ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

যোগ ব্যায়াম কেন করব?

প্রকাশিত : ১৫:১৮, ২১ জুন ২০১৯ | আপডেট: ১৫:২২, ২১ জুন ২০১৯

 

আজ ২১ জুন, বিশ্ব যোগ দিবস। ২০১৪ সাল থে‌কে এই দিবস‌টি জা‌তিসংঘ স্বীকৃতি দেয়। ভারতীয় দূতাবা‌সের সহ‌যো‌গিতায় রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দে‌শের ৮টি শহ‌রে এই দিন‌টি উৎস‌বের সা‌থে পালিত হচ্ছে।

ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টে‌ডিয়া‌মে ক‌য়েকহাজার মানু‌ষের উপ‌স্থি‌তি‌তে যোগব্যয়াম প‌রিচালনা করেন কলকতার এক‌টি যোগব্যয়াম স্কু‌লের প্র‌শিক্ষক। ইয়োগা বা যোগব্যায়াম একটি শাস্ত্রীয় কৌশল-যা পাঁচ হাজার বছরেরও পুরনো।

প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের মুনি ঋষিরা তাদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখা এবং দীর্ঘজীবনের জন্য বিভিন্ন কলাকৌশল আবিষ্কার বা আয়ত্ত করেন। প্রায় ৪০০ বছর আগে সর্বপ্রথম ঋষি পতঞ্জলি কিছু আসনের কথা বলেন এবং এগুলো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন।

পরে ধীরে ধীরে এই কলাকৌশল ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর সর্বত্র। উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর দিকে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় ‘পতঞ্জলিআসনা’ নামে গ্রন্থটি ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে আরো অনেকেই যোগব্যায়াম এর ওপর বেশকিছু গ্রন্থ রচনা করেন।

যোগ আসলে কী? কী এর রহস্য? এর উৎস কোথায়? 

‘ইয়োগা’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ‘যুবক’ বা ‘যৌবন’। এটি মূলত সংস্কৃত শব্দ। বাংলায় ‘যোগ’। যার অর্থ গ্রন্থিভূক্ত করা বা সমন্বয় সাধন করা। কীসের সমন্বয় সাধন? অর্থাৎ মানুষের দেহ ও মনের যৌবন ধরে রাখার কৌশল। এটা নিয়ে অনেকে অনেক রকম মতামত প্রকাশ করেছেন।

কেউ বলেছেন আত্মা বা মন ও শরীরকে একত্র করার কৌশলকে ইয়োগা বা যোগ বলে। হটযোগ শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা অনুযায়ী দেহযন্ত্রগুলোর কর্মক্ষমতাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করে স্নায়ুতন্ত্রের পূর্ণ পরিচর্যার মাধ্যমে মনোদৈহিক সম্পর্কসূত্রগুলোকে প্রকৃতিগতভাবেই একাত্ম করা।

এর মৌলিক ধারণা হচ্ছে ‘শরীরমাদ্যং খলু ধর্ম সাধনম্। ‘হঠযোগ’ হঠাৎ কোন আবিষ্কার নয়। প্রাচীন মুনি ঋষিরা যোগীশ্বর মহাদেবকে হঠযোগের ৮৪০০০ আসনের প্রকাশক বলে স্বীকার করে নিয়ে তাঁর ধ্যানে এই দুঃসাধ্য সাধনায় আত্মনিয়োগ করতেন।

ইয়োগা বা যোগব্যায়াম শুধু রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণই করে না; রোগ নিরাময়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভারত উপমহাদেশে এর উদ্ভাবন হলেও আজ সারা বিশ্বে ইয়োগা চর্চা বিকাশ ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

শুধু যুক্তরাষ্ট্রে দুই কোটি মানুষ ইয়োগা চর্চা করছেন। ইতিবাচক চিন্তা, প্রাণায়াম, নিউরোবিক জিম, মেডিটেশনের সমন্বয়ে ইয়োগার পরিপূর্ণ প্রয়োগ মানুষকে তার ভেতরের সুপ্ত অসীম শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারে।

