ঢাকা, শুক্রবার   ১৫ নভেম্বর ২০২৪

আত্মসমর্পণের পথে পাকিস্তানি সেনা

শত্রুমুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ

শেখ সাদী

প্রকাশিত : ০৮:৫২, ১১ ডিসেম্বর ২০২১

আজ ১১ ডিসেম্বের। সারাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যরা মার খাচ্ছে। তাই, একের পর এক এলাকা শত্রুমুক্ত হচ্ছে। শত্রুমুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ।     

বোমার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত ঢাকা বিমানবন্দর পরির্দশনে এসে লে জে নিয়াজি বললেন,‘কোনক্রমেই শত্রুকে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া চলবে না। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের ঐতিহ্যকে আরো উজ্জ্বল করবে।’ 

ওদিকে যুদ্ধবিরতির জন্য প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জাতিসংঘ সদর দপ্তরে জরুরি বার্তা পাঠালেন।

গভর্নরের পক্ষে পাঁচটি শর্তে আত্মসমর্পণের কথা জানালেন রাও ফরমান । এই তথ্য প্রকাশ করলো সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক ক্লোয়ার হোলিংওয়ার্থ।  এই শর্ত পাঁচটি হলো,-

১। পাকিস্তানি বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করবে।
২। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কোন চুক্তি করবে না পাকিস্তান।
৩। পশ্চিম পাকিস্তানের এক লাখ নাগরিককে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত যেতে দিতে হবে।
৪। পাকিস্তানি সৈন্যদের পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে দিতে হবে। 
৫। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে।

এসব প্রস্তাব নাকচ করে করলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। বরং এখনো যুক্তরাষ্ট্রকে মার-খাওয়া পাকিস্তানকে অস্ত্র সহায়তার অনুরোধ জানান।

ইয়াহিয়ার অনুরোধের প্রতি কোন সমর্থন জানালেন না নিক্সন। দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছেন। কপালে চওড়া হচ্ছে হতাশার ভাঁজ। তবে মার্কিন প্রতিনিধি সাধারণ পরিষদের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেয়ার জন্য বললেন ইয়াহিয়া খানকে।

আর; হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র রোনাল্ড জিগলার বললেন, ‘জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব মেনে নেওয়া ভারত-পাকিস্তান উভয়ের জন্যই আবশ্যক। এবিষয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন।’


জাতিসংঘের অনুরোধে বিদেশি নাগরিকদের ঢাকা ছাড়ার জন্য কুর্মিটোলায় সাময়িক বিমান হামলা বন্ধ রাখে মিত্রবাহিনী। ওদিকে মার্কিন সপ্তম নৌবহর দ্রুত এগিয়ে আসছে।

আর, মহাশক্তিধর এই নৌবহরকে রুখতে এগিয়ে যাচ্ছে বিপদে পড়া বাঙালির পাশে এসে দাঁড়ানো মিত্রবাহিনী। 

এদিকে মৌলভীবাজার আর নরসিংদী শত্রুমুক্ত করলো মুক্তি-মিত্রবাহিনী। 

দেশের অধিকাংশ থানায় উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।  হিলি সীমান্তে যৌথবাহিনী প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। 

সন্ধ্যায় বগুড়া-রংপুর মহাসড়কে গোবিন্দগঞ্জে হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটিতে আক্রমণ করে মুক্তি-মিত্রের দল। 

সারারাত যুদ্ধ শেষে ভোরে গোবিন্দগঞ্জের পতন ঘটে পাকিস্তানি সেনার।  বৃষ্টির মতো চলেছে গুলি। চলছে বোমা বিস্ফোরণ। টিকতে পারেনি হানাদার পাকিস্তানি সৈন্য। সকালে সূর্য ওঠর আগেই আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়।

পাকিস্তানি সেনার পতন ঘটে জামালপুর, ময়মনসিংহ, গাইবান্ধা, চণ্ডীপুর, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, ফুলছড়িহাট ও বাহাদুরাবাদ ঘাট এলাকায়। একাত্তরের এই দিনে মুক্ত হয় অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অন্তত ১২টি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। মুক্তি-মিত্রবাহিনীর ছয় দিনের প্রচণ্ড যুদ্ধের পর ভোরে শত্রুমুক্ত হয় জামালপুর। 

শত্রুমুক্ত হলো মুন্সিগঞ্জ, আশুগঞ্জ, কুমিল্লার লাকসাম, টাঙ্গাইল ও দিনাজপুরের হিলি। 

গত কয়েকদিন ধরেই টাঙ্গাইলে চলছে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ। আজ উত্তপ্ত টাঙ্গাইলে মিত্রবাহিনীর সাতশো সৈন্য প্রবেশ করে। 

এই প্রবেশের সময়েই যুদ্ধ হলো পাকিস্তানি ব্রিগেড বনাম মিত্রবাহিনী। সাথে থাকলেন মুক্তিযোদ্ধারা। যুদ্ধে দুই পক্ষের বহু হতাহত। 

মুক্তি-মিত্রের প্রবল আক্রমণে জামালপুর গ্যারিসনে অবস্থান নেয়া পাকিস্তানের ২১ বেলুচ রেজিমেন্টের ছয়জন অফিসার ও ৫২২ জন সেনা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। খতম হয় ২১২ জন পাকিস্তানি সেনা। আহত অন্তত দুইশো জন। 

এদিকে শত্রুমুক্ত যশোরের জনসভায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। 

১। বাংলাদেশ সরকার ওয়ার ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। এ ট্রাইব্যুনাল নরহত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে যুদ্ধবন্দীদের বিচার করবে। 
২। ২৫ মার্চের আগে যিনি জমি ও দোকানের মালিক ছিলেন তাদের সব ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
৩। সব নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে।
৪। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি, নেজামে ইসলামী নিষিদ্ধ করা হবে। 

গুরুত্বপূর্ণ এসব সিদ্ধান্ত ঘোষাণার সময় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, ‘ইয়াহিয়া খান বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা তা পারলো না। এই শিশুরাষ্ট্রকে গড়ে তোলার দায়িত্ব এই দেশের প্রতিটি নাগরিকের।’ 

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘ভারতের সাথে আমাদের সকল সম্পর্ক পরষ্পরের সার্বভৌম ও স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখেই।’

বিকেলের জনসভার পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বসলেন যশোর সার্কিট হাউসে। এখানে সাংবাদিকদের দুজন একই প্রতিশ্রুতির কথা বললেন, ‘আমরা তাড়াতাড়ি সংবিধান রচনা করবো, যা ২৪ বছরেও পাকিস্তান করতে পারেনি।’

শেখ সাদীঃ লেখক ও গবেষক

এসবি/ 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি