সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র উদ্বোধন
প্রকাশিত : ১২:০৯, ২৩ ডিসেম্বর ২০২০
মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে এসে জীবন উৎসর্গকারী অর্ধশতাধিক ভারতীয় সৈনিকের আত্মত্যাগের স্মৃতিরক্ষায় সীতাকুণ্ড উপজেলার চন্দ্রনাথ পাহাড়ে নির্মিত ভাস্কর্য ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র’ উদ্বোধন করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২২ ডিসেম্বর) সকাল ১০টায় ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন ও সীতাকুণ্ডের সংসদ সদস্য দিদারুল আলম।
এ সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বলেন, ‘আজ আমি গর্ববোধ করছি এজন্য যে, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনারা একসঙ্গে এ এলাকায় প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক শুধু ঐতিহাসিক ও সংস্কৃতিগত নয়, এটি রক্তের সম্পর্ক। আমি গভীরভাবে শ্রদ্ধা জানাই সীতাকুণ্ড উপজেলার শহিদ মুক্তিযোদ্ধা ও আত্মোৎসর্গকারী ভারতীয় সেনাদের।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন পাইলট হিসেবে। তাই আমি খুবই গর্বিত।’
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম এ সালাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য দিদারুল আলম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাব্বির ইকবাল। এ সময় উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামে নিযুক্ত ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার অনিন্দ্য ব্যানার্জী, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোহাম্মদ সাহাবউদ্দিন, মহানগর কমান্ডার মোজাফফর আহমদ, ভারতীয় হাইকমিশনারের সহধর্মিণী সংগীতা দোরাইস্বামী, ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি দীপ্তি আলংঘাট।
বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চিরঞ্জীব হবে উল্লেখ করে হাইকমিশনার বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন বাংলাদেশের প্রেরণা। বাংলাদেশের জন্য তার আত্মত্যাগ এদেশের জনগণ ভুলতে পারবে না।’
এর আগে ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে তার বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তারা চট্টগ্রামের ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করেন। মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের অবদান থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতার কথা স্মরণ করেন। তিনি চট্টগ্রামের বিভিন্ন আঞ্চলিক বিষয়ে ভারতীয় হাইকমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তারা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার ও উভয় দেশের জনগণের আস্থা অর্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।
এদিকে সোমবার সন্ধ্যায় মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে ভারতের হাইকমিশনার শ্রী বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশ দুই দেশ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের মতোই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘ভারতের সাব্রুমে ফেনী নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এখানে স্থলবন্দর চালু হলে দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের আরো প্রসার ঘটবে।’
বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাহজাদা সৈয়দ তৈয়বুল বশর মাইজভাণ্ডারীর সভাপতিত্বে দরবার শরিফের হলরুমে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় ফটিকছড়ির চার বারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য আলহাজ সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী, উপজেলা চেয়ারম্যান হোসাইন মো. আবু তৈয়ব, ভারতের সহকারী হাইকমিশনার অনিন্দ্য ব্যানার্জী, পলিটিক্যাল অ্যাটাসে দীপ্তি আলংঘাট, উপজেলা নিবাহী কর্মকর্তা মো.সায়েদুল আরেফিন, হাটহাজারী সার্কেলের অ্যাডিশনাল এসপি আব্দুল্লাহ্ আল মাসুম প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে ১২ ডিসেম্বর থেকে বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় মিত্র বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত বাহিনীর তুমুল সম্মুখযুদ্ধ চলতে থাকে। যুদ্ধ করতে করতে ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা সীতাকুণ্ডের কুমিরায় পৌঁছান। এতে পিছু হটে পাকিস্তানি বাহিনী। ওই দিন বিকেলে বিজয়ের ঘোষণা আসলে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় উল্লাস শুরু করেন। কেউ কেউ নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যান। ঠিক এমনি সময়ে অপ্রস্তুত অবস্থায় থাকা ভারতীয় সেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায় পাকিস্তানিরা। এতে সীতাকুণ্ডে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধ চলে ১৭ ডিসেম্বর রাত পর্যন্ত। এই দীর্ঘ সময়ের টানা যুদ্ধে নিহত হন অর্ধশতাধিক ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সৈনিক ও বেশ ক'জন মুক্তিযোদ্ধা। তাদের আত্মত্যাগে ১৭ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় সীতাকুণ্ড। সে সময় এসব ভারতীয় মুক্তিবাহিনীর বীরদের মৃতদেহ সৎকার করা হয় সীতাকুণ্ড পৌরসদর চন্দ্রনাথ মহাতীর্থের গজারিয়া দীঘির পাড়ে।
সেই বীরত্বগাথার স্মৃতি জাগরূক রাখতে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ এ সব মিত্র বাহিনীর বীরদের স্মৃতিরক্ষায় চন্দ্রনাথ ধাম মহাতীর্থের সীতা দেবীর কুণ্ডের ঠিক ওপরে হনুমান মন্দিরের সামনে ২৩ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র’ নামক এ ভাস্কর্য।
এসএ/