জাতিসংঘ ২১ জুনকে আন্তর্জাতিক ইয়োগা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং ১৯০টি দেশের ২৬০টিরও বেশি শহরে তা পালিত হচ্ছে। যোগব্যায়ামকে জীবনযাপনের অংশ করে তুলতে পারলে দেহ-মনের সুস্থতা ও শান্তি নিশ্চিত হবে।

ওজন কমানো, শক্তিশালী নমনীয় শরীর, উজ্জ্বল ত্বক, শান্ত মন, ভালো স্বাস্থ্য ইত্যাদি যা কিছু আমরা পেতে চাই সব কিছুর চাবি আছে যোগাসনে। এতে অনেক রকম শারীরিক সমস্যা যথা- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, করোনারি আর্টারি ব্লকের ইত্যাদি রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব এবং শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে সুস্থ জীবন কাটানো সম্ভব।

যোগ হল এক জীবনদর্শন, যোগ হল আত্মানুশাসন, যোগ হল এক জীবন পদ্ধতি। যোগ শুধু বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিই নয়, বরং যোগের প্রয়োগ ব্যাধিকে নির্মূল করে। এটি এক বিধাতা প্রদত্ত শুধু শরীরেরই নয়, পুরো মানসিক রোগেরও চিকিৎসা শাস্ত্র। যোগ অ্যালোপ্যাথির মতো কোনো লাক্ষণিক চিকিৎসা নয়, বরং রোগের মূল কারণকে নির্মূল করে আমাদের ভেতর থেকে সুস্থ করে তোলার এক উপায়।

ইয়োগা বা যোগব্যায়াম সাধারণত তিনটি প্রধান কাঠামোর ওপর নির্মিত হয়। যেমন ব্যায়াম, শ্বাস এবং ধ্যান। ব্যায়াম ও বিভিন্ন আসনের মাধ্যমে শরীরকে নিজের আয়ত্তে আনার কৌশল জানা যায় এবং বিভিন্ন রোগ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা যায়। এছাড়া যোগব্যায়াম স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য এবং শিথিলকরণ একটি পথ।

যোগাভ্যাস একটি নিয়মিত অভ্যাস। দু’দিন করে ছেড়ে দিলে হবে না, নিয়মিত অভ্যাসের মাধ্যমেই এর সুফল পাওয়া সম্ভব। নিজে নিজে অভ্যাস না করে একজন ট্রেনারের অধীনে এগুলো অভ্যাস করা ভালো। এখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যোগব্যায়াম চর্চা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।

প্রয়োজন বুঝে ট্রেইনার নির্দেশ দিয়ে থাকেন ঠিক কোন ধরনের আসনগুলো করা উচিত। এর পাশাপাশি নানারকম রোগ যোগাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, অ্যাজমা, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য, মাইগ্রেন, দুশ্চিন্তা এবং অবসাদ ইত্যাদি।

বিশেষ কয়েকটি যোগাসন (প্রাণায়াম, মেডিটেশন, রিউরোবিক জিম ও আকুপ্রেসার) নিয়মিত অভ্যাসের মাধ্যমে এ ধরনের রোগগুলো থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া যেতে পারে এবং অনেকেই ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কলস্টেরল ও অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন।

প্রতিদিন আমাদের নানা ধরনের কাজের চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তবে ইয়োগা বা যোগব্যায়াম সেসব চাপ কমাতে সাহায্য করে। সব ধরনের বিশৃঙ্খলা এড়িয়ে, স্থিরচিত্তে বসে, শরীর ও মনের যত্ন নিতে শেখায় যোগব্যায়াম। মনের ভারসাম্য বজায় রাখতে যোগব্যায়ামের বিকল্প নেই।

যোগব্যায়াম স্নায়ু শান্ত রাখতে সাহায্য করে এবং মানসিক চাপ দূর করে। বেহিসাবিভাবে খেলে শরীরের ক্ষতি হয়। এমন খাদ্যাভ্যাস পরিহারে প্রয়োজন নিজের মনের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখা। যোগব্যায়াম মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে সাহায্য করে।

যারা নিয়মিত যোগব্যায়াম করেন, তারা মন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন সহজেই। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে যোগব্যায়াম। রাগ নিয়ন্ত্রণ, অতিরিক্ত আবেগ কিংবা কঠিন পরিস্থিতিতে ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করার মতো অভ্যাস গড়ে ওঠে যোগব্যায়ামের মাধ্যমে। হতাশা কাটানোর জন্য যোগব্যায়াম বেশ উপকারী। যোগব্যায়াম মাদকাসক্তি নিরাময়ে কার্যকর।

অন্যান্য ব্যায়ামের সাথে যোগ-ব্যায়ামের পার্থক্য কোথায়?

এ বিষয়ে বলা যায়, ব্যায়ামের উদ্দেশ্য যদি হয় দেহে অসাধারণ পুষ্টি ও অমিত শক্তিধারণ, তবে তা ইয়োগা বা যোগ-ব্যায়াম দ্বারা সম্ভব নয়। আর যদি হয় ব্যায়ামের উদ্দেশ্য শরীরকে সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম রাখা, দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখা এবং জ্বরা-বার্ধক্যকে দূরে রাখা, তাহলে এ ক্ষেত্রে ইয়োগার জুড়ি নেই।

সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বলতে যদি দেহের স্বাভাবিক গঠন, পুষ্টি ও শক্তিলাভ বোঝায়, এটা যোগ-ব্যায়াম দ্বারাই সম্ভব। এই সুস্থতার চাইতে স্ফীত পেশী ও অমিত শক্তিলাভ কি খুব গুরুত্বপূর্ণ?

দেহে শুধু মাংসপেশী অস্বাভাবিক স্ফীত হলে বা অসাধারণ শক্তি থাকলেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না বা তার অধিকারীকে সুস্থদেহী বলা যায় না। হতে পারেন এরা মাসলম্যান, কিন্তু এদের দেহে প্রায়ই অকালে জ্বরা-বার্ধক্য দেখা দেয় বা মৃত্যু হাতছানি দেয়।

এর কারণ আর কিছুই না। দীর্ঘকাল যন্ত্র নিয়ে বা অতিরিক্ত শ্রমসাধ্য ব্যায়াম করলে শরীরের অত্যধিক শক্তি ক্ষয় হয়, দেহে অত্যধিক পৈশিক ক্রিয়া হয়। দেহে যতো বেশি পৈশিক ক্রিয়া হয়, শরীরে ততো বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়।

আর দেহে যতো বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া ততো বেশি বৃদ্ধি পায়। কারণ হৃদযন্ত্র এই বিষাক্ত গ্যাস দেহ থেকে বের করে দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে। শারীর বিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী দেহে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের পরিমাণ আমাদের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।

একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় যে অতিরিক্ত শ্রমসাধ্য কাজে বা দৌড়ানোর সময় আমাদের হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পায়, জোরে বা দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস বইতে থাকে। কেন এমন হয়? অত্যধিক পৈশিক ক্রিয়ার কারণে দেহে প্রচুর কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়।

আর ঐ গ্যাস দেহ থেকে বের করে দিতে হৃদযন্ত্র ও ফুসফুস তার ক্ষমতা অনুযায়ী সচেষ্ট হয়ে উঠে। ঠিক একইভাবে শ্রমসাধ্য ব্যায়ামেও হৃদযন্ত্রকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়।

কিন্তু দিনের পর দিন যদি হৃদযন্ত্রকে এইভাবে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়, তবে তার কর্মক্ষমতা হ্রাস পায় এবং সেও দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে।

অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান শ্রমসাধ্য ব্যায়ামে দেহের পেশীর পুষ্টি ও ওজন বাড়তে থাকায় দুর্বল হৃদযন্ত্র বিশাল দেহ চালানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং একদিন বিকল হয়ে পড়ে। মূলত ওই ব্যায়ামগুলো কেবল পেশীবৃদ্ধির দিকেই নজর দেয় বলে যোগ-ব্যায়াম ছাড়া অন্য কোন ব্যায়ামে দেহের সর্বাঙ্গীন ব্যায়াম হয় না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ইয়োগার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে দেহের স্নায়ুতন্ত্র  ও দেহযন্ত্রগুলোর স্বাস্থ্য ও কর্মক্ষমতা ঠিক রাখা। স্নায়ুতন্ত্র দেহযন্ত্রকে পরিচালিত করে দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে খবরাখবর মস্তিষ্ক ও সুষুম্নাকাণ্ডে পৌঁছে দেয়, আবার সেখান থেকে আদেশ-নির্দেশ বহন করে দেহের প্রয়োজনীয় অঙ্গকে চালিত করে।

তাই দেহের কোন অংশের স্নায়ু যদি বিকল হয়ে যায়, দেহের সেই অংশটি অসাড় হয়ে পড়ে। আজ পর্যন্ত অন্য এমন কোন ব্যায়াম আবিষ্কৃত হয়নি যার দ্বারা এই অত্যাবশ্যক স্নায়ুতন্ত্রের ব্যায়াম হয়।

কুস্তি বা উগ্র যন্ত্র-ব্যায়ামে এই স্নায়ুজাল অনেক সময় বিকল হয়ে যায়, মস্তিষ্ক ও হৃদযন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। কেননা এই সকল ব্যায়ামে আসলে দেহের শুধু কয়েকটি নির্দিষ্ট অংশের ব্যায়াম হয়।

জীবদেহের সকল যন্ত্রই তন্তুময়। এই তন্তু কোষ দ্বারা গঠিত। কোষের গঠন, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য দরকার হয় নিয়মিত প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ এবং নালীহীন গ্রন্থিসমূহের প্রয়োজনমতো রস-নিঃসরণ।

অন্যদিকে চাই দেহের বিষাক্ত ও অসার পদার্থের অপসারণ। কোষের গঠন, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য দরকার প্রোটিন, শর্করা ইত্যাদি নানাজাতীয় খাদ্য ও অক্সিজেন।

এই অক্সিজেন আমরা প্রায় সবটুকুই পাই প্রশ্বাসের মাধ্যমে। সুতরাং দেহের পরিপাকতন্ত্র ও শ্বাসযন্ত্র যদি সবল ও সক্রিয় না থাকে, তাহলে দেহের কোষ, তন্তু বা পেশী কিছুই সুস্থ থাকতে পারে না।

শ্বাসযন্ত্র ও পরিপাক যন্ত্রগুলো দেহের দেহগহ্বরে অবস্থিত। দেহগহ্বর দু’ভাগে বিভক্ত। বক্ষ-গহ্বর ও উদর গহ্বর। হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস থাকে বক্ষ-গহ্বরে। এবং পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র, অগ্ন্যাশয় প্রভৃতি পরিপাক-যন্ত্রগুলো উদর গহ্বরে অবস্থিত। এই দুই গহ্বরের মাঝে ডায়াফ্রাম নামে একটি বিশেষ ধরনের শক্ত পেশীর পর্দা আছে।

ফুসফুসের নিজের কোন কাজ করার ক্ষমতা নেই। ডায়াফ্রাম-এর পেশী, বক্ষ-প্রাচীর ও পেটের দেয়ালের পেশীর সাহায্যে তাকে কাজ করতে হয়। শ্বাস নেয়ার সময় ডায়াফ্রাম উদর গহ্বরে নেমে যায় এবং চাপ দেয়। ফলে উদরস্থ যন্ত্রগুলি একটু নিচের দিকে চলে যায় এবং তলপেট উঁচু হয়ে উঠে।

আবার পেট ও তলপেটের পেশী সংকুচিত হলে এবং ডায়াফ্রামের পেশী প্রসারিত হলে শ্বাস বেরিয়ে যায়। পরিপাক-যন্ত্রগুলি যথাস্থানে ফিরে আসে। এইভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে পরিপাক-যন্ত্রগুলোও উঠানামা করে। ফলে স্বতঃক্রিয়ভাবে মৃদু মর্দন হয় বা ব্যায়াম হয়।

পরিপাক ক্রিয়া সক্রিয় রাখতে হলে পেট ও তলপেটের পেশীগুলোর সঙ্কোচন ও প্রসারণ ক্ষমতা বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন। হজমশক্তিহীন ব্যক্তিদের তলপেটের পেশী শক্ত ও দুর্বল হয়ে যায়।

ভুজঙ্গাসন, উষ্ট্রাসন, ধনুরাসন, অর্ধ-চন্দ্রাসন প্রভৃতি আসনগুলো তলপেটের সম্মুখস্থ পেশীগুলো প্রসারিত ও পিঠের পেশীগুলো যেমন সংকুচিত করে, তেমনি পদ-হস্তাসন, যোগমুদ্রা, পশ্চিমোত্থানাসন, জানুশিরাসন, হলাসন প্রভৃতি আসনগুলো পেটের পেশীগুলো সংকুচিত ও পিঠের পেশীগুলো প্রসারিত করে।

অর্ধ্বমৎস্যেন্দ্রাসন দ্বারা পেট ও পিঠের দু’পাশের পেশীর উত্তম ব্যায়াম হয়। শলভাসনের দ্বারা ডায়াফ্রাম-এর খুব ভালো ব্যায়াম হয়। আবার উড্ডীয়মান ও নোলি দ্বারা তলপেটের পেশীর আরো ভালো ব্যায়াম হয়। এবং প্রাণায়াম-এর মতো হৃদযন্ত্রের জন্য উপযুক্ত আর দ্বিতীয় ব্যায়াম নেই।

রক্ত সংবহনতন্ত্রের মাধ্যমে আমাদের দেহের সর্বত্র রক্ত চলাচল করে এবং রক্ত থেকে দেহকোষগুলো প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করে। এই রক্ত-সংবহনতন্ত্রের প্রধান যন্ত্র হচ্ছে হৃৎপিণ্ড। তাছাড়া ধমনী শিরা , জ্বালকশ্রেণী  এবং লসিকানালী এই তন্ত্রের অন্তর্গত। হৃৎপিণ্ড এক বিশেষ ধরনের পেশী দ্বারা নির্মিত।

দেহে রক্ত চলাচল এই হৃৎপিণ্ডের পেশীর সম্প্রসারণ ও সঙ্কোচন ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। হলাসন, সর্বাঙ্গাসন, শলভাসন প্রভৃতি আসন দ্বারা হৃৎপিণ্ডের খুব ভালো ব্যায়াম হয়। সমস্ত দেহে রক্ত আনা-নেয়া করতে ধমনী ও শিরার মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়।

ধমনীর যেমন দেহের উপরাংশে রক্ত পাঠাতে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়, তেমনি দেহের নিম্নাংশ থেকে রক্ত টেনে আনতে শিরার অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়।

আর এই মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে কাজ করতে হয় হৃৎপিণ্ডকে। সর্বাঙ্গাসন, শীর্ষাসন প্রভৃতি আসনকালে হৃৎপিণ্ড কিছুক্ষণের জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম থেকে বিশ্রাম পায়। এই সব আসনে দেহের উধ্বাংশে প্রচুর রক্ত সঞ্চালিত হয়।

অক্সিজেন দেহকোষের পুষ্টির অন্যতম উপাদান। অত্যাবশ্যক এই অক্সিজেনের প্রায় সবটাই আমরা শ্বসন প্রক্রিয়ায় বায়ু থেকে ফুসফুসের মাধ্যমে পাওয়া যায়।

সুতরাং ফুসফুসের পেশী ও বায়ুকোষের কর্মক্ষমতা কমে গেলে দেহে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে, দেহে দেহকোষ গঠন ও পুষ্টিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়, শরীরও দুর্বল হয়ে পড়ে।

প্রতি ৩ মিনিটে একবার করে ২৪ ঘণ্টায় ৪৮০ বার দেহের সমস্ত রক্ত ফুসফুসের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বা চালিত হয়। দেহের এমন একটি অত্যাবশ্যক যন্ত্রের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য শলভাসন, উষ্ট্রাসন, ধনুরাসন প্রভৃতি আসন ও প্রাণায়াম ছাড়া আর কোন ব্যায়াম আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

দেহযন্ত্রগুলোর স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য দেহে বিপাক ক্রিয়ার  মাধ্যমে উৎপন্ন বিষাক্ত গ্যাস ও অসার পদার্থ দেহ থেকে বের করে দেয়া অবশ্যই দরকার, এটা আগেই বলা হয়েছে।

কার্বন-ডাই-অক্সাইড, ইউরিয়া, ইউরিক প্রভৃতি অ্যাসিড এবং মল-মূত্র প্রভৃতি অসার পদার্থ দেহে জমে থাকলে প্রথমে দেহে নানাপ্রকার ব্যাধির সৃষ্টি করে, পরে দেহের সব যন্ত্র বিকল করে দেয়।

শেষ পরিণাম হয়তো অকালমৃত্যু। দেহযন্ত্র কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃশ্বাসের সাহায্যে, কফ-পিত্তাদি মলের সঙ্গে অথবা মুখ দিয়ে, আর ইউরিক ও ইউরিয়া প্রভৃতি অ্যাসিড মুত্রের সঙ্গে দেহ থেকে বের করে দেয়।

আর লবণজাতীয় বিষাক্ত পদার্থগুলো ঘর্মগ্রন্থির সাহায্যে ত্বকের মাধ্যমে ঘামের আকারে দেহ থেকে বের হয়ে যায়। সুতরাং, এই সব নিঃসারক যন্ত্রগুলো সুস্থ ও সক্রিয় থাকলে দেহে উৎপন্ন এই সব বিষাক্ত ও অসার পদার্থ সহজেই দেহ থেকে বের হয়ে যেতে পারে।

শ্বাস-যন্ত্রের কথা আগেই বলা আছে, দেহের বৃক্কদ্বয়, মূত্রাশয়, মলনালী প্রভৃতি সুস্থ ও সক্রিয় রাখতে নোলি, উড্ডীয়মান ইত্যাদি যোগ-ব্যায়াম অতুলনীয়। অন্য কোন ব্যায়ামে শরীরের এই সকল যন্ত্রের সঠিক ব্যায়াম হয় না।

মানব দেহের গ্রন্থিগুলো প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। নালীযুক্ত ও নালীহীন। লালাগ্রন্থি, ঘর্মগ্রন্থী, অশ্র“গ্রাবী প্রভৃতি গ্রন্থিগুলো নালীযুক্ত গ্রন্থি।

লালাগ্রন্থি থেকে রস নিঃসৃত হয়ে খাদ্যের সঙ্গে মিশে খাদ্য পাকস্থলীতে পৌঁছুতে ও হজম হতে সাহায্য করে। ঘর্মগ্রন্থির সাহায্যে দেহ থেকে ঘাম বের হয়, আর অশ্রুগ্রাবী-গ্রন্থির জন্য চোখ দিয়ে জল পড়ে। থাইরয়েড, প্যারা-থাইরয়েড, পিটিউটারি, পিনিয়্যাল, অ্যাড্রিনাল প্রভৃতি গ্রন্থিগুলো নালীহীন গ্রন্থি।

এই সব গ্রন্থি থেকে যে রস নিঃসৃত হয়, তাকে হরমোন বলে। হরমোন রক্তের সঙ্গে সরাসরি মিশে যায় এবং দেহের সকল ইন্দ্রিয় ও যন্ত্রের গঠন, পুষ্টি ও সক্রিয়তায় সাহায্য করে। একমাত্র যোগ-ব্যায়াম ছাড়া আজ পর্যন্ত এমন কোন ব্যায়াম আবিষ্কৃত হয়নি, যার দ্বারা গ্রন্থি সুস্থ ও সক্রিয় রাখা যায়।

ওষুধ খেলেই রোগ নিরাময় হয় না, সঙ্গে কিছু নিয়ম-নিষেধও মানতে হয়। তেমনি শুধু যোগ-ব্যায়াম অভ্যাস করলেই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া যায় না, কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয় বৈ কি।

নিয়মিত যোগ-ব্যায়াম অভ্যাসে শরীর সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকে, এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু সাথে চাই পরিমিত ও যতদূর সম্ভব নিয়মিত আহার, বিশ্রাম, সংযম, নিয়মানুবর্তিতা, আত্মবিশ্বাস, অটুট মনোবল ও একাগ্রতা।

লেখক ও সাংবাদিক


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি