হে স্বাধীনতা তিষ্ঠ চিরকাল
প্রকাশিত : ১০:৪৪, ২৬ মার্চ ২০২১
অতিমারির কারণে গত বছর জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ উত্সব সব প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও উদ্যাপন করা যায়নি। দুঃখভারাক্রান্ত হয়েছে গোটা জাতি। অতিমারির কারণে গত এক বছরে হারিয়েছি অনেক প্রিয়জন। এ যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। তবু জীবন থেমে থাকেনি। অতিমারিতে যতটা ক্ষতির শঙ্কা ছিল, ততটা ক্ষতি হয়নি। জীবনহানির পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ভয়াবহ ক্ষতির সম্ভাব্যতা নিয়ে বিজ্ঞজনেরা যা বলেছেন, ততটা হয়নি। কাকুনুস অথবা স্ফিংস পাখির মতো আমরা বছরান্তে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। জাতীয় ও আন্তর্জতিক ক্ষেত্রে যোগাযোগ প্রক্রিয়াও চলমান থেকেছে। ভার্চুয়াল মাধ্যমে জাতি শিখেছে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও গণমাধ্যমকে কীভাবে সচল রাখা যায়। ডিজিটাল বাংলাদেশ সফল করার হাতে কলমে শিক্ষাটা বলতে গেলে ভালো হয়েছে। অতিমারির প্রকোপ কমে আসায় মুজিববর্ষ পালনের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে একুশ সালের ডিসেম্বর অবধি। একই সঙ্গে স্বাধীনতার ৫০ বছর উদ্যাপনের নানা কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে।
কর্মসূচি শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ১০১তম জন্মদিনে। শেষ হবে মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে। অর্থাত্, ছাব্বিশে মার্চে। এই গৌরবের উত্সব পালনে বাংলাদেশের পাশে এসেছেন প্রতিবেশী বন্ধুরা। নিজ দেশের শুভেচ্ছা নিয়ে প্রতিবেশী দেশের সরকারপ্রধানেরা বাংলাদেশের জনগণের মনে গুঁজে দিচ্ছেন ভালোবাসা সৌহার্দ ও সম্প্রীতির পূতমন্ত্র। বন্ধুর তালিকায় রয়েছে মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও ভারত। আর শুভবাণী পাঠিয়েছে কানাডা, ফ্রান্স, জাপান, চীন, জর্দানসহ অনেক বন্ধুদেশ। ধন্য জাতি ধন্য, মুজিব তোমার জন্য।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের আনন্দোত্সবে কেবলই স্মৃতিকাতর হই। একাত্তরের ২৫শে মার্চের রাতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরীহ বাঙালির ওপর অতর্কিতে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেতে ওঠে গণহত্যাযজ্ঞে। সেদিনের অবিসংবাদিত নেতা বীর বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখিত ঘোষণায় স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশ নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন সমস্ত বাঙালিকে সেই কালরাতে। অবশ্য এর আগে মার্চের সাত তারিখেই ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিকামী লাখো মানুষের সামনে তিনি ঘোষণা করেছিলেন অমর কাব্যের অসাধারণ ও অর্থবহ দুই পঙিক্ত, যার গভীরে স্পষ্টতই নিহিত ছিল স্বাধীনতা ও মুক্তির বার্তা। এমনকি জনযুদ্ধের প্রস্তুতি এবং কৌশল সম্পর্কেও তিনি তার ঐতিহাসিক বক্তব্যে পরিষ্কার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। দেশ-বিদেশের মানুষের বুঝতে মোটেও অসুবিধা হয়নি রাজনীতির কবির সেদিনের ভাষণের মর্মবাণী। আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে চুয়ান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে ধ্বনিত হয়েছিল ‘জয় বাংলা’। তারপর নয় মাস জুড়ে পিশাচ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে বীর বাঙালির রণধ্বনি ছিল এই ‘জয় বাংলা’। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এই অমোঘ জয়ধ্বনিরও সুবর্ণজয়ন্তী। বঙ্গবন্ধু এই জয়ধ্বনি উচ্চারণ করে পঞ্চাশ বছর আগে স্বাধীনতার যে আগুন জ্বেলেছিলেন, তা আজো সমান উজ্জ্বল এবং আমাদের সব অর্জনের সব যাত্রার বাতিঘর।
পঞ্চাশ বছর আগে ছিলাম এক পূর্ণাঙ্গ যুবক। সবল বাহু, দৃপ্ত পদ, চোখে প্রতিশোদের আগুন, বুকে সাহস। আর ছিল মুক্তির স্বপ্ন। ছিল আস্থা। তারপর কেটে গেছে পঞ্চাশটি বছর। আজ ‘আয়না দিয়া চাইয়া দেখি পাকনা চুল’। কিন্তু স্মৃতি একটুও ধূসর হয়নি।
