জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী
প্রকাশিত : ১১:৪৫, ২৬ এপ্রিল ২০১৯ | আপডেট: ১৫:১৫, ২৬ এপ্রিল ২০১৯
আগামী ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে আলাদা রকম মহিমাময় এক মাহেন্দ্রক্ষণ। বছরব্যাপী স্বতঃস্ফূর্ত এবং প্রাণবন্ত আয়োজনে এই উৎসব উদ্যাপিত হবে। এ জন্য আমরা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। এ বছর আমাদের জীবন অভিজ্ঞতার অসাধারণ অংশ হয়ে থাকবে। সরকার এরই মধ্যে এ লক্ষ্যে দুটি কমিটি গঠন করেছে, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় কমিটি’ এবং ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি’। এই দুই কমিটিতে রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিশিষ্টজন, যেমন—স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষাবিদ, শিল্প-সংস্কৃতি-ক্রীড়া ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং ধর্মীয় নেতারা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় কমিটির সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের কর্মসূচি সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করছে জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি। এ কমিটি জাতীয় কমিটির সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনার আলোকে সার্বিক কার্যক্রম গ্রহণ করবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বাস্তবায়ন কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করছে। এরই মধ্যে এসংক্রান্ত আটটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিগুলো বিবিধ পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে।
সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই কমিটির প্রথম যৌথ সভা করেছেন। এ সভায় উপস্থিত সদস্যরা দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা করেছেন, বছরব্যাপী উৎসব আয়োজন বিষয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছেন এবং অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই জন্মশতবার্ষিকী একটি বিশেষ সময়কালের অর্জন ও গৌরবের সঙ্গে যুক্ত। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর সুগভীর তাৎপর্যের সঙ্গে এ সময় যোগ হবে উন্নয়ন ও অগ্রগতির কয়েকটি মাইলফলক। বঙ্গবন্ধু একটি সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্নযাত্রা শুরু করেছিলেন। তাঁর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেই স্বপ্নযাত্রা গতি পেয়েছে। আজ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নানা বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশ বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। দেশে যে কয়টি মাইলফলক এ সময় অতিক্রান্ত হবে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী, ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ। এসবই বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ও প্রত্যয়ের ধারাবাহিকতার দৃষ্টান্ত। এ বিষয়গুলো নিয়ে বহু লেখা হয়েছে। আমি সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিস্তারিত উল্লেখের দিকে যাচ্ছি না। জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন ও সরকারি অঙ্গীকার বাস্তবায়নের এই মেলবন্ধনের ইতিহাস সম্ভবত অন্য কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, ‘মহান স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ পূর্তির দ্বারপ্রান্তে উপনীত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনকালে সুখী-সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে রূপকল্প ২০২১ সফলভাবে সম্পন্ন করা জাতির কাছে আমাদের অঙ্গীকার।’ জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্যাপন এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যয়কে যুক্ত করা হয়েছে, যা এ উৎসব আয়োজনকে সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যে অভিষিক্ত করবে।
জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন পৃথিবীতে নতুন ঘটনা নয়। এর আগেও অনেক বিখ্যাতজনের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন সম্পর্কে আমরা জানি। বর্তমানে ভারতে মহাত্মা গান্ধীর ১৫০তম জন্মশতবার্ষিকীর উদ্যাপন চলছে। মহাত্মা গান্ধী জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর। এ উপলক্ষে ভারতেও বিভিন্ন কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং উদ্যাপিত হচ্ছে। এর আগে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর জন্মশতবার্ষিকীও উদ্যাপন করা হয়েছে। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯১৭ সালের ১৯ নভেম্বর। দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মশতবার্ষিকী কিছুদিন আগে উদ্যাপিত হলো। নিকট অতীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ আয়োজনে উদ্যাপন করা হয়েছে।
জনগণ ইতিহাসের চালিকাশক্তি। কিন্তু ব্যক্তির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজ গুণে, সক্ষমতায়, সাহস ও মেধার অসাধারণ দীপ্তিতে এবং আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ ও কষ্টকর পথ পেরিয়ে কোনো কোনো ব্যক্তি আবির্ভূত হন জাতির কণ্ঠস্বর হিসেবে। জনতার অভিপ্রায়, আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন ধারণ করে জাতিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও মুক্তির নতুন দিগন্তের সন্ধান দেন তাঁরা। পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা এ রকম অনেক মহামানব সম্পর্কে জানি। বঙ্গবন্ধু তাঁর সাহস, অনমনীয় দৃঢ়তা ও অসাধারণ বাগ্মিতার অভূতপূর্ব সমন্বয়ে বাঙালির শ্রেষ্ঠতম নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। জেল, জুলুম, অত্যাচার কিছুই তাঁকে বাঙালির মুক্তির স্বপ্নযাত্রা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। সম্প্রতি জেলখানা থেকে প্রকাশিত একটি গ্রন্থে দেখা যায়, তিন হাজার ৫৩ দিন তিনি জেলখানায় অতিবাহিত করেছেন। সেই যে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনকালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, এর পর থেকে জেলখানাই হয়ে উঠেছিল তাঁর নিত্য আবাসস্থল। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ এ দুটি অসাধারণ গ্রন্থে এবং সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর ‘Secret Documents of Intelligence Branch on Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman’ গ্রন্থে আমরা এসব দিনের অনেক খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানতে পারি। বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষ থেকে অসাধারণ উচ্চতায় আসীন হয়েছেন। রূপান্তরিত হয়েছেন ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে। তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণ আজ ইউনেসকোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত। এ ভাষণ বাঙালির ইতিহাসের বাঁকবদলের ভাষণ। কারণ এর আগে বাঙালিকে কেউ এভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি, কেউ এভাবে স্বাধীনতার ডাক দেয়নি। তাঁর ডাকেই বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনে। এ ভাষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যুদ্ধাবস্থার ভাষণ। একদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রক্তচক্ষু ও তাদের ট্যাংক-কামান প্রস্তুত, অন্যদিকে নিরস্ত্র বাঙালির হৃদয়ে স্বাধীনতার আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছেন অকুতোভয় এক মহানায়ক। ৭ই মার্চের অগ্নিগর্ভ ভাষণে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন জাতির একমাত্র প্রতীক হিসেবে। সেদিন তিনি শুধু ব্যক্তি নন, শুধু নেতা নন, বাঙালি জাতিসত্তার হাজার বছরের অতিক্রান্ত ইতিহাসকে ধারণ করে নিজেই রূপান্তরিত হয়েছেন জনতার কণ্ঠস্বরে। প্রথম সার্বভৌম বাঙালি হিসেবে জনতার শক্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার উদাহরণও তিনি সৃষ্টি করেছেন।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ধ্বংসস্তূপ থেকে পৌরাণিক ফিনিক্স পাখির মতো তাঁর নেতৃত্বে জেগে উঠেছিল নতুন দেশ। আরাধ্য সোনার বাংলা গঠনের লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের স্বপ্নযাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি। ঘাতকের বুলেটে তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটেছে। কিন্তু আমাদের জীবনাচরণে, প্রাত্যহিকতায় চিরকালীন বাতিঘরের মতো তিনি সমুজ্জ্বল। নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি প্রতি মুহূর্তে আবির্ভূত হচ্ছেন প্রেরণার দীপশিখা হিসেবে। আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের যে অভিযাত্রা, সেখানে তিনিই সাহস ও আলোকবর্তিকা।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী তাই বাঙালির কাছে নিছক জন্মদিন নয়, বাঙালির কাছে মুক্তিদাতার প্রতি সম্মান জানানোর বিরল সুযোগের দিন। সেই সঙ্গে যে জাতিকে তিনি সৃষ্টি করেছেন, তার অবয়ব দিয়েছেন এবং বিশ্বসত্তার গর্বিত অংশে রূপায়িত করেছেন, তাঁর প্রতি সেই জাতির সম্মিলিত কৃতজ্ঞতা প্রকাশেরও সময় এটি। জীবদ্দশায় তিনি শোষিতের নেতা হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। ফিদেল কাস্ত্রোর মতো বিশ্বনায়কের চোখেও তিনি ছিলেন হিমালয়। বিশ্ব মিডিয়ায় তিনি ছিলেন ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে নন্দিত। বঙ্গবন্ধু যুগপৎ জাতির নেতা এবং বিশ্বনেতা। এই জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের মানুষ ও বিশ্বের মুক্তিকামী, স্বাধীনতাকামী মানুষ বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাবে, ভালোবাসা জানাবে।
আমরা আশা করি, এ আয়োজন একদিকে হবে গৌরবের নিরিখে ইতিহাসের উত্তরাধিকার এবং অন্যদিকে স্মৃতিময় ও উৎসবমুখর। আমাদের প্রত্যাশা, তরুণ প্রজন্ম ব্যাপক হারে এ আয়োজনে সম্পৃক্ত হবে। তাঁর জীবনেতিহাস থেকে পাঠ নিয়ে আগামী দিনের বাংলাদেশের কুশীলব হিসেবে তারা আবির্ভূত হবে। বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন এই দেশে। আজ পৃথিবী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতিতে চতুর্থ বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। উদ্ভাবনা ও অগ্রগতির এই বিস্ময়কর যাত্রার সঙ্গে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পাঠ বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশে পরিণত করতে সহায়ক হবে। বঙ্গবন্ধু আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তিনি আমাদের অতীত, বর্তমান ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশ সেই উজ্জ্বলতার আলোকসম্পাতে আলোকিত হবে—বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন আয়োজনের প্রাক্কালে এই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : কবি, সাবেক মুখ্য সচিব ও সদস্যসচিব, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় কমিটি
এসএ/