ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

একুশে ফেব্রুয়ারি

প্রকাশিত : ১৮:০৬, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | আপডেট: ১৮:০৮, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

মাতৃভাষার দাবি জানাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে সে মাটিতে পড়ে গেল। আমি প্রথম রক্তস্নাত তাকে বুকে জড়িয়ে ধরি। আবুল বরকত মাতৃভাষার রক্ষার দাবিতে আন্দোলন করল। কিন্তু সেই মাতৃভাষায় কথা বলার সময় তখন তার ফুরিয়ে গেছে। আমি তাকে ভুলিনি, ভুলতে পারি না। একুশে ফেব্রুয়ারির সেই ক্রন্দন সুর আজও হৃদয় বীণায় বেজে ওঠে। আবুল বরকত নিজের জীবন দিয়ে রেখে গেল মাতৃভাষার জীবন্ত দাবি চিরঞ্জীব

সকাল অনুমান ১০টা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তখন অসংখ্য ছাত্র সমবেত হয়েছে। সবাই সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল রাস্তায় বের হবে কি না। এ মিটিংয়ের সভাপতি ছিলেন ভাষাসৈনিক গাজীউল হক। জাতীয় পর্যায়ের নেতা যারা উপস্থিত ছিলেন তারা সবাই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে মতপ্রকাশ করেন। আলোচনার এক পর্যায়ে গাজীউল হক সাহেব ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য আবদুল মতিনের ওপর ভার দেন। তিনি পরিষ্কার সিদ্ধান্ত না দিলেও বলে ওঠেন ‘আমি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে।’ এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত ছাত্রছাত্রী একবাক্যে বলে উঠল ‘আমরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করব’ এটাই শেষ সিদ্ধান্ত হলো। আরও সিদ্ধান্ত হলো যে, দশজন করে গ্রুপ রাস্তায় বের হবে। কিন্তু পরপর তিনটি গ্রুপ বের হতেই পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে ট্রাকে উঠিয়ে দূরে নিয়ে গেল। এই পন্থা কার্যকরী না হওয়ায় পরবর্তী সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কমিটির মেম্বারদের মধ্যে কী আলোচনা চলছিল, তা জানা সম্ভব ছিল না। একপর্যায়ে ঘোষণা করা হলো, মেডিকেল কলেজ হোস্টেল ব্যারাক এলাকায় আমরা সবাই সমবেত হব। বড় বড় গ্রুপে বের না হয়ে পাঁচজনের ছোট গ্রুপে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো। একটি গ্রুপে আমি, শাহজাহান এবং আরও তিনজন রওনা দিই।

আমাদের আগে বেশ কয়েকটি গ্রুপ যাচ্ছিল, পেছনে আরও অনেকে। মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের গেট থেকে পঞ্চাশ-ষাট ফুট দূর থেকেই দেখতে পেলাম গেটের সামনে ছাত্রদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করছে। এ অবস্থা দেখে আমরা কয়েকজন পুলিশের দিকে ঢিল ছোড়ার জন্য প্রস্তুত হই। আমি কয়েকটি ঢিল ছুড়ে পেছনে দৌড়ে মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে ঢুকে যাই। তারপর ভেতর দিক দিয়ে গিয়ে হোস্টেল ব্যারাক এলাকায় ঢুকে পড়ি। এখানে উল্লেখ্য, মেডিকেল কলেজ ও হোস্টেলের সীমানার দেয়ালের মাঝামাঝি স্থানে একটু ফাঁক ছিল, যেখান দিয়ে হোস্টেলের ছাত্ররা যাওয়া-আসা করতে পারত।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মেডিকেল কলেজ হোস্টেলটি কেমন ছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিত্র বাহিনীর সেনাদের ব্যবহৃত বাঁশের লম্বা চালাবিশিষ্ট ১৯টি পরিত্যক্ত ব্যারাক ছিল, যেগুলোকে পরবর্তী সময়ে মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাস করা হয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ঢাকায় আরও দুটি ব্যারাক ছিল একটি নীলক্ষেত ব্যারাক এবং আর একটি পলাশী ব্যারাক।

