বর্ষপূর্তিতে স্মরণে একুশে পরিবারের প্রয়াতরা
প্রকাশিত : ১১:৪৬, ১৪ এপ্রিল ২০২২ | আপডেট: ১১:৫৪, ১৪ এপ্রিল ২০২২

বাংলাদেশে টেলিভিশন সম্প্রচারে অনেক নতুনের পথ দেখানো একুশে টেলিভিশন। আর এই পথচলায় যারা ছিলেন আলোর দিশারী তাদের অনেকেই এখন প্রয়াত। গুণী এসব মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই টেলিভিশন পেয়েছে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। একুশে টেলিভিশনকে স্বপ্নের পথে তুলে দিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমানো মানুষগুলো সবসময়ই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
এ এস মাহমুদ
সূচনালগ্নে একুশের পর্দায় যাদের দেখা যেত, তারা রাতারাতি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন দর্শক মহলে। দর্শকরা তাদের কাজ দিয়েই মূলত মূল্যায়ণ করেছেন একুশে টেলিভিশনকে। তবে এই ফ্রেমের পেছনে পুরো কর্মযজ্ঞের কেন্দ্রবিন্দুতে যিনি ছিলেন তিনি একুশে টেলিভিশনের সম্মানিত চেয়ারম্যান এ এস মাহমুদ।
বেসরকারি টেলিভিশন একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বটে কিন্তু সামাজিক দায়বোধ এড়িয়ে কেবলই ব্যবসা নয়, সেই নীতিতে অটল ছিলেন শিক্ষিত, মার্জিত, সুরুচিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের এই মানুষটি।
স্বদেশি অনুভূতির মালা গেঁথে বাংলাদেশের ভেতরটা দেখাতে চেয়েছিলেন সারাবিশ্বকে।
একুশে টেলিভিশনের আনন্দ, সংকট, বিপর্যয়ে যখনই তিনি সহকর্মীদের নিয়ে কথা বলতেন, তার একমাত্র অবলম্বন ছিল কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এ এস মাহমুদের পুরো নাম আবু সাইয়িদ মাহমুদ। তার জন্ম ১ নভেম্বর ১৯৩৩।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ছিলেন তিনি। সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভান্স ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম এবং অ্যাডভান্স মার্কেটিং ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে স্নাতকোত্তর।
তার পেশাদার জীবন শুরু হয় ১৯৫৭ সালে, বহুজাতিক তেল কোম্পানি শেল-এ যোগদানের মাধ্যমে। পেশাগত জীবনে ব্যাংকসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে জড়িত ছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালের ১৫ মার্চের পর তাকে নির্দেশ দেওয়া হয় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে তেল দিতে। তিনি তা দিতে অস্বীকার করেন এবং পরিবার নিয়ে লন্ডনে চলে যান।
২০০২ সালের ২৯ আগস্ট একুশে টেলিভিশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও তার গন্তব্য ছিল সেই লন্ডন। ২০০৪ সালের ২২ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন স্বপ্নবাজ আবু সাইয়িদ মাহমুদ।
সায়মন ড্রিং
বেসরকারি টেলিভিশন হিসেবে একুশে টেলিভিশনের বীজ বপণ হয় যখন, তখন শুরুতেই ডাক পড়েছিল ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিংয়ের। কারণ বাংলার সাথে তার বন্ধন বাংলার জন্মলগ্ন, সেই মুক্তিযুদ্ধ থেকেই।
১৯৭১ সালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহ করেছেন। থেকেছেন মুক্তিযুদ্ধকামী মানুষের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে।
সে সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের বহু নেতার সঙ্গে তার পরিচয় হয়, সখ্যতাও গড়ে ওঠে।
পরে বিভিন্ন চড়াই-উৎরাইয়ের পর মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহ করে ব্রিটিশ হাই কমিশনের সহায়তায় ঢাকা ছাড়েন সায়মন।
এরপর ১৯৯৭ সালে সায়মন কর্মরত ছিলেন বিবিসিতে। সেই চাকরি ছেড়ে একুশে টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন।
সে সময় টেলিভিশনের লাইসেন্স পাওয়া থেকে শুরু করে টেস্ট ট্রান্সমিশন পর্যন্ত পুরো কর্মযজ্ঞে অক্লান্ত পরিশ্রম ছিল তার।
২০২১ সালের ১৬ জুলাই রোমানিয়ার একটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করার সময় মারা যান সায়মন ড্রিং।
মিশুক মুনীর
মিশুক মুনীর। পুরোনাম আশফাক মুনীর চৌধুরী। বাংলাদেশের টেলিভিশন সাংবাদিকতার রূপকার, বিশিষ্ট চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর (১৯৭৯-১৯৮৩) পাস করেন। পরে সেই বিভাগেই শিক্ষকতা করেন।
তিই প্রথম ১৯৯৭ সালে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ‘ভিডিও জার্নালিজম কোর্স’ এর সূচনা করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে পুরোদস্তুর সাংবাদিকতায় যুক্ত হন।
মিশুক মুনীর ১৯৯৯ সালে একুশে টেলিভিশনের প্রথম যাত্রায় হেড অব নিউজ অপারেশনের দ্বায়িত্ব নিয়ে দেশে আন্তর্জাতিক ধারার টেলিভিশন সাংবাদিকতার জন্ম দেন। ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের বার্তা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০০২ সালে দেশের গণ্ডি ছাপিয়ে সরাসরি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখেন মিশুক মুনীর। আফগানিস্তানে চিত্রায়িত প্রামান্য চিত্র রির্টান টু কান্দাহারের প্রধান চিত্রগ্রাহক ছিলেন তিনি।
সর্বশেষ ২০১০ সালে এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন তিনি।
১৯৫৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর নোয়াখালী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর মেজ সন্তান মিশুক মুনীর।
আর ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় প্রখ্যাত এই সাংবাদিকের।
খালেদ খান
বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে ‘যুবরাজ’খ্যাত অভিনেতা খালেদ খান ১৯৫৭ সালের৯ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে।
তিনি অভিনয় শুরু করেন আশির দশকে, মঞ্চনাটকের মাধ্যমে। হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক নাটক 'এইসব দিনরাত্রি' ও ইমদাদুল হক মিলনের 'রূপনগর' নাটকে অভিনয় জনপ্রিয়তা পান গুণী এই শিল্পী।
১৯৯৭ সালে বেক্সিমকো ফার্মার ইনচার্জ হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। এরপর ২০০১ সালে একুশে টেলিভিশনের জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন। এরপর ২০০৫ সালে বেঙ্গল গ্রুপের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। সব শেষ ২০০৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পান।
দীর্ঘদিন মোটর নিউরনে ভুগে ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর মাত্র ৫৭ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে যান খালেদ খান।কণ্ঠশিল্পী মিতা হক তার স্ত্রী। এই দম্পতির কন্যা জয়িতাও সঙ্গীতের সাথেই জড়িত।
মামুনুর রশিদ
একুশে টেলিভিশনের উদীয়মান সাংবাদিক ছিলেন প্রধানমন্ত্রী বিটের রিপোর্টার মামুনুর রশীদ।
নটরডেম কলেজ থেকে ২০০৩ সালে মানবিক বিভাগ থেকে কৃতীত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করেন মামুন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। সেখান থেকে ২০০৭ সালে স্নাতক ও ২০০৮ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর একই বছর যোগ দেন দৈনিক জনকণ্ঠে।
প্রথম দিকে সাধারণ বিটে কাজ করলেও খুব অল্পদিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, সচিবালয়সহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিটের সঙ্গে পরিচিত হন। জনকণ্ঠে এক বছর থাকার পরই যোগ দেন টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনে। পাঁচ বছর পর সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন এশিয়ান টেলিভিশনে।
এর কিছুদিন পরই একুশে টেলিভিশনে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন মামুনুর রশিদ।
একুশে টেলিভিশনে যোগ দেওয়ার পর থেকেই নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছিলেন মামুন। মামুন স্বপ্ন দেখতেন নিজেকে একদিন সাংবাদিকতার দিকপাল হিসেবে গড়ে তুলবেন। দেশের সংবাদ ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়ারও স্বপ্ন দেখতেন প্রয়াত এই সাংবাদিক।
মামুন বেড়ে উঠেছেন নড়াইলের লোহাগারা উপজেলার তেলকারা গ্রামে।
২০১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মামুনুর রশীদ।
আবদুর রহমান
২০২১ সালের ১২ এপ্রিল রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারান একুশে টেলিভিশনের অফিস সহকারী আবদুর রহমান বাবুল।
আবদুর রহমান বাজার করার উদ্দেশ্যে ওই দিন রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটছিলেন। সে সময় একটি মালবাহী ট্রেন উল্টোপথে পেছনের দিক থেকে এসে তাকে ধাক্কা দেয়। এতে কাটা পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা।
তিনি ২০১৬ সালের জানুয়ারী মাসে একুশে টেলিভিশনে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন।
রিফাত রাজ্জাক
একুশে টেলিভিশনের ফ্রন্ট ডেস্ক এক্সিকিউটিভ রিফাত রাজ্জাক। ২০২১ সালের ৬ আগস্ট রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার। মৃত্যুকালে ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন তিনি। প্রসবকালীন জটিলতায় তার মত্যু হয়েছিল। তার গ্রামের বাড়ী পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলায়।
আব্দুর রউফ
রাজধানীর ইন্দিরা রোডের বাসায় ২০১৬ সালের ৬ জুন সোমবার সকাল ৭টার দিকে হৃদরোগে মারা যান একুশে টেলিভিশনের ক্যামেরাপারসন আব্দুর রউফ। তার গ্রামের বাড়ি বগুড়ার ধুনটে।
মাত্র ৩৬ বছর বয়সে অনেকটা নীরবেই চলে যান না ফেরার দেশে।
খোরশেদ আলম
২০২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান একুশে টেলিভিশনের ক্যামেরাপার্সন খোরশেদ আলম।
১৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে একুশে টেলিভিশনের স্টুডিওতে ক্যামেরা চালানোর সময় স্ট্রোক করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৩৮ বছর।
এছাড়াও একুশে পরিবার আরও যাদের হারিয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন মার্কেটিং হেড মোহসিন হাবিব, ব্রডকাস্ট ডিজিএম মজিবর রহমান, ব্রডকাস্ট ইঞ্জিনিয়ার আলী, আতিকুল হক চৌধুরী, মিন্টু বসুসহ আরও অনেকে।
এসবি/