চেতনা বিন্দুমাত্র মলিন হয়নি। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কাছে শেখা মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও আস্থায় এক ফোঁটাও চিড় ধরেনি। পার হয়ে আসা পঞ্চাশ বছরের পথচলা সব সময় সুখের ছিল না। আঘাতের পর আঘাত এসেছে। এসেছে সবকিছু তছনছ করে দেওয়া তীব্র ঝড়। সব অর্জন ভাসিয়ে নিতে এসেছে উত্তাল তীব্র জলস্রোত ও ঢেউ। পঁচাত্তরের মধ্য আগস্টে ঘটে যাওয়া জাতির ইতিহাসের ভয়াবহতম নৃশংস ঘটনার পর ধরেই নেওয়া হয়েছিল, ভেঙেচুরে যাওয়া বাঙালি আর কখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। ধরে নেওয়া হয়েছিল, দেশটা নিশ্চিতভাবে ফের পাকিস্তান হয়ে গেল। ‘জিন্দাবাদের’ নিষ্পেষণে ‘জয় বাংলা’ বুঝি চিড়ে চ্যাপ্টা চিরতরে। বুঝি সমাপ্তি ঘটল বাঙালি জাতিসত্তার সবকিছুর। যে জাতিসত্তার দর্শনে মিশে থাকে অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতা আর সৌহার্দ-সম্প্রীতির পবিত্র নির্যাস। আবহমান বাংলার যা কিছু গৌরবের, অহংকারের, তার ওপর চলল পরিকল্পিত আঘাত। সবচেয়ে নিষ্ঠুর আঘাত এলো বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতির সব শুদ্ধ ধারার ওপর। হাজার বছরের গর্বের ধন অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিনষ্টে হাতে হাতে তুলে দেওয়া হলো সাম্প্রদায়িকতার গরল। শিক্ষায়, সামাজিকতায়, লোকায়ত সংস্কৃতিচর্চার বদলে শুরু হলো আবার পরিত্যক্ত ও বিবর্জিত ভাবধারা আর মতবাদের নোংরামি ও খিস্তিখেউর। সে যেন ধ্বংসযঞ্জের এক নারকীয় মহোত্সব। অন্যায়, অশুভ ও মিথ্যাচারের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে তখন বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
যে বীর বাঙালি একাত্তরে জীবন বাজি রেখে অস্ত্র ধরেছিল, ঘর ছেড়েছিল, তার জন্য পঁচাত্তরের মধ্য আগস্টের ধাক্কাটা এতই প্রচণ্ড ছিল যে সম্বিত্ ফিরে পেতে অনেকটা সময় পার। তারপর যখন কৃষি, শিল্প থেকে শুরু করে রেডিও-টেলিভিশন এবং শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমাজ সব ক্ষেত্রে অশুভের স্টিমরোলার চালানো হলো সর্বদা, তখন বিশাল এক অন্ধকার টানেলের ভেতরে ঢুকে গেছে দেশ এবং সমাজ। সর্বভুক ক্ষমতাধরের দল মুড়িমুড়কির মতো চিবিয়ে খেতে শুরু করল মূল্যবোধ, বিবেক, আদর্শ, শিষ্টাচার, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি গৌরবের সব শুভ চিহ্ন। তখনকার প্রতিটি সকাল ছিল অমাবস্যার মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন। দেখেশুনে মনে হচ্ছিল অন্ধকার টানেলের শেষে কোনো দিন একটুও আলো দেখা যাবে না। এরকম অসহায়ত্ব আর কোনো জাতি বা সমাজ কখনো অনুভব করেছে কি! কবি শামসুর রাহমান লিখলেন ‘অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’। সেই সময় কষ্ট পেলেও মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছিলাম যে মরা গাঙে কখনোই বুঝি আর আগের মতো জোয়ার আসবে না, ফুটবে না মুক্তিযুদ্ধের সৌরভমাখা স্বর্ণচাঁপার দল। ভাবতাম, আর কখনোই বুঝি গেয়ে কলকল হেসে খলখল তালে তালে সবাইকে নিয়ে তালি দিতে পারব না। তবে মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাইনি, বাঙালির সহজাত আত্মশক্তির ওপর আস্থা হারাইনি। নিবু নিবু প্রদীপের মতো একটু হলেও স্বপ্ন জাগিয়ে রেখেছি এবং সবশেষে তার ফলও মিলেছে।
অনেক চড়াই-উত্রাই, সংঘাত, ষড়যন্ত্র, দোলাচল পার হয়ে দেশটা আবার ফিরেছে মুক্তিযুদ্ধের ট্র্যাকে। দেশটা আজ কী ভীষণ রৌদ্রকরোজ্জ্বল! এটাই হচ্ছে সত্যিকারের বাঙালি চরিত্র। যতই আত্মঘাতী হোক, যতই যড়যন্ত্রপ্রিয় হোক, যতই আবেগী হোক, এই জনপদের মানুষ স্ফিংস পাখির মতো ঠিকই জেগে ওঠে। শিরদাঁড়া শক্ত করে সটান দাঁড়ায় বীরের ভঙ্গিতে। অবশ্যই সেটা প্রয়োজনের সময় এবং দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে। নিকট অতীতে তার শ্রেষ্ঠতম প্রমাণ একাত্তর। মার্চের পঁচিশ থেকে পরবর্তী নয় মাস পাকিস্তানি সেনা ও তাদের স্থানীয় দালালদের নির্মমতা, বর্বরতা