সুমন জাহিদ
‘সেলিনা পারভীন একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা’
প্রকাশিত : ২২:৪০, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭
রায়ের বাজার, মিরপুর, কাটাসুর, মোহাম্মদপুর, বধ্যভূমি, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, খান সেনা, যুদ্ধ, কারফিউ- শব্দগুলো আজও আচ্ছন্ন করে দেয়। কান্নার ভাষা হয়ে ঝড়ে এই শব্দগুলো। স্বাধীনতার উত্তাল কলরোলের মধ্যে যেই খবর বেদনায়, শোকে হতবাক করে দিয়েছিল মানুষকে সেটি এক ভয়াবহ স্মৃতি। বিজয়ের সন্ধিক্ষণে যখন বাংলাদেশ ঠিক তখন অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে বাড়ি থেকে ধরে এনে বিভিন্ন টর্চার সেলে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বিভিন্ন জনবিড়ল স্থানে সেসব লাশ ফেলে দেওয়া হয়।
আজ ১৪ ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বিজয়ের প্রাককালে পাকিস্তানি হায়নারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের। তাদের মধ্যে অন্যতম মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীন। একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) ও ইটিভি অনলাইন’র সঙ্গে কথা বলেছেন শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের একমাত্র সন্তান লেখক ও সংগঠক সুমন জাহিদ। তার সাক্ষাৎকারটি লিখেছেন – সোহাগ আশরাফ
একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) অনলাইন : শুভ সকাল। একুশে টিভি অনলাইনের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত জানাই।
সুমন জাহিদ : ধন্যবাদ।
একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) অনলাইন : আপনি একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীর সন্তান। আজকের দিনটি আপনার জন্য অনেক বেশি কষ্টের। তারপরও মনে করি একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীর সন্তান হিসেবে আপনি গর্বতবোধ করেন। কারণ আপনার মা একজন নির্ভিক সাংবাদিক ছিলেন। তার লেখনির মধ্যদিয়ে তিনি যুদ্ধ করেছেন। আজকের দিনটিকে ঘিরে আপনার কি কি পরিকল্পনা ছিল?
সুমন জাহিদ : গতকাল ছিল ১৩ ডিসেম্বর। আমাদের বাসা থেকে ওইদিন মাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। চৌধুরী মঈন উদ্দিনের নেতৃত্বে আল বদর বাহিনী তাকে ধরে নেয়। প্রতি বছরের মত এবারও সকালে মায়ের কবরটা জিয়ারত করেছি। এরপর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে যাই। শ্রদ্ধা নিবেদন করি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে যাই (যেখানে আমার মায়ের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়)। দিবসটিকে ঘিরে প্রতিবছর এই কর্মসূচিগুলো থাকে।
একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) অনলাইন : আমরা সেই সময়ের কথাগুলো শুনতে চাই। যদি একটু স্মৃতিচারণ করতেন।
সুমন জাহিদ : আসলে অল্প সময়ে, অল্প কথায় শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয়। যারা ওনার সম্পর্কে জানতে চান তারা ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীন স্মারকগ্রন্থ’টি সংগ্রহ করতে পারেন। এটা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এবং ইত্যাদি গ্রহন্থপ্রকাশে পাওয়া যাবে।
মা সরাসরি রাজনীতি করতে না। কিন্তু রাজনীতি সচেতন ছিলেন। সভা-সমাবেশগুলোতে তিনি অংশহগ্রহণ করতেন। আমাকেও নিয়ে যেতেন। আমার তখন ৮ বছর বয়স। আমার স্পষ্ট মনে আছে। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরিতে গিয়েছি, ৭ই মার্চের ভাষণ শুনতে গিয়েছি।
আপনি চিন্তা করেন ওই সময়ে একজন মহিলা একটি পত্রিকায় কাজ করছেন। একজন সিঙ্গেল ওম্যান হয়ে পত্রিকা চালাচ্ছেন আবার সংসারও দেখছেন। আমাকে লালন পালন করছেন। দুই দুটি পত্রিকার জন্য বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করা, লেখা সংগ্রহ করা খুবই কঠিন কাজ ছিল। আমি দেখতাম, অনেক সময় মা আমাকে বাসায় রেখে নিজে যেতেন। কোন কোন সময় রিকসা বা বাসে না গিয়ে হেটে চলে যেতেন। উনি ওনার পত্রিকা ‘শিলালীপী’র বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন।
আমার মনে আছে আমাকে নিয়ে মা একদিন ওষুধ কিনতে গেলেন দুই তিন দোকানে। প্রথমে বাংলামটর, তখন ওটা পাকমটর ছিল। এরপর মিটফোড হাসপাতাল। তারপর ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের সামনে। বিভিন্ন জায়গা থেকে একটু একটু করে ওষুধ কিনে আনলেন। পরে রাতে এগুলো স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দেন। এছাড়া আহত এক মুক্তিযোদ্ধা আমাদের বাসায় আসেন, তাকে মা সেবা দিয়ে সুস্থ্য করে তোলেন। এরকম কিছু ছোট ছোট কাজ, যেগুলো স্বাধীনতা বিরোধিদের জন্য খুবই খারাপ দৃষ্টিতে ছিল।
