আজ বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস
তামাকমুক্ত বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে আইনের প্রয়োগ জরুরি
প্রকাশিত : ১১:২৬, ৩১ মে ২০১৯ | আপডেট: ১০:৫৯, ১২ জুন ২০১৯
আজ ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। ১৯৮৭ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং এর সহযোগী সংস্থাসমূহ এ দিনকে ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। এ বছর বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য ‘Tobacco and Lung Health’। বিশ্বব্যাপী অকাল মৃত্যুর ৫টি প্রধান কারণে মধ্যে ২ টিই ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্র সংক্রান্ত অসুস্থতা থেকে হয়ে থাকে। তামাক ব্যবহার এবং পরোক্ষ ধূমপানের ফলে ফুসফুসের যেসমস্ত রোগ হয়ে থাকে তার মধ্যে ফুসফুস ক্যান্সার, ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিস (সিওপিডি), যক্ষা এবং অ্যাজমা বা হাঁপানি অন্যতম। তামাক ব্যবহারের ফলে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৮০ লাখ মানুষ মারা যায়। এছাড়া পরোক্ষ ধূমপানের কারণেও বহু মানুষ মৃত্যু বরণ করে।
কেবল সিগারেট বা বিড়ি নয়, নানা ধরণের ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য যেমন জর্দ্দা, গুল, সাদাপাতা ইত্যাদিও ফুসফুসের অপূরণীয় ক্ষতি করে থাকে। ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের মধ্যে অন্তত ৩০ ধরনের কার্সিনোজেন বা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক রয়েছে। এরমধ্যে বিশেষ ধরনের নাইট্রোস্যামিন পাওয়া যায়, যা ফুসফুস ক্যন্সারের জন্য দায়ী বলে প্রমাণিত হয়েছে। ফুসফুস ছাড়াও মুখগহবর, গলনালী এবং পাকস্থলী ক্যান্সারের জন্যও দায়ী ধোঁয়াবিহীন তামাক।
বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অব টোব্যাকো কন্ট্রোল (FCTC)- এর প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ। তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোও সোচ্চার রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে এবং রাজস্ব আয় বাড়াতে সরকার প্রতি বছর বাজেটে সিগারেটের দাম বাড়িয়েছে ও উচ্চহারে কর আরোপ করেছে। তামাক পণ্যের প্যাকেটে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্ক বার্তা প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতো উদ্যোগ নেওয়া সত্ত্বেও দেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমছে না।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিগারেটের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে ধূমপায়ী কমানোর উদ্দেশ্যে চলতি ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে সিগারেটের মূল্য প্রায় ৩০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে এক বছরে নিম্নস্তরের ১০ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেটের দাম আট টাকা বেড়ে ২৭ টাকা থেকে ৩৫ টাকা হয়েছে। বাংলাদেশে সিগারেট উৎপাদনের জন্য কোম্পানীগুলোকে সর্বোচ্চ ৮১ ভাগ কর পরিশোধ করতে হয়। এটা পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আট বছরে ধূমপায়ী কমেছে ২৭ লাখ। সরকার ও তামাক বিরোধী সংগঠনগুলোর নানামূখী পদক্ষেপের কারণে ধূমপায়ীর সংখ্যা কমলেও অন্যদিকে বাজারে অবৈধভাবে ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া সিগারেটের দৌরাত্ম বেড়েছে। ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরের তুলনায় ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে কোন কোন সিগারেটের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুন। এ দাম বৃদ্ধির সুযোগে দেশব্যাপী ২০ টি অবৈধ প্রস্তুতকারী প্রায় ৫০ টি ব্র্যান্ডের সিগারেট বাজারে ছেড়েছে। ফলে এখাত থেকে সরকার বছরে প্রায় ২০০০ কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে।
এদিকে ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন লঙ্ঘন করে জেটিআই বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশের পর থেকেই বিভিন্ন উপায়ে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাপান ভ্রমণের ইতিহাস নিয়ে জনপ্রিয় অভিনেতা ও শিল্পী তাহসানের একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গণমাধ্যম ও দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। এই প্রমোশনাল বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়েছে জাপান টোব্যাকোর ব্র্যান্ড কালার ও স্লোগান ‘জাপানিজ কোয়ালিটি’। অথচ আইন অনুযায়ী, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোনও তামাকজাত পণ্য বা তামাকের ব্যবহার প্রবর্ধনের উদ্দেশ্যে যে কোনো ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা নিষিদ্ধ এবং দণ্ডনীয় অপরাধ।
বর্তমানে যে হারে ধূমপায়ী কমছে তাতে আগামী ২১ বছরের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জন কঠিন। সংশ্লিষ্টদের মতে, এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে অন্যতম একটি বাঁধা হচ্ছে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত অবৈধ সিগারেট। এছাড়া সম্প্রতি আইন ভঙ্গ করে তামাকজাত দ্রব্যের প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছে জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনালের (জেটিআই) মতো সিগারেট কোম্পানী। এ ধরনের প্রচারণাও সরকারের লক্ষ্য অর্জনের জন্য অশনি সংকেত।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আইন ভঙ্গ করে সিগারেট কোম্পানীর এ ধরনের প্রচার-প্রচারণা এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত অবৈধ সিগারেটের সহজলভ্যতা সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য অর্জনকে বাঁধাগ্রস্ত করছে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই এই অবৈধ তামাকের বাজার ও বেআইনি প্রচার-প্রচারনা বন্ধ করতে হবে। এজন্য এই খাতে মাঠপর্যায়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সহ সংশ্লিষ্টদের কঠোর নজরদারি বাড়ানোর বর্তমান আইনের প্রয়োগ জরুরি দরকার।
টিআর/