ও পাশবিকতার কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির যখন মৃত্যুর বিভীষিকা নিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে দেশান্তরী হয়েছিল, তখন পালটা আঘাত ছাড়া অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল কি? কেবল মৃত্যু, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, আগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরিতকরণ নয়; পাকিস্তানিরা শকুনের মতো খামচে ধরেছিল বাঙালির হূদয়। সেই হূদয় হচ্ছে বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতা। অর্থাত্, একাত্তরে বাঙালি জাতিসত্তার ধ্বংস অনিবার্য ছিল, যদি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বীর বাঙালি ঐক্যবদ্ধভাবে প্রত্যাঘাত না করত। বাংলার হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ একাত্তরে যেভাবে দেশ বাঁচাতে এক জাতিতে পরিণত হয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। সব ধর্মের মানুষের মিলিত রক্তস্রোতের ভেতরেই অর্জিত হয়েছিল কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। মাত্র নয় মাসে ত্রিশ লাখ মানুষের জীবনদান, প্রায় পাঁচ লাখ নারীর সম্ভ্রমহানি, প্রায় কোটি মানুষের দেশান্তরী হওয়া বিশ্ব ইতিহাসে আর কোথাও দেখা যাবে না। তাই শিল্পীর কণ্ঠে যখন উচ্চারিত হয় ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’, তখন এর চেয়ে সত্য আর কী হতে পারে!
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে যদি ফিরে দেখা যায় ফেলে আসা দিনগুলো, তবে স্বীকার করতেই হয় যে বাংলাদেশ আজ শুধু লুণ্ঠিত গৌরবই ফিরে পায়নি, আলাদা এবং নতুন এক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। এই যে অবাক বিস্ময়ে বিশ্ববাসী সম্মানের সঙ্গে আমাদের দেখছে, তা বোধ হয় একসময় কেউ চিন্তাও করেনি। নিজস্ব অর্থয়নে বিশাল সেতু নির্মাণ, কোন কালে কে ভেবেছে? মেট্রোরেল, আধুনিক প্রশস্ত সড়ক দিয়ে সমস্ত দেশকে যুক্ত করা কিংবা সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণ—এসব তো স্বপ্নেরও অতীত ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধি, গৃহহীনের জন্য বাড়ি, শিশু-কিশোরের হাতে বছরের শুরুতে বিনা মূল্যে বই-খাতা উপহার দেওয়া, লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়া ইত্যাদি স্বাধীনতার শুবর্ণজয়ন্তী উদাহরণের আনন্দকে বাড়িয়ে দেয় না কি? মহাশূন্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গর্বের একুশে ফেব্রুয়ারির স্বীকৃতিসহ অজস্র অর্জন সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশে অনেক বাধাবিপত্তি ও ষড়যন্ত্র পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্র্যাকে ফিরেছে বলেই। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বমাঝে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দারিদ্র্য! সে তো ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ এক পুরোনো শব্দ। ঘরে ঘরে স্বাস্থ্যসেবা ও যোগাযোগ প্রক্রিয়ার আধুনিকায়ন এবং তৃণমূল পর্যায়ে তার সেবা পৌঁছানো—এটা তো রীতিমতো অসাধ্য সধন।
হিসাবের খাতা হাতে নিলে দেখতে পাই কেবলই অর্জনের খতিয়ান। অথচ দেশটা যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংসকারীদের হাতে চলে গিয়েছিল, তখন কল্পনাও করা যেত না বাংলাদেশ আবার নবজীবনের বিজয়কেতন ওড়াতে পারবে। আজও সব অর্জনের পরও যখন দেখি দেশে-বিদেশে বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের ক্ষতিকর খেলা, তখন বিচলিত হই সত্য। তবে এ-ও জানি যে, এটা শেষ সত্য নয়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শ্রদ্ধা জানাই মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সব শহিদকে। শ্রদ্ধা জানাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যিনি না জন্মালে এই ছোট্ট ভূখণ্ডে স্বাধীনতা শব্দটি অধরাই থেকে যেত।
লেখক : আহ্বায়ক, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।