হোস্টেল এলাকায় ঢোকার পর গেটের কাছে যখন পৌঁছি, তখন ছাত্র এবং পুলিশের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলছে। পুলিশ অনেক ছাত্রকে লাঠিচার্জ করে। ফলে ছাত্রদের মধ্যে ক্রোধ ও উত্তেজনা বাড়তে থাকে। কালক্ষেপণ না করে আমি এবং আমার সলিমুল্লাহ হলের রুমমেট শাহজাহান ঢিলাঢিলিতে শরিক হয়ে যাই। পুলিশ যত ধাওয়া করছিল ছাত্রদের ঢিল ছোড়াও বেড়ে চলছিল। এক পর্যায়ে পলিশ টিয়ার গ্যাস ছোড়ে। টিয়ার গ্যাসে পুরো এলাকা সাদা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল; চোখ মেলা কষ্টকর ছিল। চোখ খুলতে গেলেই জ্বালা করত ও চোখ দিয়ে পানি পড়ত। এখানে উল্লেখ্য, হোস্টেল ব্যারাকগুলোতে মেরামতের কাজ চলছিল, যেজন্য আস্ত ও টুকরো ইট প্রাঙ্গণে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। হোস্টেল এলাকায় ততক্ষণে অনেক ছাত্র জমায়েত হয়ে গেছে। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া এবং লাঠিচার্জ, অন্যদিকে ঢিল ছোড়াছুড়ি বেড়ে চলছিল। আমি আকারে ছোট হলেও বেলা ৩টার সময় আস্ত ইট পুলিশের ওপর ছুড়ে মারি। এখনও ভেবে পাই না কীভাবে ইটগুলো ৫০-৬০ ফুট দূরে নিক্ষেপ করেছিলাম। আস্ত ইটের ঢিল পেয়ে পুলিশ আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে অনেক পুলিশ ঝড়ের মতো গেটের ভেতরে ঢুকে তাদের হাতের লাঠিগুলো ছাত্রদের পায়ে ছুড়ে মারতে থাকে। আমি ভীষণ জোরে দৌড় দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে পুলিশের নাগালের বাইরে চলে যাই।

ছাত্ররা পুলিশকে পুনঃধাওয়া করে গেটের দিকে নিয়ে আসে। পুলিশ যখন গেটের বাইরে চলে যায় ছাত্ররা আবার রাস্তার দিকে ও গেটের দিকে আসে। আমি, শাহজাহান এবং আবুল বরকত রাস্তা থেকে দ্বিতীয় ব্যারাকটির বারান্দায় দাঁড়াই। দ্বিতীয় ব্যারাকটি ছিল ১২নং ব্যারাক, গেট থেকে সর্ব নিকটে অবস্থিত ছিল, অনুমান ৩০ ফুট হবে। আমার দুই হাতে দুটি অর্ধেক ইটের টুকরো। শাহজাহানের হাতেও। আবুল বরকতের হাতে কী ছিল জানি না।

ঠিক ওই সময় দেখতে পেলাম, তিনজন পুলিশ গেটের পূর্ব পাশে হাঁটু গেড়ে বসেছে। তাদের পেছনে দলবেঁধে অনেক পলিশ দাঁড়িয়ে। আমরা চিন্তাও করিনি তারা গুলি ছুড়বে। হঠাৎ খটাখট খটাখট বন্দুকের গুলির আওয়াজ। মেডিকেল কলেজ হোস্টেল গেটের পূর্ব পাশে কাঁটাতারের পেছনে পজিশন নিয়ে বন্দুকের ট্রিগার চেপে আমাদের লক্ষ্য করে অনর্গল গুলি ছুড়ছে। আমার আর শাহজাহানের মাথার ওপর ঘেঁষে ও কানের পাশ দিয়ে বেশ কয়েকটি গুলি ব্যারাকের বারান্দার বাঁশের চালায় আওয়াজ করে বিঁধে গেল। একদম ফ্রন্টলাইনে পুলিশের সর্ব সন্নিকটে আমরা তিনজন। আমার বাম পাশে শাহজাহান, আর গা-ঘেঁষে আমার ডান পাশে আবুল বরকত। মুহূর্তে ধপাস করে আমার ডান পাশে আবুল বরকত বারান্দার মেঝেতে পড়ে গেল। গুলি চলছে। ডানে তাকালাম। একবার আহ! শব্দ করে দুই হাতে ভর দিয়ে সে নিজেকে পিছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। গুলি তার বাম পায়ের ঊরুর গোড়ায় লেগেছে। ইস্ত্রি করা খাকি রঙের প্যান্টে গুলির ছিদ্র দিয়ে কলকল করে রক্ত বের হচ্ছে। সিমেন্টের বারান্দায় রক্তস্রোত বইছে। আমার দুই হাতের ঢিল ফেলে দিয়ে দ্রুত তাকে জড়িয়ে ধরে কোলে নিয়েছিলাম। নিমিষে শাহজাহান এসে আমার সঙ্গে যোগ দেয়। দুজনে মিলে তাকে বুকের ওপর তুলে ফেলি। আমার কাপড়, জুতা এবং শাহজাহানের কাপড় তাজা রক্তে সিক্ত হয়ে গেছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পেছন থেকে আরও দুই-তিনজন এসে তাকে ধরে। অন্য দুজন এবং শাহজাহান তাকে দ্রুত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে নিয়ে যায়। বরকতকে যখন কোলে নিলাম, তখন আমার পেছনে সাদা পোশাক পরা লম্বা একজন ছাত্র ছিল। অনেক পরে জেনেছিলাম তার নাম আবদুল করিম পাঠান, বরকতকে যখন হাসপাতালে নিয়ে যায় তার পেছনে একজন দ্রুত যাচ্ছিলেন। তিনি ছিলেন পঞ্চম বর্ষের সার্জারির ছাত্র, যিনি সার্জন এলিনসনকে বরকতের অপারেশনে সাহায্য করেছিলেন। বরকত অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সেদিন রাতে হাসপাতালে মারা যায়।

পুলিশের প্রতি ক্রোধে আমি পাগলপ্রায়। যে দুটি ঢিল ফেলে আবুল বরকতকে কোলে নিয়েছিলাম, সে দুটি ঢিল হাতে নিয়ে ফ্রন্টে দাঁড়ালাম। ফ্রন্টলাইনে আমি একা, আর কেউ নেই; বন্দুকের গুলির ভয়ে সবাই পেছনে চলে গেছে। আমি একা, বন্দুকধারী তিন পুলিশের মুখোমুখি। প্রায় তিন মিনিট পর দেখতে পেলাম পুলিশ তিনজন বন্দুক হাঁটুর ওপর থেকে নামিয়ে উঠে দাঁড়াল এবং পেছনে সরে গেল। ডান দিকে ফিরে নিচের দিকে তাকালাম। বারান্দার মেঝেতে বেশ কিছু জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে রক্ত জমে আছে। বরকতের ক্ষরিত রক্ত উপবৃত্ত (ইলিপটিক্যাল) আকারে কালচে রঙে অনেকখানি জায়গা বারান্দায় ছড়িয়ে আছে। তাকিয়ে রইলাম, ঢিল দুটি যেন নিজে নিজেই হাত থেকে পড়ে গেল। আমার মনের অবস্থা? এ প্রশ্নের উত্তর কোনো ভাষায় দেওয়া যাবে না।

আবুল বরকত আমার চেয়ে লম্বা। পরনে ছিল সদ্য ইস্ত্রি করা খাকি রঙের প্যান্ট আর ডোরাওয়ালা সাদা শার্ট। আগে তাকে চিনতাম না। পুলিশের গুলিতে পড়ে যাওয়ার পর তার তাজা খুনে সিক্ত হয়ে তাকে চিনলাম।
এই সেই আবুল বরকত যার আহ্! শব্দটি আজ ৬৩ বছর ধরে আমার কানে একই আওয়াজ ধ্বনিত হয়। যার ঊরু থেকে কলকল ধারায় নির্গত রক্তপ্রবাহ একই তাজা রঙে আমার মানসে অহরহ ভেসে ওঠে। এই সেই আবুল বরকত যার রক্তমাখা দেহের স্পর্শ আমার বুকের অণু-পরমাণুতে নিয়ত অনুভব করি।