আরও একটা বিষয় আপনারা জানেন যে- স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রায় সব পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। ইত্তেফাক, সংবাদ জ্বালিয়ে দিয়েছে। মায়ের ‘শিলালীপী’ও বন্ধ হয়ে গেছে। মা তখন পত্রিকাটা পুনঃপ্রকাশের জন্য রাও ফরমানের কাছে যান। সেখানে যাওয়ায় উনি ওদের তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে। ব্লকলিস্ট যাবে বলে।
তখন এই পত্রিকায় লিখতো- শহিদুল্লাহ কায়সার, মুনির চৌধুরী, জহির রায়হান, ড. বোরহান উদ্দিন খানসহ বিখ্যাত লোকেরা। শিল্পী হাসেম খান এটির প্রচ্ছদ করতেন। ওরা যখন জানলো তখন মাকে বলতো এটা পরিবর্তন করো, ওটা পরিবর্তন করো। মাকে দিয়ে একটি সংখ্যার প্রচ্ছদও পরিবর্তনা করানো হয়। বলা হয়- পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদ নিয়ে লেখো। উনি সম্ভবত আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে একটি সংখ্যা বের করেন। সেই সংখ্যার প্রচ্ছদ পরিবর্তন করানো হয়। এসব কারণে ওদের কাছে মা চিহ্নিত হয়ে যান।
তাছাড়া উনি ইত্তেফাক, ললনা, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক পাকিস্তানে লিখতেন। ওগুলোর একটা সম্মানি ছিল। সেগুলো আনতে বিভিন্ন সময় পত্রিকা অফিসে যেতে হতো। আরও অনেক কারণ ছিল। মূলত এসব কারণেই মাকে চলে যেতে হয়েছে।
উনি কিন্তু ওই সময় খুব বিখ্যাত কোন মানুষ ছিলেন না। মাত্র লেখা লেখি শুরু করেছেন। প্রতি তিন মাস পর পর পত্রিকাটা বের হতো।
একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) অনলাইন : ১৩ ডিসেম্বরের সেই কথাটা শুনতে চাই। কি হয়েছিল সেদিন?
সুমন জাহিদ : ১৩ ডিসেম্বর দুপুরে মাকে বাসা থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরপর ওনাকে অনেক নির্যাতন করা হয়। যা আমি মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৩৫ বছর পরে জানতে পেরেছি। ওই ঘটনা আমি মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেনের কাছ থেকে জেনেছিলাম। ওনাকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমার মার মৃত্যুর কারণে উনি বেঁচে যান। পেছন থেকে হাত ছুটিয়ে, চোখ খুলে দৌঁড়ে পালান তিনি। উনি এখনও বেঁচে আছেন।
তিনি আমাকে বলেছিলেন, যখন তিনদিন তাদের রায়ের বাজার, মোহাম্মদপুর ফিজিকাল সেন্টারে রাখা হয়েছিল ওই সময় তাদের খেতে দেওয়া হয়নি, বসতে দেওয়া হয়নি। এমনকি প্রাকৃতিক কোন কাজও করতে দেওয়া হয়নি। বরং ওনাদেরকে নির্যাতন করা হয়ছে। যে লিখতো তার আঙ্গুল কেটে ফেলা হয়েছে। যে চোখের ডাক্তার ছিলেন তার চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে। বুকের পাজর ভেঙ্গে কলিজা বের করে নেওয়া হয়েছে। এটা উনি দেখেছেন।
রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে শেষ সময়ে যখন মাকে নিয়ে দাঁড় কারানো হয়, উনি বুঝতে পেরেছিলেন কি হচ্ছে। তখন উনি করুনভাবে বলেছেন- ‘তোমরা আমার ধর্মের ভাই। তোমরা আমার ধর্মের বাবা। আমাকে ছেড়ে দাও। ঘরে আমার আট বছরের একটা সন্তান আছে।’ ওরা মায়ের কোন কথাই শোনেনি। উল্টো বেয়নেট দিয়ে মায়ের মুখ ফেড়ে দেয়। মা চিৎকার করছে। কথা গুলিয়ে যাচ্ছে। বেয়নেট দিয়ে ওনার বুকে চার্জ করে। এরপর নিচে পরে গিয়ে যখন চিৎকার করেন তখন গুলি করে হত্যা করে।
একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) অনলাইন : আমরা আশা রাখি দেশের জন্য মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীন ও সব শহীদদের এই যে আত্মত্যাগ তা জাতি সব সময়ই স্মরণ করবে। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।
সুমন জাহিদ : সত্যি কথা বলতে আমরা তাদের অবদানের স্বীকৃতি দিতে পারিনি। তাদের যে অবদান আমাদের রাষ্ট্র কি সেই অবদান তুলে ধরতে পেরেছে? আমার মাকে যেখান থেকে ধরে নিয়ে গেছে সেই রাস্তাটা মগবাজার থেকে মৌচাক। অনেক সংগ্রাম করে এই রাস্তাটার নাম শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক করা হয়। ফ্লাই ওভার করার পর ওটা মুছে গেছে। আমি অনবরত প্রশানকে বলছি। মেয়রকে চিঠি দিয়েছি। আবেদন করেছি যে ফলকগুলো আবারও পুনস্থাপন করা হোক। কবে করবে জানি না। এই মগবাজারের চারিদিকে যে রাস্তাগুলো সবগুলো মুক্তিযোদ্ধা, শহীদদের নামে করা। আমি প্রধানমন্ত্রীসহ প্রশাসনের সবার কাছে চিঠি দিয়েছি যাতে এই বিষয়টার দিকে নজর দেওয়া হয়।
মগবাজার যে ফ্লাই ওভারটি হয়েছে আমি দাবি করেছি এটা কোন একক জনেন নামে নয়, ৭১-এ ‘শহীদ স্মৃতি উড়াল সেতু’ হিসেবে নাম করণ করা হোক।
এসএইচ/