কালোত্তীর্ণ ৭ই মার্চের ভাষণ ও আজকের প্রাসঙ্গিকতা
প্রকাশিত : ১২:৩৪, ৭ মার্চ ২০১৯
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম প্রেরণা। ৭ই মার্চের ভাষণই নিরস্ত্র একটা জাতিকে সশস্ত্র হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে সবচেয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ও ২৬শে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা তাঁর অনুপস্থিতিতে সমগ্র জাতিকে ৯ মাস যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দিকনির্দেশনা, সাহস ও শক্তি জুগিয়েছিল।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ছিল ইতিহাসের অনিবার্যতা। ৭ই মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ দিনগুলোর একটি। বিভ্রান্তি ছিল প্রচুর, তবে সেটা ছিল কিছু তরুণ নেতাকর্মী ও জনতার একাংশের মধ্যে। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য অর্জনের জন্য কৌশল ও কর্মপরিকল্পনার মধ্যে কোনো বিভ্রান্তি বা দোদুল্যমানতা ছিল না। ১ মার্চ পাকিস্তানের সেনাশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য নবগঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের আহ্বানকৃত সভা স্থগিত করার পরক্ষণেই উত্তাল হতে থাকে ঢাকার রাজপথ। ২ মার্চ থেকে অসহযোগের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু, পুরো দেশ অচল হয়ে পড়ে। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু পল্টনে ঘোষণা করলেন ৭ই মার্চ জনসভায় তিনি জাতির উদ্দেশে বক্তব্য রাখবেন। দেশে-বিদেশে অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ওই দিন স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। ৬ মার্চ বিশ্ববিখ্যাত ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার এক নিবন্ধে বলা হয়, শেখ মুজিব একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন। ৭ই মার্চ সকালে করাচি থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোতেও এমন আশঙ্কাই ব্যক্ত হয়েছিল। অনেক তথাকথিত বিশ্লেষক তাঁদের লেখায় ও বক্তৃতায় এখনো বলেন, শেখ মুজিব যদি ৭ই মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেন, তাহলে লাখো জনতা ঢাকা সেনানিবাস আক্রমণ করত, এতেই অনেক কম মূল্যে আমরা স্বাধীনতা পেয়ে যেতাম।
বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস সচেতনতা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতার ধারণা এত প্রগাঢ় ছিল যে তিনি কোনো অবস্থায়ই একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা (ইউডিআই) করে আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের তকমা লাগানোর সুযোগ দেননি। বিশ্ব পরিস্থিতি আমাদের কতটা প্রতিকূল ছিল তা বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমেরিকা, চীন ও ইসলামিক দেশগুলোর বিরোধিতার কথাই বহুল প্রচারিত। ভারতসহ বিশ্বের গুটিকয়েক দেশ ছাড়া কেউই আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে আমাদের পক্ষ অবলম্বন করেনি। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে, ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ জাতিসংঘের ভোটাভুটিতে আমাদের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল ১০৪টি দেশ, পক্ষে মাত্র ১১টি, আর ভোটদানে বিরত ছিল ১০টি দেশ। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাযুদ্ধের সব প্রস্তুতির সার্বিক দিকনির্দেশনা দিলেও পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণার আনুষ্ঠানিকতাটি বাদ রাখেন। ২৫শে মার্চের রাতে জাতি যখন পাকিস্তানিদের একতরফা যুদ্ধের শিকার হলো, তখনই ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেসকো এই ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ করে নিয়েছে এবং ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্ট্রারে অন্তর্ভুক্ত করেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এখন শুধু বাঙালির নয়, সারা বিশ্বের তথা মানবসভ্যতার অহংকার। এ ভাষণ কালোত্তীর্ণ বিশ্ব ক্ল্যাসিক। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে অনেক কিছুই রয়েছে, যা চলমান সমসাময়িক বিশ্বে খুবই প্রাসঙ্গিক। বিশ্বের দেশে দেশে আঞ্চলিক ও গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব নিরসনে সমঝোতাকে প্রথমে বেছে নিতে হবে। সমঝোতার সব পথ রুদ্ধ হলেই অন্য পথ ধরতে হবে। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘...আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি...।’ রক্তক্ষয় ও হানাহানির পথে প্রথমেই না গিয়ে বরং এ পথকে পরিহার করে সমঝোতার চেষ্টা বিশ্ববাসীর কাছে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।
বঙ্গবন্ধু একবাক্যে বাঙালির ভবিষ্যৎ রচনা করে বলেছিলেন, ‘বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ তাঁর শুধু একটি উদাহরণ পদ্মা সেতু। দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে কাল্পনিক দুর্নীতির অভিযোগ এনে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক যখন সরে গেল তখন এডিপি, জাইকাসহ আরো নানা উন্নয়ন সহযোগী পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে সরে যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করবেন, অনেকটা যেন বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের বক্তব্যেরই প্রতিফলন, ‘...সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’
রাজনীতি যাঁরা করবেন তাঁরা ক্ষমতাকে ভোগ করার জন্য রাজনীতি করবেন না। জনগণের জন্য আত্মত্যাগই হচ্ছে রাজনীতির মহৎ উদ্দেশ্য। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাদের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখাই রাজনীতি। বঙ্গবন্ধু তাঁর সারাটি জীবন মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছেন, যৌবনের ১৩টি বছর জেলখানায় নির্জন প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরও ক্ষমতার সিঁড়িকে প্রত্যাখ্যান করে ৭ই মার্চে বলেছেন, ‘...আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’
বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার সংগ্রাম কথাটা বলেই ক্ষান্ত হননি, মুক্তির সংগ্রামের কথাটাও যোগ করেছিলেন, যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও বঙ্গবন্ধুর মনে মুক্তির সংগ্রামের তাৎপর্য লুকানো ছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি একবার উচ্চারিত হলেও ‘মুক্তি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন কয়েকবার, “...আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়’, ‘...এ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে’, ‘...যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হয়’, ‘...এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ’, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারে সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” স্বাধীনতার সংগ্রামের চেয়ে মুক্তির সংগ্রাম অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। যদিও মুক্তির জন্য স্বাধীনতা অপরিহার্য। স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে পরাধীনতার অবসান হলেও মানুষ অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি অর্জন করে না।
১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি প্রথম একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের মালিক হয়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির সংগ্রাম শুরু হতেই সেই অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেওয়া হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা ছিল সবাই মিলেমিশে একটি বহুমাত্রিক বহুবাচনিক উদার গণতান্ত্রিক সমাজ। যার মধ্য দিয়ে মানুষের মুক্তি আসবে। মুক্তি বলতে সব বঞ্চনা, বৈষম্য, শোষণ, সংকীর্ণতা, কূপমণ্ডূকতা, চেতনার দীনতা থেকে মুক্তিকে বুঝিয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। অর্থনৈতিকভাবে আমরা দ্রুত এগোচ্ছি। এ বছরেই আমরা অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম লেখাচ্ছি। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাংকের নির্ধারিত মানের বিচারে মাথাপিছু ডলারের হিসাবে আমরা মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় স্থান পাব। ২০৪১ সালে আমরা উন্নত দেশে পরিণত হব, তবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দৃঢ়ভাবে না ধরলে এ উন্নয়ন টেকসই হবে না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আমাদের মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মুক্তির সংগ্রাম চলে নিরন্তন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মানুষের মুক্তির সংগ্রাম অব্যাহত থাকুক—এটাই আজকের প্রত্যাশা।
লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
এসএ/