১৯৫২ সাল একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল মাতৃভাষার রণক্ষেত্র। পুলিশ থেকে সর্ব নিকটতম ফ্রন্টলাইনে আমাদের তিনজনের একজনকে বন্দুকের গুলি পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ১২ নম্বর ব্যারাকের বারান্দায় সে রক্তলেখা মুছে গেছে। ব্যারাকগুলোও কবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিন্তু সে স্মৃতি মোছেনি, আজও জেগে আছে স্মৃতিপটের স্তরে স্তরে। সেই আত্মত্যাগ বিলীন হয়নি নবীন হয়ে জেগে ওঠে বাঙালির অন্তরে অন্তরে।

আবুল বরকতের তাজা খুনে সিক্ত আমার কাপড় ও জুতা বহুদিন সযত্নে রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার ৪০ বছর বিদেশে অবস্থানের কারণে কোথায় হারিয়ে গেছে। আফসোস হয়, কেন ভালোভাবে যত্ন করে রাখিনি। যদি রেখে দিতাম তাহলে সেগুলোর টুকরো মাতৃভাষার রণক্ষেত্রের স্মৃতি হিসেবে আমার কবরে দেওয়ার জন্য বলে যেতে পারতাম। আবুল বরকতের জন্য আমার গভীর অনুভূতি স্বাভাবিক কারণেই অতি প্রবল, প্রায় সাড়ে ছয় দশক ধরে তার স্মৃতি বয়ে চলেছি।

মাতৃভাষার দাবি জানাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে সে মাটিতে পড়ে গেল। আমি প্রথম রক্তস্নাত তাকে বুকে জড়িয়ে ধরি। আবুল বরকত মাতৃভাষার রক্ষার দাবিতে আন্দোলন করল। কিন্তু সেই মাতৃভাষায় কথা বলার সময় তখন তার ফুরিয়ে গেছে। আমি তাকে ভুলিনি, ভুলতে পারি না। একুশে ফেব্রুয়ারির সেই ক্রন্দন সুর আজও হৃদয় বীণায় বেজে ওঠে। আবুল বরকত নিজের জীবন দিয়ে রেখে গেল মাতৃভাষার জীবন্ত দাবি চিরঞ্জীব। জানিয়ে গেল বুলেট দিয়ে মায়ের ভাষা মুখ থেকে কেড়ে নেওয়ার শক্তি কারও নেই। সেদিন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান বুলেটের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে ঢাকার আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হয়েছিল। গুলি ছোড়ার পর কয়েক মিনিট স্তব্ধতা থাকলেও ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। তখন ঢিল ছোড়াছুড়ি হতে দেখিনি। পাকিস্তানি পুলিশের গুলির খবর ছড়াতে সময় লাগেনি। আমি অল্প পরে হোস্টেল কম্পাউন্ডের ভেতরে অ্যাসেম্বলি হলের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় দেখতে পেলাম রাস্তা থেকে প্রথম ব্যারাকটির বারান্দায় একটি লোক চিত হয়ে পড়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে দেখি সে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। তার ডান পায়ের পাতা গুলির আঘাতে গোল হয়ে একটি রক্তিম ফুলের মতো ফুটে আছে। ওখান থেকে রাস্তার পাশে এসে দাঁড়ালাম। এমন সময় এমএলএ আলী আহমেদ হেঁটে অ্যাসেম্বলির দিকে যাচ্ছিলেন। আমি তাকে চিনতাম না। আমার বাঁ-পাশ থেকে একজন তাকে সম্বোধন করে ডেকে উঠল ‘এই আলী আহমেদ’ এদিকে আসেন, দেখে যান। আলী আহমেদ সাহেব সঙ্গে সঙ্গে ফিরে হোস্টেলের গেটের দিকে তাড়াতাড়ি আসেন। আমরা কয়েকজন দৌড়ে গিয়ে গেটের কাছ থেকে তাকে নিয়ে দ্বিতীয় ব্যারাকের বারান্দায়, যেখানে আবুল বরকতের রক্ত জমাট হয়ে ছড়িয়ে আছে, সেখানে নিয়ে গেলাম। আলী আহমেদ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমার এক জুনিয়র ফিজিক্সের ছাত্র ফজলে আলী বারান্দার সামনে দূর্বাঘাস থেকে কুড়িয়ে পাওয়া একটি পুরোনো ময়লা টুথব্রাশ দিয়ে আবুল বরকতের কিছু রক্ত বারান্দার মেজ থেকে তুলে আলী আহমেদের বাম কাঁধের কালো শেরওয়ানিতে মেখে দিয়ে বলল, ‘এই চিহ্নটুকু অ্যাসেম্বলি হলে নিয়ে যান।’ ওখান থেকে তাকে প্রথম ব্যারাকের বারান্দায় নিয়ে গেলাম। তিনি বারান্দায় অজ্ঞান পড়ে থাকা লোকটিকে দেখলেন এবং বললেন যে, তিনি যা দেখেছেন, তা অ্যাসেম্বলিতে গিয়ে বলবেন। মেডিকেল কলেজ হোস্টেল কম্পাউন্ডের উত্তর-পশ্চিম কোনা এবং অ্যাসেম্বলি হলের দক্ষিণ-পূর্ব কোনা শুধু রাস্তার এ-পাশ আর ও-পাশ। আমরা অনেকেই সেই কোনায় জড়ো হয়ে অ্যাসেম্বলির দিকে লক্ষ করে চিৎকার করে এমএলএদের প্রতি আমাদের প্রতিবাদ জানাতে থাকি। অল্পক্ষণের মধ্যেই এমএলএরা অ্যাসেম্বলি বিল্ডিংয়ের দোতলায় খোলা ছাদে এসে দাঁড়ালেন। ছাত্রদের অনেকেই উত্তেজিত হয়ে তাদের প্রতি তিরস্কার করে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। হৃদয়বিদারক এ দৃশ্য এখনও আমার স্মৃতিপটে চির সজীব হয়ে জেগে আছে।

এরই মধ্যে ছাত্রনেতাদের কেউ একটি মাইকের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। এর মাধ্যমে সরকারের দমননীতির তীব্র নিন্দা, খুনের বিচার, বাংলা ভাষার দাবি ঘোষণা করে বিভিন্নজন বক্তৃতা করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পরে অ্যাসেম্বলি হল থেকে আমাদের মাঝে চলে এলেন এমএলএ আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ। তাকে আমরা যা ঘটেছে দেখালাম। তিনি কিছুক্ষণ কী চিন্তা করলেন, তারপর মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি তার প্রাঞ্জল ভাষায় বললেন, অ্যাসেম্বলি হলে তিনি ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলি করার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তার বক্তৃতার অনেক কথাই ভুলে গেছি। কিন্তু একটি বাক্য এখনও মনে আছে। তিনি বললেন, ‘অ্যাসেম্বলি হলে আমি আর থাকতে পারলাম না, চলে এলাম।’ তিনি যখন বক্তৃতা দেন, তখন আমি তার ডান পাশেই দাঁড়ানো ছিলাম। তিনি একজন সাহসী বীরপুরুষ। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে। এক বছরের বেশি তাকে জেলে আটক রাখা হয়।

এরপর এক ফাঁকে হোস্টেলের গেট থেকে বেরিয়ে দেখতে পেলাম আর কোথায় কী হয়েছে। গেটের অদূরে একটি কোনায় দেখতে পেলাম একটি লোক পড়ে আছে। গুলিতে তার মাথার খুলিটি উড়ে দূরে পড়ে আছে।


লেখক: ভাষাসৈনিক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত।


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি