অগ্নিঝরা ২৯ মার্চ:সেদিন চট্টগ্রামের সমাবেশে যা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু
প্রকাশিত : ১১:২৫, ২৯ মার্চ ২০২০
আমি বুড়ো হচ্ছি। আজকাল আর দীর্ঘ বক্তৃতা করতে পারি না। ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম সফরে গিয়ে পলোগ্রাউন্ডের জনসভায় ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ কথা বলেন। তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিরামহীন বক্তৃতা করে যেতে পারতেন। একাধিকবার তিনি তার ভাষণ শেষ করেছেন বলার সঙ্গে সঙ্গেই জনতা চিৎকার করে তাকে বক্তৃতা চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানায়। বঙ্গবন্ধু তাদের অনুরোধের একপর্যায়ে বলেন, ‘আমি বড্ড ক্লান্ত। আমি আর দীর্ঘ বক্তৃতা করতে পারি না।’
বঙ্গবন্ধু বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পৌঁছলে তাকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানো হয়। দৈনিক বাংলার ৩০ মার্চের পত্রিকার খবরে বলা হয়, ২৯ মার্চ সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে গভর্মেন্ট হাউসের দিকে বঙ্গবন্ধুর হেলিকপ্টারটি দৃষ্টিগোচর হওয়া মাত্র ভোর থেকে অপেক্ষমান হাজার হাজার মানুষ আনন্দ-উল্লাসে মুখর হয়ে ওঠে। এরপর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারটি গভর্মেন্ট হাউসের মুক্ত উঠানে নামলে বাঁধ ভাঙার মতো জনতা চঞ্চল হয়ে ওঠে।
বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে বলেন, ‘ধনীদের তিনি আরও ধনী হতে দেবেন না। ১৯৭২ সালের ২৯ মার্চ বিকালে পলোগ্রাউন্ড অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় ভাষণদানকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ হবে কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মানুষের দেশ। ধনীদের এখানে আরও ধনী হতে দেওয়া হবে না।’ ব্যাংক-বিমা চটকল চিনিকল জাতীয়করণের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি জানি শিল্পপতিরা খুশি হননি। কিন্তু এখন থেকে শিল্পপতিদের জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠান আমি আমার নিজের জন্য জাতীয়করণ করিনি, জনগণের জন্যই করেছি। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষই এখন সম্পত্তির মালিক।’ তিনি বলেন, ‘অশুভ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আমি জনগণের শক্তি নিয়েই মোকাবিলা করবো। এসব ব্যক্তি যে কোনও দল আর যে কোনও সংস্থারই হোক না কেন।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোনও বিশেষ শ্রেণির নেতৃত্ব আমি দেই না, আমি সমগ্র জনগণের নেতা। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রীতি ও শুভেচ্ছা রয়েছে আমার সঙ্গে।’
জনগণের টাকায় ভরণপোষণ হয় মনে করিয়ে দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনারা আপনাদের কর্তব্য করে যান। জনগণকে ভালোবাসতে চেষ্টা করুন। ভুলে যাবেন না, জনগণের টাকায় আপনি আপনার পরিবারের ভরণ পোষণ করছেন।’
অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে এক সতর্কবাণী উচ্চারণ করে তিনি বলেন, ‘মুনাফাখোর যদি অবিলম্বে তাদের মনোভাব পরিবর্তন না করে, তাহলে তাদের নির্মূল করে দিতে আমি পুলিশের নয় জনগণের সাহায্য চাইবো।’ তিনি জনগণকে বেতন বৃদ্ধি সম্পর্কে ধৈর্যধারণ করতে এবং আপাতত ঘেরাও করা থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেন। ব্যক্তিগত স্বার্থ ভুলে নিষ্ঠার সঙ্গে জাতি পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেন, ‘আপনারা যদি সবাই পুনর্গঠনের কাজে হাত না লাগান— তাহলে জাতিকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।’
জাতীয়করণ কর্মসূচি বানচালের চেষ্টা করলে শক্ত হাতে তা দমন করা হবে বলে বার সমিতির সভায় বঙ্গবন্ধু হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, ‘কেউ যদি সরকারের জাতীয়করণ কর্মসূচি বানচাল করার চেষ্টা করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে এক সতর্কবাণী উচ্চারণ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষই আমার ক্ষমতার উৎস, সেনাবাহিনী ও পুলিশ আমার ক্ষমতার উৎস নয়।’
পাকিস্তানের দোষরদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, জেনেশুনে যারা পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছে, আমার সরকার অবশ্যই তাদের বিচার করবে এবং শাস্তি দেবে। তবে অবস্থার চাপে পড়ে যারা হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছে, তাদের অবস্থা অবশ্যই বিবেচনা করা হবে।’ প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন, যুদ্ধাপরাধীদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হবে এবং ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার করা হবে। পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধুর বলেন, ‘এরা এতদূর পর্যন্ত গিয়েছিল যে, একজন পাকিস্তানি মেজর জেনারেল তার ডায়েরিতে লিখেছিল— সবুজ বাংলাদেশ লাল হয়ে যাক।’
বঙ্গবন্ধু দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের ছাত্র কৃষক-শ্রমিক আর সাধারণ মানুষ যখন মুক্তিসংগ্রামে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে, ঠিক সেই সময়ে নিজেদের শিক্ষিত অভিজাত ও ভদ্র বলে দাবি করে— এমন কতিপয় বাঙালি শত্রুর সঙ্গে সহযোগিতা করেছে।’ এই ধরনের দালালির দায়ে যারা দোষী, তাদের ক্ষমা করা যায় কিনা প্রধানমন্ত্রী শ্রোতাদের কাছে জানতে চাইলে সবাই একযোগে নেতিবাচক জবাব দেন।
ক্ষমাকে দুর্বলতা ভাববেন না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সাধারণত বিপ্লবী সরকার পূর্ববর্তী সরকারের কর্মচারীদের অপসারিত করে। কিন্তু আমি বাংলাদেশে আগেকার সরকারি কর্মচারীদের তাদের কাজে বহাল থাকতে দিয়েছি। তাই বলে সরকারি কর্মচারীরা যদি নিজেদের কেউকেটা ভাবতে শুরু করে, তাহলে তারা ভুল করবেন।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার জনগণের সঙ্গে আমি কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। আমার কাছ থেকে ক্ষমা পেয়ে কেউ যদি সেটাকে আমার দুর্বলতা মনে করে, তাহলে ভুল করবেন। প্রয়োজন হলে আমি আবারও সংগ্রামের আহ্বান জানাবো।’