আজ আন্তর্জাতিক ডিএনএ দিবস
প্রকাশিত : ০৮:৪০, ২৫ এপ্রিল ২০১৯
পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উদ্ঘাটনের পর থেকে বাংলাদেশের বিজ্ঞানপ্রেমী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ডিএনএর ব্যাপারে কিছুটা আগ্রহ সৃষ্টি হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি প্রণোদনায় এই গবেষণা কর্মকাণ্ড হাতে নেওয়া হয়েছিল। প্রধান কারিগর ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জীববিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম। সঙ্গে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের একঝাঁক উদ্যোগী গবেষক। সফটওয়্যার কম্পানি ‘ডাটা সফট সিস্টেম বাংলাদেশ লিমিটেড’-এর বিশেষজ্ঞরাও ছিলেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। সাংবাদিকরা তখন এই আবিষ্কারকে ‘পাটের জীবনরহস্য উদ্ঘাটন’ বলে প্রচার করেছিলেন। কারণ ড. আলম নাকি এমনটাই চেয়েছিলেন। সেই থেকে বাংলা ভাষায় জিনোম সিকোয়েন্স বিষয়টি ‘জীবনরহস্য’ বলেই পরিচিতি পেয়ে আসছে। যদিও জীবনের রহস্য উদ্ঘাটন এখনো সুদূরপরাহত। তাই আমাদের কিছু কিছু বিজ্ঞানী জিনোম সিকোয়েন্সের আভিধানিক অর্থ জীবনরহস্য মানতে নারাজ। আমিও সেই দলে। তবে জীবনরহস্য শব্দটি যে আমাদের দেশেই প্রথম ব্যবহৃত হয়েছে এমন নয়। ডিএনএর কাঠামো-বৈশিষ্ট্য জানার পরপরই আবিষ্কারকদের একজন ফ্রান্সিস ক্রিক ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ সালে কেমব্রিজের এক পানশালায় বসে ঘোষণা দেন যে তাঁরা জীবনের রহস্য খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর ভাষায়, ‘found the secret of life’। অবশ্য এর কিছুদিনের মধ্যেই—অর্থাৎ একই বছরের এপ্রিলের ২৫ তারিখে ওয়াটসন ও ক্রিকের ডিএনএর কাঠামোসংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি ‘নেচার’ জার্নালে প্রকাশিত হয়। ওয়াটসন ও ক্রিক ক্যাভেন্ডিস ল্যাবে কাজ করতেন। তাঁদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হওয়ার পর (১৪ মে ১৯৫৩) ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক স্যার লরেন্স ব্রাগ (Sir Lawrence Brag) এ ব্যাপারে লন্ডনের গাই মেডিক্যাল স্কুল হাসপাতালে একটি বক্তৃতা দেন। ঘটনাটি ওখানকার খবরের কাগজ News Chronicle-এ "Why You Are You. Nearer Secret of Life" শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এখানে কিন্তু ডিএনএর কাঠামো উন্মোচনকে জীবনরহস্যভেদী আবিষ্কারের কাছাকাছি কিছু একটা বলা হয়েছে। নেচারের একই সংখ্যায় আরো দুটি একই মাপের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়।
যা হোক, ডিএনএ আবিষ্কার এবং এর কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার, দুটি ভিন্ন বিষয় হলেও আমাদের অনেকেই তা গুলিয়ে ফেলি। ফলে অনেকেই ওয়াটসন ও ক্রিককে ডিএনএ আবিষ্কারক বলে ভুল করে থাকি। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা ডিএনএর আবিষ্কারক নন। তাহলে ডিএনএর আবিষ্কারক কে বা কারা? ডিএনএ প্রথম শনাক্ত করেন সুইস রসায়নবিদ ফ্রেডরিখ মিয়েশ্চার (Friedrich Miescher) ১৮৬০ সালে। এর বেশ পরে আরেক মার্কিন ফোবিয়াস লেভেনে (১৮৬৯-১৯৪০) (Phoebus Levene) এবং অস্ট্র-হাঙ্গেরিয়ান বিজ্ঞানী এরউইন শারগাফ (১৯০৫-২০০২) (Erwin Chargaff) এই অতিকায় অণুটির প্রাথমিক রাসায়নিক উপাদান এবং সেগুলো পরস্পরের সঙ্গে কিভাবে সম্পৃক্ত তা নিয়ে ধারাবাহিক বেশ কিছু গবেষণা করে জীববিদ্যার নতুন এক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। মিয়েশ্চার কিন্তু ডিএনএ আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে কাজে নামেননি। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, শ্বেত রক্তকণিকার প্রোটিনের উপাদান আলাদা করা এবং বৈশিষ্ট্যায়ন করা। কিন্তু তার পরিবর্তে এমন এক পদার্থ তার সামনে ধরা দেয়, যেটা এনজাইম সহযোগে বিশ্লেষিত হয় না এবং যার মধ্যে ফসফরাসের পরিমাণ অনেক বেশি। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এটা প্রোটিন না হলেও প্রোটিনের মতোই কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদার্থ। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন নিউক্লিইন। এই নিউক্লিইনই পরবর্তীকালে নিউক্লিক এসিড এবং অবশেষে ডিওক্সিরিবোনিউক্লিক এসিড বা ডিএনএ নামে পরিচিতি পায়। এর পরে আসে লেভেনের কথা। তিনিই প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন যে নিউক্লিক এসিড অনেকগুলো নিউক্লিওটাইডের সমন্বয়ে গঠিত হয়। এবং একেকটি নিউক্লিওটাইড আবার একটি নাইট্রোজেন-ক্ষারক (অ্যাডিনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন ও থাইমিন—এই চারটি ক্ষারকের যেকোনো একটি), একটি চিনির অণু এবং একটি ফসফেট গ্রুপ সহযোগে গঠিত। এরউইন শারগফ লেভেনের কাজের ওপর ভিত্তি করে ডিএনএ সম্পর্কিত আরো তথ্য উদ্ঘাটন করেন। পাশাপাশি ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত কানাডিয়ান-আমেরিকান বিজ্ঞানী অসওয়াল্ড অ্যাভারির (১৮৭৭-১৯৫৫) (Oswald Avery) বিখ্যাত গবেষণাপত্রের মাধ্যমে জানতে পারেন যে বংশগতির একক বা জিন (Gene) ডিএনএ সমন্বয়ে গঠিত। তিনিই ১৯৫০-এর দিকে প্রথম লক্ষ করেন যে প্রজাতিভেদে ডিএনএর নিউক্লিওটাইড কম্পোজিশন আলাদা হয়ে থাকে। এবং প্রজাতি বা টিস্যু-নির্বিশেষে ডিএনএর অ্যাডিনিনের (A) পরিমাণ সাধারণত থাইমিনের (T) সমান হয়ে থাকে। গুয়ানিন (G) এবং সাইটোসিনের (C) বেলায় একই কথা প্রযোজ্য। ডিএনএর কাঠামো দাঁড় করাতে এসব তত্ত্ব এবং তথ্য থেকে অনুগামী গবেষকরা সুবিধা নিয়েছিলেন। এই সুবিধাভোগীদের মধ্যে সবার ওপরে ছিলেন ওয়াটসন ও ক্রিক। আর এ থেকেই বোঝা যায়, ওয়াটসন ও ক্রিক ডিএনএ আবিষ্কার করেননি, আবিষ্কার করেছেন ডিএনএর কাঠামো-বৈশিষ্ট্যকে। সেটাই ডিএনএ আবিষ্কার থেকে কোনো অংশেই কম নয়।
যা হোক, আলোচনার শুরুতে উল্লিখিত তিনটি গবেষণাপত্রকে আধুনিক মলিকুলার বায়োলজি বা বায়োটেকনোলজির ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এগুলো একই দিনে বিখ্যাত নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। দিনটি ছিল ২৫ এপ্রিল ১৯৫৩। গুরুত্বের বিবেচনায় ওয়াটসন এবং ক্রিকের গবেষণাপত্রটি একটু ওপরে স্থান পেয়েছে বলে মনে হয়। কারণ ১৯৬২তে যখন শারীরবিদ্যা বা মেডিসিনে তিনজন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীর মধ্যে প্রথম দুজন ছিলেন ওয়াটসন ও ক্রিক। আর তৃতীয়জন হলেন উইলকিন্স। দুঃখজনক বিষয় হলো, রোজালিন্ডকে নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচনায় আনা হয়নি। কারণ তিনি পুরস্কার প্রদানের বছর চারেক আগেই অকালে মৃত্যুবরণ করেন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে। নোবেল কমিটি কখনোই মৃত ব্যক্তিদের পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করে না। যা হোক, তাঁর পিএইচডির ছাত্র গোসলিংকে তো বিবেচনা করা যেত। কারণ গোসলিং উইলকিন্স এবং রোজালিন্ড দুজনের সঙ্গেই কাজ করেছিলেন।
এর পর থেকে ডিএনএ-সংক্রান্ত গবেষণা দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে থাকে। একে একে আরএনএ, জেনেটিক কোড, জিন প্রকৌশল, জিনোম সিকোয়েন্স, জিন এডিটিং—কত কিছু আমাদের সামনে হাজির হয়। মানুষের জিনোম সিকোয়েন্স করা হয় ২০০৩-এ। এরপর বিভিন্ন ফসল বা গৃহপালিত প্রাণীর জিনোম সিকোয়েন্স করা শুরু হয়। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ের জিনোম সিকোয়েন্সও করা শুরু হয়। এমনকি যদি কেউ নিজের জিনোম সিকোয়েন্স করতে চায়, তা-ও এখন সম্ভব। এবং তা বেশ সাশ্রয়ী। আর এসব কারণেই National Human Genome Research Institute (NHGRI)-এর বিজ্ঞানীরা ডিএনএর কাঠামোসংক্রান্ত গবেষণাপত্রগুলো প্রকাশের দিন ২৫ এপ্রিলকে বিশেষভাবে উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। আর সেটাই হলো বিশ্ব ডিএনএ দিবস বা আন্তর্জাতিক ডিএনএ দিবস। উদ্দেশ্য ছাত্র, জনতা এবং অনুসন্ধিত্সুদের মধ্যে জিনোমিক গবেষণার হালফিল জ্ঞান পৌঁছে দেওয়া এবং জীবপ্রযুক্তি মানবকল্যাণে কতখানি প্রভাব রাখতে পারে, সে বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা।
লেখক: কনসালট্যান্ট, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট
মহাপরিচালক (ভূতপূর্ব), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর।