ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

করোনায় হাঁসফাঁস করছে মধ্যবিত্ত

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:৫৪, ৪ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ১৪:৪২, ৪ জুলাই ২০২০

(ছবি- রয়টার্স)

(ছবি- রয়টার্স)

করোনাকালে গরিবের জন্য খাদ্য ও অর্থ সহায়তা আছে। উচ্চবিত্তের জন্য আছে শিল্পের প্রণোদনা। কিন্তু মধ্যবিত্তের জন্য কী আছে? বিশ্বব্যাংক আর গবেষকরা মধ্যবিত্তের একটা চেহারা দাঁড় করিয়েছেন আয় অথবা ক্রয় ক্ষমতা দিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশে এই করোনায় ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত চেনা যাচ্ছে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। কারণ মধ্যবিত্ত ত্রাণের লাইনে দাঁড়াতে পারেন না। অভাবের কথা মুখ ফুটে বলতেও পারেন না। মধ্যবিত্তের অবস্থান মাঝখানে। তাই না পারে নীচে নামতে, না পারে উপরে উঠতে৷ এই করোনাকালে তাই সে হাঁসফাঁস করছে মধ্যবিত্ত। খবর ডয়চে ভেলে’র। 

কারা মধ্যবিত্ত?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা জরিপ অনুযায়ী করোনার আগে বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ২০.৫ ভাগ দারিদ্র্য সীমার নীচে ছিল। আর চরম দরিদ্র ছিল ১০ ভাগ। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, এক জনের দৈনিক আয় এক ডলার ৯০ সেন্ট হলে ঐ ব্যক্তিকে দরিদ্র  ধরা হয় না। এর নীচে হলে দরিদ্র। এখন মধ্যবিত্তের আয়সীমা কত? এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বলছে, এক ব্যক্তির ক্রয় ক্ষমতা (পিপিপি) যদি প্রতিদিন দুই মার্কিন ডলার থেকে ২০ মার্কিন ডলারের মধ্যে হয় তাহলে তাকে মধ্যবিত্ত বলা যায়। এই হিসেবে তারা বলছে, বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত হলো ৩ কোটি ৭ লাখ। বিশ্বব্যাংকের মধ্যবিত্তের আয়ের হিসেবটি একটু বেশি। যাদের প্রতিদিন আয় ১০ থেকে ৫০ ডলার, তারা মধ্যবিত্ত।

তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুই থেকে ৪ ডলার প্রতিদিনের আয় হলেই মধ্যবিত্ত। সেই হিসেবে যার মাসিক আয় ৪০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা সেই মধ্যবিত্ত। এটা বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৩০ ভাগ। ১৬ কোটি মানুষের হিসেবে সংখ্যাটি দাঁড়ায় চার কোটি ৮০ লাখ। বিআইডিএস’র সাম্প্রতিক জরিপে বলা হচ্ছে, করোনায় এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে, দারিদ্র্য সীমার নীচে নেমে গেছে। তাই এখন দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা পাঁচ কোটির বেশি।

মধ্যবিত্ত কি দরিদ্র হচ্ছে?
এই যে দেড় কোটি লোক নতুন করে দরিদ্র হলেন, তারা কি মধ্যবিত্ত ছিলেন? চট করে এর জবাব দেয়া কঠিন। দারিদ্র্য সীমার একটু উপরে একটি বড় জনগোষ্ঠী আছে। তারা যে কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকে দরিদ্র হয়ে যান। আবার পরে পরিস্থিতি কটিয়ে ওঠেন। ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক কে এ এম মোরশেদ বলেন, ‘দিনে ১.৯ ডলারের দ্বিগুণ যাদের আয় তাদের আমরা বলি নিম্ন মধ্যবিত্ত। এরাই এখন সবচেয়ে বেশি সংকটের মুখে আছেন। তারাই হয়তো দরিদ্রের কাতারে নেমে গেছেন। কিন্তু যারা মধ্যবিত্ত, তারা এখনো টিকে আছেন। তাদের সংখ্যা হয়তো ঠিকই থাকবে। হয়তো ব্যক্তির পরিবর্তন হবে। কারণ নতুন পরিস্থিতিতে পেশার পরিবর্তন হবে। নতুন ধরনের ব্যবসা আসবে, কাজ আসবে। কেউ ভালো অবস্থায় যাবেন। আবার কেউ খারাপ অবস্থায় পড়বেন।’

বিআইডিএস’র জরিপ
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান’র (বিআইডিএস) জরিপে দেখা গেছে, করোনায় ফর্মাল সেক্টরে কাজ করা ১৩ শতাংশ মানুষ চাকরি হরিয়েছেন। যাদের আয় ১১ হাজার টাকার কম তাদের ৫৬.৮৯ শতাংশ পরিবারের আয় বন্ধ হয়ে গেছে, ৩২.১২ শতাংশের আয় কমে গেছে। যাদের আয় ১৫ হাজার টাকার মধ্যে তাদের ২৩.২ শতাংশের আয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ৪৭.২৬ শতাংশের আয় কমে গেছে। আর যাদের আয় ৩০ হাজার টাকার বেশি তাদের ৩৯.৪ শতাংশের কমেছে এবং ৬.৪৬ শতাংশের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। এই জরিপে কিন্তু মধ্যবিত্তের ওপর করোনার অভিঘাত স্পষ্ট।

৩০ ভাগ মধ্যবিত্ত হওয়ার প্রত্যাশা কি পূরণ হবে?
২০১৫ সালে বিআইডিএস’র অর্থনীতিবিদ ড. বিনায়ক সেন তার এক গবেষণায় দেশের ৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষকে মধ্যবিত্ত বলেন। যারা দিনে দুই থেকে তিন ডলার আয় (পিপিপি) করেন তাদের তিনি মধ্যবিত্তের মধ্যে ফেলেন। আর তখন সংখ্যাটা ছিল মোট জনগোষ্ঠীর ২০ ভাগ। তিনি তখন ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৩০ শতাংশ মধ্যবিত্ত হবে বলে আশা করেন। তিনি তার গবেষণায় বলেন, বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের ৪৮.৪ শতাংশ বেসরকারি চাকরি করেন। ২০ শতাংশের বেশি সরকারি চাকরি করেন। প্রায় ২২ শতাংশ ব্যবসা করেন। নিম্নমধ্যবিত্তের মধ্যে ৫১.৬ শতাংশ বেসরকারি চাকরি করেন। আর ব্যবসায় যুক্ত ১৭ শতাংশ। মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাটে থাকে কিংবা জমির মালিক। টাকা-পয়সা রাখে ব্যাংক হিসাবে। ২৩.৪৯ শতাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করেন।

বিআইডিএস’র অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদের মতে ১৫-২০ ভাগ মানুষ দারিদ্র্য রেখার খুব কাছে অবস্থান করে। সেই সংখ্যাটাও ৩ কোটির মতো। যে কোনো দুর্যোগ এলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিবিএস’র খানা জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের নীচের দিক থেকে প্রথম ৫০ ভাগ মানুষের হাতে মোট আয়ের ২০ ভাগ। শীর্ষ ১০ ভাগের হাতে মোট আয়ের ২৮ ভাগ। এর মানে হলো, মাত্র ১০ ভাগ মানুষের হাতে ৫০ ভাগ মানুষের হাতে যে সম্পদ আছে তার চেয়েও ৮ ভাগ বেশি আছে। বাকি ৪০ ভাগ মানুষের হাতে ৪২ ভাগ আয়। এরাই হয়তো মধ্যবিত্ত। তিনি বলেন,‘নিম্নমধ্যবিত্ত যারা আছেন, তারা দরিদ্র হয়ে পড়ছেন। সম্পদের অসম বন্টন এই পরিস্থিতিকে আরও প্রকট করছে।’ আর মধ্যবিত্তেরও তিনটি শ্রেণি আছে- নিম্ন, মধ্য এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত।

তারা ঋণগ্রস্থ হচ্ছেন
বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের চাকরির আয় এরই মধ্যে ঝুঁকির মুখে পড়েছে। একটি অংশের চাকরি আছে, কিন্তু বেতন নেই। আবার কারও বেতন কমে গেছে। এসএমই সেক্টরে ধস নেমেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক ও ‘উন্নয়ন অন্বেষণের’ চেয়ারপার্সন ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন,‘যারা সরকারি চাকরি করেন তাদের আপাতত কোনো সংকট হবে না। কিন্তু যারা বেসরকারি খাতে আছেন তারা এখন জমানো টাকা খাওয়া শুরু করেছেন। এটা শেষ হলে ঋণ করে অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করবেন। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে তারা ঋণগ্রস্থ হয়ে নিম্নবিত্তের কাতারে নেমে যাবেন।’

বাংলাদেশে ৯০ লাখ মানুষ আনুষ্ঠানিক খাতে চাকরি করেন। এর মধ্যে ১৫ লাখ সরকারি খাতে। বাকি ৭৫ লাখ মানুষ বেসরকারি খাতে ৷ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন ছয় কোটি ৮ লাখ মানুষ। বিবিএস’র খানা জরিপে মোট ১০টি ইনকাম গ্রুপ আছে। এর মধ্যে পাঁচ থেকে সাত এই তিনটি ইনকাম গ্রুপকে মধ্যবিত্ত বলতে চান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনামিক মডেলিং’র (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। তার মতে, পঞ্চম টায়ারে যারা আছেন, তারা নিম্ন মধ্যবিত্ত। এরা সব চেয়ে ঝুঁকির মুখে আছেন। ষষ্ঠ টায়ারও ঝুঁকিপূর্ণ ৷ আয় কমে গেলেই তারা দারিদ্র্য সীমার নীচে চলে যাবেন, এবং তাই হচ্ছে৷ ড. সেলিম রায়হান বলেন,‘‘বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র্যসীমার ১.৯ ডলারের যে হিসাব তার পরেও একটা হিসাব আছে দুই থেকে তিন ডলারের৷ তারাই এখন বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।’

এমএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি