ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০৭ নভেম্বর ২০২৪

‘জাতিকে মুক্তির মহাসড়কে তুলে দেয় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:৫৪, ৭ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১৬:৫৮, ৭ মার্চ ২০১৮

মঈন উদ্দীন খান বাদল

মঈন উদ্দীন খান বাদল

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে ৭মার্চ একটি অনন্য দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকার রমনায় ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী) জনসমুদ্রে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। ১৮ মিনিট স্থায়ী এই ভাষণে তিনি বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেদ করে স্বাধীনতার দিশা দেন। একই সঙ্গে তিনি পাকিস্তান সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে পুরো জাতিকে সোচ্চার করে মুক্তি সংগ্রামে উজ্জীবিত করেন। পূর্ববঙ্গ থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এই ভাষণ একটি জাতিকে মুক্তির মহাসড়কে তুলে দিয়েছিলো। এমনটিই মনে করেন স্বাধীনতা সময়কালীন তুখোর ছাত্রনেতা ও বর্তমান জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) একাংশের  কার্যকরী সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মঈন উদ্দীন খান বাদল এমপি।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওই ঐতিহাসিক ভাষণের প্রেক্ষাপট ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি।

মঈন উদ্দীন খান বাদল বলেন, বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের গুরুত্ব অনুধাবন করে নিউজ উইক ম্যাগাজিন তাকে রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো ৭ মার্চের ভাষণকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে (এমওডব্লিউ) ’সংগৃহীত হয়েছে। দেশে-বিদেশে এই ভাষণ মোট ১২টি ভাষায় অনুদিতও হয়েছে। এই ভাষণকে ম্যাগনাকার্টার সঙ্গেও ‍তুলনা করা হয়।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইনের প্রতিবেদক কাজী ইফতেখারুল আলম তারেক। সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো-

একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত ৭ মার্চের ভাষণকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মঈন উদ্দীন খান বাদলঃ ৭ মার্চ আমার আমিকে তৈরি করেছে। বাঙালি জাতির অস্তিত্ব তৈরি করেছে। বাঙালি জাতির সাড়ে তিন হাজার বছরের ইতিহাসে অখণ্ড স্বাধীনতা বলে কখনো কিছুই ছিল না। পরাধীনতার শৃঙ্খলে নিষ্পেষিত ছিল বাঙ্গালির জীবন। ভূমিপুত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে এই ভাষণের মধ্যে দিয়ে বাঙালির আজকের এই অবস্থান। আমাদের সবার প্রাণের  অস্তিত্বই এই ভাষণকে মহিমান্বিত করে। আমার  কাছে মনে হয়েছে, জাতি একজন মহামানবের অপেক্ষা করছিল। সম্ভবত স্বয়ং কবিগুরুও অপেক্ষা করছিলেন। যেমনটি মনে হয়েছে কবিগুরুর শেষ বয়সে রচিত ‘সভ্যতার সংকট’ পড়ে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘তিনি পূর্ব দিগন্তে আবির্ভূত হইবেন, বিচুন্ন সভ্যতায় মানবিক মূল্যবোধে মানুষকে মহিমান্বিত করে তুলবেন।`

১৯২৬ সালে ওয়াজেদ আলি বলেছেন, ‘বাঙালি এখন ভবিষ্যতের পূর্ণতার রাজনীতির জন্য অপেক্ষা করছে। বাঙালি এখন সেই মহামানবের প্রতীক্ষায় যিনি তাঁকে, বাঙালিকে এই গৌরবময় জীবনের সন্ধান দেবেন।’ অনেক আগেই কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলে গিয়েছেন, ‘বাংলা বাঙালির হোক, বাংলার  জয় হোক,  বাঙালির জয় হোক।’

একুশে টিভি অনলাইনঃ মুক্তিযুদ্ধের দিশা দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কোর প্রামাণ্য ঐতিহ্যে জায়গা করে নিয়েছে, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনার অনুভূতি কি?

মঈন উদ্দীন খান বাদল : আবারও বলছি ৭ মার্চের ভাষণ মানেই আমার আমি। এই যে মঈন উদ্দীন খান বাদল ‘বিকজ অফ ৭ মার্চ’। আমি ৭ মার্চের মঞ্চের একজন পাহারাদার ছিলাম। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ময়দানে যখন গিয়েছি, তখন আমার মনের মধ্যে অগণিত প্রশ্ন ছিল। আমার চিত্ত অস্থির ছিল কি হবে এখানে? কি হতে যাচ্ছে? সে সময় প্রশ্নগুলি আমাকে উদ্বেলিত করেছে। সুতরাং একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হওয়া, একদল মানুষ আমরা সেদিন ময়দানে উপস্থিত হয়েছিলাম। কিন্তু ভাষণ শোনার পর যে মঈন উদ্দীন খান বাদল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেছে, সে তখন একজন পুরোপুরি যোদ্ধা। সে তখন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়ে ফেলেছে।

কারণ সেদিন আমার নেতা বলেছিলেন, ‘তোমাদের ভাতে মারবো,পানিতে মারবো। নেতা বলে দিয়েছেন, যার যার আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে। নেতা বলে দিয়েছেন, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দিব।’

ওই ১৮  মিনিটের ভাষণের সব থেকে বড় দিক হল, যখন ভাষণ শুনতে গেলাম ‘আই ওয়াজ অ্যান ইনোসেন্ট সোল উইথ আউট ইন টার্গেট ইনফ্রন্ট মি`। আর আমি যখন ১৮ মিনিট পর বেরিয়ে এলাম তখন-আই এম অ্যা সোলজার। ‘আই হ্যাভ গট এ টার্গেট ইনফ্রন্ট অব মি`। পৃথিবীতে কোনো ভাষণ একটা জাতিকে ১৮  মিনিটের মধ্যে একটা ড্রামাটিক চেঞ্জ, কোয়ালিটিভ চেঞ্জ, গুণগত পরিবর্তন এনে দিতে পারে সেটা খুঁজে পাওয়া দুস্কর।

আমাদের দেশে একটা বদভ্যাস আছে- সবসময় আমরা বিদেশি স্বীকৃতিকে খুব বড় করে দেখি। বিদেশি স্বীকৃতি না দিলে, ইউনেস্কো স্বীকৃতি না দিলে এই ভাষণ কি ছোট থাকতো? এ ভাষণ একটি জাতিকে মুক্তির পথ ধরিয়ে দেয়। সুতরাং ইউনেস্কো বলেছে এজন্য আমাদের চোখ খুলে গেছে। এতোদিন তাহলে আমাদের চোখ খুলেনি। এ প্রবণতাকে সঠিক মনে করি না। দ্বিতীয়টি হল আমি অনেককে বলতে লক্ষ্য করি, এ ভাষণ ওই ভাষণ থেকে সেরা। তাদের বলি ‘ডোন্ট ডু দিস’।

আপনি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে যদি মোনালিসা আরেকবার আঁকতে বলেন সে পারবে না, পিকাসোকে গুয়ের্নিকা আঁকতে বললে, সে পারবে না, আপনি নজরুলকে আরেকবার `বিদ্রোহী কবিতা` লিখতে দিলে সে পারবে না। বিশ্বে মনুষ্যত্বের সেরা সৃষ্টিগুলির কোনো সেকেন্ড রিপিটেশন হয় না। প্রেক্ষাপট একবারই আসে। কোনোটার সঙ্গে কোনোটাকে তুলনা করা ঠিক হবে না। একটি রক্তাক্ত সিভিল ওয়্যারের পরে লিংকন গেটিজবার্গ ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। রক্তের সাগরে দাঁড়িয়ে তাকে সে সময়ে বক্তৃতা করতে হয়েছিল। নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষকে সামনে রেখে আমেরিকার কালো মানুষের নেতা মাটিন লুথার কিং লাখ লাখ নিগৃহীত কালো মানুষের জন্যে বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন-‘আই হ্যাভ গট অ্যা ড্রিম’।

এগুলোর প্রতিটির প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল। অথবা নেলসন ম্যান্ডেলা যখন প্রায় ২৬ বছর জেলখেটে বেরিয়ে আসেন তখন তিনি প্রায় বাঁকা হয়ে গেছেন ম্যান্ডেলা সেদিন জোহান্সবার্গের অ্যাভিনিউতে বলেছিলেন, আমি ২৬টি বছর সাদা মানুষের অত্যাচার সহ্য করেছি, যদি আমার প্রয়োজন হয় তাহলে কালো মানুষের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সারাজীবন লড়াই করব।’

সুতরাং কেউ যদি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে তুলনা করে সেটি হবে বোকামি। একটি জাতিকে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত করে সুনিদিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে অগ্রসর করে দেওয়ার সেই ভাষণ বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। এই ভাষণকে উপলক্ষ করে সাবানা আজমির পিতা কাইফে আজমি লিখেছেন ` শুধু তো একটি দেশ নয়, যে তুমি জ্বালিয়ে দেবে/ প্রাচীন নয় যে তুমি পুরোপুরি মুছে ফেলবে/ কতই না নির্বোধ তুমি,  খয়রাতে পাওয়া ট্যাঙ্ক নিয়ে আমার দিকে ধেয়ে আসছ/ রাত দিন নাফাম বোমার বৃষ্টি বসাচ্ছ। ক্লান্ত হয়ে পরবে তুমি/ শৃঙ্খল পরাবে তুমি কোন হাতে? হাত তো আমার আছে সাত কোটি/ গর্দান থেকে কোন মাথাটি তুমি আলাদা করবে? সেখানে তো মাথা আছে সাত কোটি। একটি  ভাষণ  সাত কোটি মাথাকে এক সাথে গ্রথিত করতে পারে। সে কারণে সেটা অমর।’

একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ একাত্তরের জাতির ক্রান্তিলগ্নে যে ক`জন প্রথম সারির ছাত্রনেতা ছিলেন তাঁর মধ্যে   আপনি অন্যতম। আমার প্রশ্ন হচ্ছে ৭ মার্চের সেই অগ্নিঝরা দিনে এবং পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার লক্ষে আপনাদের কি ভুমিকা রেখেছিলেন?

মঈন উদ্দীন খান বাদলঃ ১৯৭১ সালের উত্তপ্ত দিনে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। মার্চের অগ্নিঝরা দিনগুলিতে এটা বুঝতে সক্ষম হয়েছিলাম যে, আমাদেরকে একটা সশস্র যুদ্ধের দিকে যেতে হবে। পাকিস্তানিদের কাছে আমাদের আর পাওয়ার কিছু নেই। যে কারণে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের মাঠে সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। এছাড়া স্কুল জীবনে জুনিয়র ক্যাডেট কোর, কলেজ জীবনে ইউটিসির মেম্বার থাকার কারণে সামরিক বিদ্যা সম্পর্কে প্রাথমিক একটা ধারণা ছিল। এই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের দিক নির্দেশনা আমাদের কাছে আরও পরিস্কার হয়ে উঠে। জাতির পিতা সেদিন বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম`।

আমাদের নেতা সিরাজুল আলম খান আমাদের ডেকে ব্রিফ করলেন যে, যার যার এলাকায় চলে যাও,সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও। সেই সময় ছোট ছোট কিছু শ্লোগান ছিল ‘অ’ একটি বাংলা অক্ষর, বাঙ্গালির জীবন ‘ক’ একটি বাংলা অক্ষর, বাঙ্গালির জীবন। মার্চের ১০/১২ তারিখের দিকে আরও কিছু লিফলেট নিয়ে চট্টগ্রামে চলে গেলাম।

আমার বিচরণ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিজের এলাকায় এর আগে ততটা বিচরণ ছিল না। নেতার নির্দেশনা পেয়ে এলাকার ছাত্রলীগারদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করি এবং মুক্তিকামী জনগণের কাছে লিফলেট বিতরণ করি। আমি অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে এলাকা থেকে সিভিল গান (ব্যক্তিগত বন্দুক) মুক্তিযোদ্বাদের পক্ষে নিয়ে ব্যবহার করি।

ঢাকা থাকে ওয়াবদার একটা গাড়ি এসেছিল এলাকায়। সেটা আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্যবহার করেছি। এ ব্যবহারের সুত্র ধরে প্রশিক্ষণক্যাম্প খুলি। কিন্তু এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো সেই প্রশিক্ষণ কাম্পে যে (সিভিল গান) যোগার করেছিলাম সেই বন্দুকগুলো প্রশিক্ষণে অনেকটা শেষ করে ফেলেছি। সুতরাং বন্দুকের অনুপাত গুলির সংখ্যা বেশ-কম ছিল।

যাদেরকে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়েছি তাদের মধ্যে ২০/২৫ যারা খুব ঘনিষ্ট তারা একত্রে থাকতাম। একটা কোর বাহিনী গঠন করেছিলাম। ২৬ তারিখ প্রত্যূষে আমার এক কৃষক আত্মীয় দৌড়ে এসে আমাকে বলল সর্বনাশ হয়েছে। হাজার হাজার সৈন্য বিলের উপর দিয়ে আমাদের এলাকার দিকে আসছে। আমি বললাম তোমরা বন্দুকগুলো নিয়ে কানুর দিঘির ভিতরে চলে যাও। ওখানে আশ্রয় নাও। আমি ওদের একটা সময় বেঁধে দিলাম। ওই সময়ের মধ্যে যদি আসতে না পারি তাহলে তোমরা পাহাড়ের দিকে চলে যাবে।

আমি দেখলাম দূর কুয়াশার ফাঁকে পিঁপড়ার মতন লোকজন সামনের দিকে আসছে। তখন চিন্তা করলাম পাকিস্তানি সেনারা বিলের মধ্য দিয়ে আসার সাহস করবে না। তারা আসলে রাস্তা দিয়ে আসবে। এরা বোধ হয় বাঙালি সৈন্য হবে। যোগাযোগের অভাবে ঢাকায় কি ঘটছে তা বুঝার সাধ্য আমাদের কারো ছিল না। তখন তো আর টেলিফোনের যুগ ছিল না। যুবক বয়সে বোধ হয় এটি আমার সেরা সিদ্ধান্ত ছিল যে, এরা বাঙালি সৈন্য না। দেখলাম এরা হেলে-দোলে অনেকটা ক্লান্ত পদক্ষেপে আসছিল। তখন আমরা দাঁড়িয়ে চিৎকার করে `জয় বাংলা` শ্লোগান দিতে থাকি।

আমার একহাতে বন্দুক, আরেক হাতে দেশের পতাকা নিয়ে বলছি জয় বাংলা। লোকগুলো যখন আমাদের দেখলো তখন তারা পজিশন নিয়ে নিচ্ছিল। কেউ শুয়ে, কেউ বসে যাচ্ছিল। আমি কিন্তু চিৎকার করতে করতে সামনে গেলাম। তাদের মধ্যে প্রথম লোকটি সাদা গোফ, অনেক বয়স্ক একজন সৈন্য সে আমাকে বলে-` সিয়ার কো বাচ্চা তুম লোক বি হাতিয়ার রে লিয়া ইয়ে মুলক আজাদ হয়া।`

এটা ছিলো তার প্রথম অভিব্যক্তি। সেই অফিসারের নাম হারুন আহমেদ চৌধুরী। সে ক্যাপ্টেন ছিল। সে আমাকে বলে তুমি কে? বললাম আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। সে বলল তোমাদের সঙ্গে কি বঙ্গবন্ধুর যোগাযোগ আছে? তখন আর কি বলব? উপায় না পেয়ে বললাম হ্যাঁ আছে। তাহলে এই খবরটা ওনাকে দাও যে, ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট স্বাধীনতার প্রশ্নে রি-বোল্ট করেছে। আকাশে তখন পাকিস্তানি একটা প্লেন উড়ছিল। মেজর মীর শওকত আলী বললেন, এখানে আমাদের থাকা নিরাপদ না। তুমি আমাদেরকে পাহাড়ের দিকে পাঠিয়ে দাও। তখন তাদেরকে কোড়ল দাঙ্গা পাহারের দিকে পাঁঠিয়ে দিই। ২৬ মার্চ বিকেলে এদেরকে খুঁজতে খুঁজতে বোয়ালখালির দিকে এলো কিছু আওয়ামী লীগ নেতা।

ইটিভি অনলাইন : ৭ মার্চের ভাষণ এবং আমাদের স্বাধীনতা এক সুত্রে গাঁথা। অথচ এদেশে ক্রমাগত ইতিহাস বিকৃতি ঘটছে। আবার ইতিহাস বদলের কোনো আশঙ্কা আছে কিনা?

মঈন উদ্দীন খান বাদলঃ যারা এখনও বাংলাদেশে মুজিবের দর্শন মানে না, স্বীকৃতি দেয় না স্বাধীনতার প্রশ্নে বিতর্ক জুড়ে দেয় তাঁদের আমি অনায়াসে বলতে পারি- তাঁদের ঠিকানা ওই দূর পাকিস্তান। পাকিস্তানের প্রেতাত্মাদের এই বঙ্গে থাকার অধিকার নাই। বঙ্গবন্ধুর নির্ধারিত পথে, যে পথে স্বাধীনতার রবি উদিত হয়েছে, সেই ধারাকে যারা ক্রমাগত অশ্রদ্ধা করে,  অস্বীকার করে এই বাংলাদেশে তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। সেটা বাঙালি জাতির খতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

মুক্তিযুদ্ধ তো নিছক কোনো সামরিক অভ্যুত্থান কিংবা বিদ্রোহ ছিল না। এটা গণমানুষের সংগ্রাম। যেখানে গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রয়েছেন, সেখানে জিয়া কোথা থেকে এসে নিজেকে যুদ্ধের প্রধান দাবি করলেন? তখন তার ড্রাফটা পরিবর্তন করে নতুন করে লেখা হলো। সংশোধিত দ্বিতীয় লেখাটি বারবার প্রচার হয়েছে। যা আমাদের জাদুঘরেও সংরক্ষিত আছে। মুক্তিযুদ্ধের ঊষালগ্নে আমি যা বলেছি ঘটনাটি ঠিক এ রকমই। সংসদে এ নিয়ে বহুবার বক্তব্য রেখেছি। ঘোষণা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক করার কোনো অবকাশ নেই। যদি কেউ করেন সেটা অন্যায়।

প্রসঙ্গত, আমি বলেছিলাম ১৭ ডিসেম্বর ভোরবেলা মুজিব বাহিনীর লোকাল ফোর্স নিয়ে যুদ্ধ করে বেতারকেন্দ্রটি মুক্ত করি। সে সময় আমি ঘোষণা করি `বাংলাদেশ স্বাধীন, চট্টগ্রাম স্বাধীন। আমাদের নেতা শেখ ফজলুল হক মনি অবিলম্বে আমাদের মাঝে এসে পৌঁছাবেন।

সামনে একটা বেতার কেন্দ্র ছিল বিধায় ঘোষণা দিতে পেরেছিলাম। আর এজন্য জাতির কাছে প্রত্যাশা করতে পারি না যে, আমি জাতির চাচা হয়ে গেলাম। আমি বলছি যে, এই রকম ঘোষণা ১৭ ডিসেম্বর ভোর বেলায় আমি মঈন উদ্দীন খান বাদলও দিয়েছিলাম। তাহলে জিয়া কীভাবে স্বাধীনতার ঘোষক? সেদিন মেজর জলিল ছিলেন, খালেদ মোশাররফ ছিলেন, সি আর দত্ত, সফিউল্লাহ,  মীর শওকত আলী গর্জে উঠেছিলেন। সুতরাং প্রশ্নটা হল, আপনি (জিয়াউর রহমান) ডিক্লেয়ার করলেন কেন?

একুশে টিভি অনলাইন : আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ সময় দেওয়ার জন্যে।

মাইন উদ্দিন খান বাদল : আপনাকে ও ইটিভির সবাইকে ধন্যবাদ।

‘‘মঈন উদ্দীন খান বাদল দেশের একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও সুবক্তা হিসেবে পরিচিত। একাত্তরের বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের সাহসী ছাত্রনেতা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। একই সঙ্গে তিনি ছাত্রলীগকে নেতৃত্ব দেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তিনি ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ছাত্রসমাজকে সেই সময় মুক্তির চেতনায় উদ্ধুদ্ধ করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করে লাল সবুজের পতাকা ছিনিয়ে আনেন। স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগের কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পরেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। পরে মঈন উদ্দীন খান বাদলসহ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছাত্রলীগের একটি অংশ ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর গঠন করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। বর্তমানে সেই দলটির একাংশের কার্যকরী সভাপতি এবং জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন দেশের প্রবীণ এই রাজনীতিক।’’

/ এআর /

 

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি