অগ্নিঝরা ৩ মার্চ: স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা ঘোষণার দিন আজ
প্রকাশিত : ১৪:৫৪, ২০ মার্চ ২০২০
আজ ৩ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঘোষিত হয় স্বাধীনতা-সংগ্রামের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সব রাজনৈতিক ও আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এ দিনটিতেই।
পূর্বসিদ্ধান্তের আলোকে আজকের দিনে ঘোষণা করা হয়- এ দেশের নাম হবে ‘বাংলাদেশ’, পতাকা হবে সবুজ জমিনের মাঝে লাল সূর্য, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর সৃষ্টি ‘আমার সোনার বাংলা’ হবে জাতীয় সঙ্গীত, বঙ্গবন্ধু হবেন জাতির পিতা আর ‘জয় বাংলা’ হবে জাতীয় স্লোগান।
বঙ্গবন্ধুকে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক মনোনীত করে গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধের সব রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণও হয় ঐতিহাসিক এই দিনে। গুলি করে নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা, জেল-জুলুম-অত্যাচার ও একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার দাবিতে এদিন সারা দেশে স্বতঃস্ফূর্ত সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর পূর্বঘোষিত এ হরতাল সফল করার জন্য লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষ ভোর থেকে বাঁশের লাঠি হাতে রাস্তায় নেমে আসেন।
অন্যদিকে এই দিনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট লে. জেনারেল ইয়াহিয়া খান দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য প্রধান কয়েকটি রাজনৈতিক দলের (সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী) ১০ জন নেতার বৈঠক আহ্বান করেন।
আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি, মুসলিম লীগ, ন্যাপ, জামায়াতে ওলামায়ে পাকিস্তান, জামায়াতে ইসলামী ও পিডিপির নেতাদের বৈঠকে আহ্বান করা হলে আওয়ামী লীগ প্রধান ও বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের কাণ্ডারি বঙ্গবন্ধু ওই বৈঠককে ‘নিষ্ঠুর তামাশা’ আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেন।
বিকালে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ আয়োজিত পল্টনের বিশাল জনসভায় প্রধান অতিথির ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, দু’দিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে বহু নিরপরাধ বাঙালিকে হত্যা করেছে। এ দেশের মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় কেনা অস্ত্র দিয়ে নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে।
কিন্তু এগুলো করে স্বাধিকারের আন্দোলন-সংগ্রাম স্তব্ধ করা যাবে না। ৪ থেকে ৬ মার্চ দেশব্যাপী ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু দেশের খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেন। তিনি ঘরে ঘরে সংগ্রাম কমিটি ও মুক্তিবাহিনী গঠনেরও আহ্বান জানান।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান, শ্রমিক নেতা আবদুল মান্নান প্রমুখ বক্তৃতা করেন। সভায় ঘোষণাপত্র ও প্রস্তাব পাঠ করেন ছাত্রলীগ নেতা এমএ রশীদ এবং ইশতেহার পাঠ করেন ছাত্রলীগ নেতা শাজাহান সিরাজ।
৫ দফা ঘোষণাপত্র ও ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা ঘোষণা করা হয়। এতে বলা হয় , জাতীয় পতাকা হবে ‘সবুজের মধ্যে লাল সূর্য’ এবং জাতীয় সঙ্গীত হবে ‘আমার সোনার বাংলা’। তাছাড়া ৪ দফা ও ১৬ উপদফার স্বাধীনতার ইশতেহারে বলা হয়, আজ থেকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা করা হল।
৫৪ হাজার ৫০৬ বর্গমাইলের ভৌগোলিক এলাকায় ৭ কোটি মানুষের আবাসভূমি স্বাধীন-সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম হবে ‘বাংলাদেশ’। মুক্তিবাহিনীর প্রধান হবেন কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী।
বাংলার প্রতিটি ঘরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া এবং সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয় ঘোষণাপত্রে। এতে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়।
দেশের প্রতিটি অঞ্চলে স্বাধীনতা-সংগ্রাম কমিটি ও মুক্তিবাহিনী গঠন করে শত্র“র উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার কথাও বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, বর্তমান সরকারের সব আইনকে বেআইনি ঘোষণা করা হল। প্রতিটি অবাঙালিকে শত্রু বলে গণ্য করা হবে। খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দিতে হবে।
পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করতে হবে। লাখো মানুষের এ সভায় ঘোষণাপত্র ও ইশতেহার পাঠের সঙ্গে সঙ্গেই জনসমুদ্র থেকে গগনবিদারী স্লোগান ওঠে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো; মুজিব তুমি এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার পিছে; জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’
স্বাধিকার আন্দোলনের এ নিনাদ ও যুদ্ধডাকের লেলিহান শিখা স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়ায়। ঘরে ঘরে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি।