আল্লাহ তার ডাক শুনেছেন। এক খুনি বিচারের আগে মারা গেলেও তিনি (শ্যামলী নাসরিন) ছিলেন মানবতাবিরোধী অপরাধে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে করা ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম সাক্ষী।

একুশে টিভি অনলাইনের পাঠকদের জন্য তিনি শুনিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ সময়কালীন সেই কাহিনী। পাঠকদের জন্য তা নিজের ভাষায় লিখেছেন  প্রতিবেদক  আলী আদনান।

ডা. আলীম চৌধুরী ও শ্যামলী নাসরীন চৌধুরীর পরিবারটি বাবা-মাসহ বসবাস করতেন পুরানা পল্টনের ২৯/১ নম্বর বাড়িটিতে। যুদ্ধ শুরুর পর সব সময় তার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা আসতেন। ‍আসতেন অনেক বড় বড় রাজনৈতিক নেতাও। তাদের অন্যতম জাতীয় চার নেতাদের একজন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপক্ষের শক্তি হিসেবে মুক্তিযোদ্ধারা তার বাড়িটিকে নিরাপদ মনে করতেন। জুন-জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে সেই বাড়িতে আশ্রয় নিতে আসেন মান্নান নামে একজন অপরিচিত মানুষ। এসেই আলীম চৌধুরীর অনেকটা পা জড়িয়ে ধরার মত করেই আশ্রয় চায়। তার স্ত্রী শ্যামলী নাসরীন এমন অপরিচিত লোককে আশ্রয় দিতে বাধা দেন। কিন্তু মান্নান যে লোকটিকে সুপারিশ করার করার জন্য নিয়ে এসেছে তার ও মান্নানের অনুনয়-বিনয়ে মন গলে আলীম চৌধুরীর। মাত্র তিন চার দিন থাকার বথা বলে উঠলেও মান্নান কয়েকদিনের মধ্যে বাড়ির মালিককে ম্যানেজ করে তার পুরো পরিবার এনে তোলে ওই বাড়িতে। তার কয়েকদিন পর থেকে দেখা যায় বাড়িটা পাহারা দিচ্ছে নীল শার্ট ও এ্যাষ রংয়ের প্যান্ট পরা বেশ কয়েকজন যুবক। ডা. আলীম চৌধুরী তখন মান্নানকে ওই যুবকদের ব্যাপারে জেরা করেন। তখন সবাই জানতে পারে মান্নানের আসল চেহারা।

মান্নান নিজেকে আলবদর কমান্ডার হিসেবে পরিচয় দেয়। সে জানায় ওই যুবকগুলো আলবদরের সদস্য। মূলত তারা মান্নানকে পাহারা দেয়। মান্নান চালাকি করে আরও বলে, আমার বিপদের মুহূর্তে আপনারা আমাকে এ বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন, আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও যে কোনো সময় আপনাদের পাশে থাকব।

সময় গড়ায়। ২৯/১ বাড়িটার নিচতলায় নানা ধরনের লোক আসে। দেখেই বুঝা যায়, এরা বিশ্বাস করে দেশ কখনো স্বাধীন হবে না।

১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল।

আলীম চৌধুরীর পরিবারটি পড়াশোনা জানা পরিবার। রাজনৈতিক সচেতন। যুদ্ধের গতি দেখে আগে থেকেই বুঝেছিল দেশ স্বাধীন হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। ১৫ ডিসেম্বর বিকালে বসে পরিবারের সবাই সেসব আলোচনা করছিল। আকাশে তখন চক্বর দিচ্ছে ভারতীয় মিগ। দেখে বিডিআর ক্যাম্পে চলছে একচেটিয়া বোমা বর্ষন। ডা. আলীম চৌধুরী খুব উল্লসিত। এমন সময় বাড়ির সামনে এসে একটা জিপ দাড়ায়। জিপ থেকে কয়েকজন লোক নেমে ঢুকে যায় মান্নানের বাড়িতে। বিশ থেকে ২৫ মিনিট পর বের হয়ে আসে তারা। (এখানে বলা হয়নি একই বাড়ির নীচ তলায় মান্নান ও ওপরের তলায় আলীম চৌধুরীর পরিবার ‍বাস করলেও গেট ছিল দুটি। একটি মান্নান ও অন্য গেটটি ডা. আলীম চৌধুরীর পরিবার ব্যবহার করত।) বের হয়ে সোজা আলীম চৌধুরীর দরজায় এসে জোরে জোরে করাঘাত করতে থাকে ও দরজা খুলে দিতে বলে। আলীম চৌধুরী দৌড়ে মান্নানের দরজায় গিয়ে মান্নান ভাই, দরজা খুলুন, দরজা খুলুন বলে সাহায্য চায়। কিন্তু মান্নান দরজা খোলে না। ততক্ষণে বন্দুকধারী নীল শার্ট গায়ের লোকগুলো উঠে আসে উপরে। মান্নান দরজা ফাক করে বলে, ’আপনি যান, আমি আছি’।

ডা. আলীম চৌধুরীকে নিয়ে তোলা হয় গাড়িতে। তার স্ত্রী শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী তখন দৌড়ে আবার মান্নানের কাছে যান। সব আকুতি এক করে স্বামীকে ফিরিয়ে দিতে বলেন। মান্নান অনেকক্ষণ নীরব থেকে বলে, চিকিৎসা করানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছে। আবার দিয়ে যাবে।

১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। সারা দেশ হাসে। কিন্তু আলীম চৌধুরী ও তার পরিবারের মত তখন কান্নার রোল। সতের ডিসেম্বর মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায় আলীম চৌধুরী ও তার মত অনেক বুদ্ধিজীবী, যাদের ধরে নেওয়া হয়েছিল শেষ সময়ে তারা কেউ বেঁচে নেই।

১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে চিকিৎসক সমাজের অহংকার ডা. আলীম চৌধুরীর ক্ষত-বিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। একই সঙ্গে পাওয়া যায়, আরেক বরেণ্য চিকিৎসক ফজলে রাব্বীর লাশ।

দুজনের পিছনে হাত ও  চোখ গামছা দিয়ে বাঁধা ছিল। গালে মাথায় বেয়নেটের অসংখ্য চিহ্ন। পেটে, বুকে ব্রাশ ফায়ারের চিহ্ন। আজিমপুর নতুন কবরস্থানে সমাহিত করা হয় তাকে।

ডা. আলীম চৌধুরী দু্ই সন্তান রেখে যান। ফারজানা চৌধুরী নিপা ও নুজহাত চৌধুরী শম্পা। দুজনই এখন প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তাদেরকে ছোট বেলায় দেখতে হয়েছে তাদের বাবার খুনী মান্নান ( ৭৫-এর পরে যে হয়ে যায় মাওলানা মান্নান) জিয়াউর রহমানের আমলে মন্ত্রী। ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে নুজহাত চৌধুরী এ সম্পর্কে একটি স্মৃতিচারণ করেন। ঘটনাটা এরকম-

১৯৯২ কী ৯৩ সালের কথা। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ফাঁসির রায়ের পক্ষে গণসাক্ষর সংগ্রহ চলছে। নুজহাত চৌধুরী তার ক্লাসের একটি ছেলেকে বলেন, সাক্ষর করতে। ছেলেটি জবাব দেয়, তোমার বাবা মরেছে। আমার বাবা তো মরেনি। আমি কেন সাক্ষর করব?

একজন সন্তান হিসেবে এটা কতোটা কষ্টের তা ভুক্তভোগী ভাল বলতে পারবেন।

জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তির বিষয়ে শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী বলেনন, আমার জীবিত অবস্থায় যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দেখতে পেয়েছি, এটাই বড় পাওয়া।

শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী শুধু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক হওয়ায়, ২০০২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তাকে অন্যায়ভাবে তার চাকরি জীবনে হস্তক্ষেপ করে। বর্তমানে তিনি উদ্দীপন বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ‍ডিগ্রি নেওয়া এই মহিয়সী নারী ১৪টি গ্রন্থের প্রণেতা। আজীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের লক্ষে ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে মাঠে থেকেছেন। দায়িত্ব পালন করছেন, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে।

 

এসএইচ/ এআর


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি