ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

দুই জার্মান এক হওয়ার ৩০ বছর আজ

হাবিবুর রহমান 

প্রকাশিত : ১১:৫৮, ৩ অক্টোবর ২০২০ | আপডেট: ১২:০৮, ৩ অক্টোবর ২০২০

৭৫ বছর আগে মানবসভ্যতার ইতিহাসে এযাবৎকালের ভয়াবহতম সংঘাতের নাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জার্মানির নাৎসি বাহিনীর আক্রমণে ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত টানা ছয় বছর ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধে সাত কোটির বেশি সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস হয় বহু শহর-নগর-বন্দর-জনপদ। ১৯৪৫ সালের ৮ মে এ যুদ্ধের হোতা অ্যাডলফ হিটলারের আত্মহননের মধ্যদিয়ে ফ্যাসিবাদী জার্মানি আত্মসমর্পণ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ আর মানসিকভাবে বিপর্যয়সহ জার্মান জাতি নিজেদের বিভক্তি কোনো সময় চায়নি। একাধারে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত সারা দেশ, স্বজন হারানোর বেদনা, যুদ্ধ বিজয়ী মিত্রশক্তির হাতে হাজার হাজার বন্দী, যুদ্ধের দায়ভার, তারপর আবার দেশটির বিভক্তি—জার্মান জাতি এসব মানতে পারেনি। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর জার্মানি কার্যত চারটি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যার শাসনভার ন্যস্ত ছিল মিত্রশক্তির চার পরাশক্তি: যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর। বার্লিন শহরটি সোভিয়েত অংশের অন্তর্গত হলেও এটিও চার অংশে বিভক্ত করা হয়। দখলদার রাষ্ট্রগুলোর উদ্দেশ্য জার্মানি শাসন হলেও শীতলযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্র অধিকৃত অংশ নিয়ে গঠন করা হয় ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানি (পশ্চিম জার্মানি)। 

এর বিপরীতে সোভিয়েত অধিকৃত অংশে গঠিত হয় ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব জার্মানি (পূর্ব জার্মানি)। পশ্চিম জার্মানি পরিণত হয় একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে, পূর্ব জার্মানির অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল সোভিয়েত অনুকরণে সাজানো সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি। পশ্চিম জার্মানির অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধায় আকৃষ্ট হয়ে অনেক পূর্ব জার্মান নাগরিক পশ্চিমাংশে চলে যেতে শুরু করে। বিপুল পরিমাণ অভিবাসন ঠেকাতে পূর্ব জার্মান সরকার সিদ্ধান্ত নেয় বার্লিনের পশ্চিমাংশ ও পূর্বাংশের মাঝে একটি দেয়াল তুলে দেয়া হবে। 

পশ্চিম বার্লিনের চারপাশে ১৫৬ কিমি দীর্ঘ এ দেয়ালের ৪৩ কি.মি. সরাসরি দুই অংশকে পৃথক করে। পূর্ব জার্মান কর্তৃপক্ষ প্রাচীর অতিক্রমের চেষ্টাকারী যে কাউকে দেখামাত্র গুলি করার জন্য সীমান্ত প্রহরীদের নির্দেশ দেয়। এভাবেই চলতে থাকে দুই জার্মানির পথ চলা। বার্লিন প্রাচীরের ২৮ বছর ইতিহাসে প্রাচীর অতিক্রম করে পশ্চিম বার্লিনে যাবার প্রায় ৫ হাজারটি ঘটনা ঘটে। তবে প্রাচীর অতিক্রমের ঘটনায় ঠিক কতজন মারা গিয়েছিল তা নিয়ে বিতর্ক আছে।

আশির দশকের শেষে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভের শুরু করা গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রোইকা কর্মসূচির হাত ধরে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে অধিকতর গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলনের ঢেউ লাগে সাবেক পূর্ব জার্মানিতেও। 

বার্লিন প্রাচীরের সামনে দাঁড়িয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভকে উদ্দেশ্য করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগানের বিখ্যাত ভাষণ, এ প্রাচীর ছিন্ন করে ফেলুন! প্রাক্তন পশ্চিম জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট কোহল বলেছেন যে,  যখন তি রোনাল্ড রেগান গর্বাচেভকে বার্লিনের প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলার চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, তখন তিনি রেগনের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন, যা কখনই তিনি ভুলতে পারবেন না।
 
পূর্ব জার্মানির বিভিন্ন শহরে শুরু হয় আন্দোলন, যা বড় হতে হতে নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায়। ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয় বার্লিনকে বিভক্ত করে রাখা ২৮ বছর আগের তৈরি প্রাচীর গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজ। প্রাচীর ভাঙার ধ্বংসযজ্ঞ চলেছিল দুই রাত ধরে। প্রাচীর ভাঙার আনন্দে কেউ হেসেছে, কেউ কেঁদেছে।

৯ নভেম্বর বার্লিন প্রাচীরের পতন থেকে ৩রা অক্টোবর পর্যন্ত ৩২৯ দিন ছিল গোটা প্রক্রিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুনরেকত্রীকরণের বিষয়টি শুধু দুই জার্মানির রাজনৈতিক নেতাদের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল ছিল না। অতীতের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ইউরোপের অনেক দেশে আবার এক জার্মানিকে ঘিরে সন্দেহ ও আশঙ্কা দানা বাঁধছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার ছিলেন সম্পূর্ণ বিরোধী। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া মিতেরঁও একেবারে কোনো উৎসাহ দেখাননি।  সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য বিষয়টি ছিল আরও গুরুত্বপূর্ণ। 

১৯৯০ সালের ১৮ মার্চ পূর্ব জার্মানিতে প্রথম মুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর পূর্ব এবং পশ্চিম অংশ আলোচনার মাধ্যমে পুনঃএকত্রিকরণের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি নিয়ন্ত্রণকারী ৪টি পরাশক্তির প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে এ চুক্তিকে ‘Two Plus Four Treaty’ ও বলা হয়। ১৯৯০ সালের ঘটনাবলীকে একত্রিকরণ নাকি পুনঃএকত্রিকরণ বলা হবে, তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে। 

১৮৭১ সালে প্রথমবার জার্মান একত্রিকরণ হয়েছিল বলে, বার্লিন দেয়াল খুলে দেবার ঘটনাকে অনেকে পুনরেকত্রীকরণ বলে থাকেন। জার্মান রাজনীতিবাদরা তাই একে বলতেই বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করেন। অনেকে এ ঘটনাকে শুধুমাত্র জার্মান ঐক্য (Deutsche Einheit)বলে থাকেন

১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবরের রাতে বার্লিনে রাইশসটাগ (সংসদ) ভবনের উপরের রাতের আকাশে যখন আতশবাজির ফোয়ারা ছড়িয়ে পড়ল, তখন উপস্থিত প্রায় সবারই চোখে আবেগাশ্রু৷ তারা এমন এক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হওয়ার সুযোগ পেলেন, যা শুধু জার্মানি নয়, ইউরোপের অন্যান্য দেশের মানুষও কখনো সম্ভব বলে মনে করেননি।

এক শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের মাধ্যমে সাবেক পূর্ব জার্মানির জনগণ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে ফেলে শাসকদের ক্ষমতা থেকে তাড়িয়ে দেয়। একটিও গুলি খরচ হয়নি, কোনোরকম হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেনি, কারো কোনো ক্ষতি হয়নি। সেই দিন পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি একত্রিত হয়ে জার্মান ফেডারেল প্রজাতন্ত্র গঠন করে। যাহা আজ বিশ্বে জার্মানি হিসাবে পরিচিত। 

লেখক- প্রকৌশলী (জার্মান প্রবাসী)

এআই//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি