রোজ ১৬ হাজার কল
কেমন চলছে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯
প্রকাশিত : ২০:০৩, ১১ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ২১:১৫, ২০ মার্চ ২০১৮
৯ মার্চ, ২০১৮। রাত ১১ টা ১৪ মিনিট। খুলনার খালিশপুর থেকে একটি ফোন আসে জাতীয় জরুরি সেবা- ৯৯৯ অফিসে। যিনি ফোন করেছেন তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি জানালেন, মুন্নী নামের ১৭ বছরের এক তরুণী আত্মহত্যা করার জন্য গাছে উঠেছে। যেকোনো সময় গাছ থেকে লাফিয়ে পড়তে পারে। কিন্তু তাকে গাছ থেকে নামানো যাচ্ছে না।
সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় জরুরি সেবা- ৯৯৯ থেকে ফোন করা হলো খালিশপুরের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অফিসে। ফোন পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি টিম গাড়িসহ হাজির হয় মুন্নীদের বাড়িতে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কৌশলে গাছ থেকে নামিয়ে আনল মুন্নীকে। আত্মহত্যা থেকে বেঁচে গেল একটি প্রাণ। আত্মহত্যার মতো আবেগী একটি সিদ্ধান্ত থেকে একটি উঠতি বয়সী তরুণীকে বাঁচাতে এভাবেই ভূমিকা রেখেছে জাতীয় জরুরি সেবা-৯৯৯।
৬ মার্চ রাতে সাতক্ষীরার দেবহাট থানার এসআই আবদুল কাদেরের নেতৃত্বে একটি টিম সেখানকার নয়াপাড়ার নয়াবাংলা নামক স্থানে অপহরণের শিকার হওয়া আবুল হোসেন ( ৩২) নামে এক ব্যবসায়ীকে উদ্ধার করে। শুধু তাই নয়, গ্রেফতার করা হয় অপহরণকারী চক্রকে। দেবহাটা থানায় ফোন দিয়ে এই অপহরণ ঘটনা জানানো হয় জাতীয় জরুরি সেবা- ৯৯৯ অফিস থেকে। জাতীয় জরুরি সেবা -৯৯৯ অফিসে এজন্য সাহায্য চেয়ে ফোন করা হয় ৬ মার্চ রাত ৯ টা ১৬ মিনিটে। শুধু অপহরণকারীকে গ্রেফতার করেই ক্ষান্ত থাকেনি দেবহাটা পুলিশ। অপরাধী যেন কোনো অবস্থায় পার না পায় তার জন্য আইনী প্রক্রিয়া চলছে।
এভাবেই জাতীয় জরুরি সেবা- ৯৯৯ এখন বিপদে পড়া মানুষের জন্য একটি আস্থার নাম। যে কেউ যেকোনো সময় বিপদে পড়ে যেকোনো মোবাইল থেকে ৯৯৯- এ ফোন করলে এ সেবা পাওয়া যায়। পুলিশি এই সেবা পেতে ফোন কলে কোনো বিল কাটা হয় না। মোবাইলে টাকা না থাকলেও ফোন করা সম্ভব।
বাড়ছে ৯৯৯’র গ্রহণযোগ্যতা
গত বছরের ১২ ডিসেম্বর চালু হওয়া জাতীয় জরুরি সেবা- ৯৯৯ ধীরে ধীরে পরিচিতি পাচ্ছে। এর আবেদনও বাড়ছে। গত সপ্তাহে (৪ মার্চ থেকে ১০ মার্চ) জরুরি সেবা চেয়ে জাতীয় জরুরি সেবা- ৯৯৯ এর অস্থায়ী কার্যালয় পুলিশ কন্ট্রোল রুমে মোট ১ লাখ ১৬ হাজার তিনশ’ ছিয়াশিটি ফোন এসেছে। এর মধ্যে বিপদে পড়ে ভিকটিম নিজে বা প্রত্যক্ষদর্শী ঘটনাস্থল থেকে ফোন করেছেন ১ হাজার একশ’ ছয়টি। ১০ মার্চ জাতীয় জরুরি সেবা-৯৯৯ অফিসে সাহায্য চেয়ে ফোন এসেছে ১৬ হাজার চারশ’ তেরটি। জাতীয় জরুরি সেবা- ৯৯৯ এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পুলিশ সুপার মো. তবারক উল্যাহ`র সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোজ গড়ে ষোল থেকে আঠার হাজার কল আসে। তবে এর মধ্যে মাত্র শতকরা ১৯-২০ ভাগ কলের ডাকে সাড়া দেওয়া সম্ভব হয়েছে। যেসব ফোন কল পেয়ে তড়িৎ গতিতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে ৬০ ভাগ ফোন এসেছে পুলিশের সাহায্য চেয়ে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চুরি, ছিনতাইসহ নানা ধরনের অপরাধজনিত কর্মকাণ্ডে পুলিশের সাহায্য চেয়ে এসব ফোন করা হয়। শতকরা ২৫- ২৮ ভাগ লোক ৯৯৯- এ ফোন করেছেন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তাৎক্ষণিক ফায়ার সার্ভিসের সাহায্য চেয়ে। অন্যরা অ্যাম্বুলেন্সের সাহায্য চেয়ে ফোন করেছেন। বাকিরা বিপদে পড়ে পুলিশি সেবা পেতে ফোন করেছেন।
এত কল এলেও কেন মাত্র ১৯-২০ ভাগ লোকের ফোন কলে সাড়া দেওয়া হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার তবারকউল্যাহ বলেন, বাকিগুলো অপ্রয়োজনীয় কল। কেউ হয়তো ভুলে কল করে। শিশুরা দুষ্টুমী করে কল করে, এমন সংখ্যাও কম নয়। সহকারী পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, অনেকে পরীক্ষার রুটিন, মোবাইল সংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়েও ফোন করে। যদিও তা আমাদের বিষয় নয়।
জাতীয় জরুরি সেবা- ৯৯৯ এর কার্যক্রম পরিচালিত হয় রাজধানীর আবদুল গণি রোডের পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সপ্তাহে (৪ মার্চ থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত) জাতীয় জরুরি সেবা-৯৯৯ এর সাহায্য নিয়ে বাল্যবিয়ে ঠেকানো গেছে ৫৪ টি। সড়ক দূর্ঘটনায় আহত ব্যাক্তিকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যপারে ৯৯৯- এ ফোন করে সাহায্য পেয়েছেন অন্তত ৯৪ জন। এছাড়া ৩৯২ টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ডাকতে সাহায্য করেছে ৯৯৯। নারী সহিংসতা বা নারী নির্যাতনের ঘটনায় সেবা গ্রহিতার সংখ্যা কম হলেও এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন জাতীয় জরুরি সেবা কর্তৃপক্ষ। তারা জানান, গত এক সপ্তাহে ( ৪ মার্চ থেকে ১০ মার্চ) পর্যন্ত সারাদেশ থেকে ৩৬ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়ে পরামর্শের জন্য বা সাহায্য চেয়ে জাতীয় জরুরি সেবা- ৯৯৯ অফিসে ফোন করেছেন।
সদা প্রস্তুত ৯৯৯
কী দিন, কী রাত সব সময় ৯৯৯ - এর কর্মীরা সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। ৫ মার্চ রাত ৯ টা ৪৭ মিনিটে জাতীয় জরুরি সেবা- ৯৯৯ অফিসে সেবা চেয়ে ফোন আসে। ফোনে বলা হয় রাজধানী খিলগাঁওয়ে দক্ষিণ গোড়ানের ৩৩৩, বি/ এ বাসায় এক প্রবীণ ব্যক্তি বাথরুমে পড়ে আহত হন। জাতীয় জরুরি সেবা- ৯৯৯ অফিসে ফোন করে সাহায্য চান তারা। জাতীয় জরুরি সেবা- ৯৯৯ অফিস থেকে সেবা হিসেবে তাৎক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্স ডেকে দেওয়া হয়। অ্যাম্বুলেন্স আহত ব্যক্তিকে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে মুগদা সরকারী হাসপাতালে পৌঁছার ব্যবস্থা করে। তার আগের দিন ৪ মার্চ রাত ১ টা ৩৪ মিনিটে জরুরি সেবা চেয়ে ফোন আসে জাতীয় জরুরি সেবা- ৯৯৯ অফিসে। ফোনে বলা হয়, চট্টগ্রামের পটিয়ায় এক গরু ব্যবসায়ী তার ১০টি গরু বোঝাই ট্রাক নিয়ে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে যায়। জাতীয় জরুরি সেবা- ৯৯৯ অফিস থেকে সঙ্গে সঙ্গে পটিয়া ফায়ার সার্ভিস অফিসে যোগাযোগ করা হলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে ১০ টি গরুসহ ওই আহত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে।
জনবল সঙ্কট
গত বছরের ১২ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হলেও পুলিশের পরিচালনায় জাতীয় জরুরি সেবা- ৯৯৯ এখনো সব ধরণের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এই সেবা পরিপূর্ণভাবে দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জনবল ও সরবরাহ সেবা নিশ্চিত করা এখনও সম্ভব হয়নি বলে জানান পুলিশ সুপার তবারকউল্যাহ। তিনি একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, আমাদের quick response team নেই। এমন টিম দরকার যারা দেশের সব প্রান্তে সব সময় শুধুমাত্র ৯৯৯ সেবা দিতে প্রস্তুত থাকবে। এখন পর্যন্ত আমাদের সেসব সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, আমাদের সড়ক ব্যবস্থা নাজুক। নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি পৌঁছাতে তাই অনেক সময় লেগে যায়। এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯- কে আরো জনপ্রিয় করা সম্ভব নয়।
অপ্রয়োজনীয় ফোন নয়
দেশের যেকোনো ব্যাক্তি যেকোনো জায়গা থেকে যে কোনো সময় `৯৯৯` নাম্বারে ফোন করে জরুরি সেবা চাইতে পারেন। এখান থেকে সাধারণত তিন ধরনের সেবা দেওয়া হয়। সেবাগুলো হলো, পুলিশি সেবা, অ্যাম্বুলেন্স সংক্রান্ত সেবা ও ফায়ার সার্ভিস সংক্রান্ত সেবা। রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে আপনিও নিজের জন্য বা অন্যের জন্য প্রয়োজনে এ সেবা নিতে পারেন। জরুরি সেবা পেতে ফোন কলের জন্য কোনো বিল কাটা হয় না। মোবাইলে টাকা না থাকলেও `৯৯৯`- এ ফোন করা সম্ভব। অপ্রয়োজনে ফোন না করার পরামর্শ দিয়ে পুলিশ সুপার তবারকউল্লাহ বলেন, অপ্রয়োজনে বা বিনা প্রয়োজনে ফোন করবেন না। ফোন করার পর, নির্দেশনা অনুযায়ী গুছিয়ে নিজের পরিচয় দিন। এরপর যে সেবাটি চেয়েছেন তা বলুন। অপ্রয়োজনীয় কথা না বলাই ভালো। নিজেও সেবা নিন। অন্যদেরকে সেবাটি নিতে সচেতন করুন।
/ এআর /