বেড়েছে সাপের কামড়ে মৃত্যু : আতঙ্কিত না হয়ে সচেতনতা জরুরী
প্রকাশিত : ১৬:১৩, ১০ জুলাই ২০২০
সাপ নিয়ে মানুষের ভীতি, আতঙ্ক, উচ্ছ্বাস ও কৌতূহলের শেষ নেই। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবছর প্রায় ৫০ লাখ মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে প্রায় ২৫-২৭ লাখ মানুষের শরীরে বিষ প্রবেশে প্রায় দেড় লাখের মৃত্যু ও প্রায় ৫ লাখ অন্ধ ও চিরস্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে পড়ছেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আমাদের দেশেও প্রতি বছর আনুমানিক ৬ লাখ মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন এবং মৃত্যুবরণ করেন প্রায় ৬ হাজার।
আমাদের দেশে সাধারণত ৫ ধরনের বিষাক্ত সাপ রয়েছে- গোখরা, কেউটে, চন্দ্রবোড়া, সবুজ সাপ ও সামুদ্রিক সাপ। বর্ষাকালে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এই সময় সাপ বাইরে বেরিয়ে আসে বেশি। আর সাপ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কামড় দেয় পায়ে। এছাড়া সাপের কামড়ে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে বন্যা।
গবেষকরা বলছেন, সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন গ্রামের কৃষক সম্প্রদায়ের মানুষ। তারা বর্ষা মৌসুমে সর্পদংশনের বড় ঝুঁকিতে থাকেন। তাছাড়া গ্রামে রান্নাঘর এবং গোলাঘরে ইঁদুরের উপদ্রব হওয়ায়, সাপের বিচারণও সেখানে বেশি থাকে। কারণ সাপ সাধারণত ইঁদুর জাতীয় প্রাণী খায়। কাজেই শহরাঞ্চলে এবং গ্রামের মানুষের বাসার আশেপাশেই তাদের ঘোরাফেরা বেশি।
অনেক গ্রামীণ এলাকার জনগণ সাপের কামড়ের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। তারা ক্ষেতে কাজ করা সময়, যাতায়াতের সময় বা এমনকি রাতে ঘরে ঘুমানোর সময়ও এই ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে তরুণ কৃষকরা। তাদের পরে ঝুঁকির মুখে রয়েছে শিশুরা।
এছাড়া বন্যার পানিতে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে সাপ। প্রতি বছর বন্যায় সাপের কামড়ে অনেক মানুষ মারা যায়। অনেক সময় বিষধর সাপের কামড়ে বেঁচে গেলেও বিভিন্ন ধরনের পঙ্গুত্ব ও মানসিক সমস্যায় ভোগেন অনেকে।
ব্লিউএইচও বলছে, প্রতিবছর ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে ২ লাখ ৭০ হাজারের মতো মানুষ সাপের কামড় খেয়ে থাকেন৷ এর মধ্যে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ৩৮ হাজার জনের মৃত্যুর হিসাব বিভিন্ন পরিসংখ্যানে পাওয়া যায়।
তবে সঠিক হিসাবে এই সংখ্যা অনেক বেশি বলেই মনে করছে ডাব্লিউএইচও৷ আর চিকিৎসা ও অ্যান্টি-ভেনমের অভাবে সাপের কামড়ে মৃত্যুর সংখ্যা উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই বেশি।
সাপের কামড়ে মৃত্যু ও প্রতিবন্ধিত্ব কমিয়ে আনতে ২০৩০ পর্যন্ত মেয়াদে একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ডাব্লিউএইচও।
সংস্থাটির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, অ্যান্টি-ভেনম ও আনুষঙ্গিক চিকিৎসায় মানুষের জন্য নিরাপদ, কার্যকর ও সহজলভ্য অভিগম্যতা নিশ্চিত করা৷ এতে অ্যান্টি-ভেনম উৎপাদন ও সরবরাহকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।’
সরকারিভাবে মৃতের সংখ্যার হিসাব না রাখায় এ ধরনের মৃত্যুর সঠিক হিসাব জানা এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না বলে মনে করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কারণ, হাসপাতালের বাইরে যাঁরা মারা যান, তাঁদের হিসাব পাওয়া দুরুহ।
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সাপ উদ্ধারের ঘটনা সবাইকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে।
সাপের কামড়ের চিকিৎসা নীতিমালা-২০১৯ অনুযায়ী এন্টি স্নেকভেনম আনুষঙ্গিক চিকিৎসা, কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়ে থাকে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের পক্ষ থেকে সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত পরিমাণ এন্টি স্নেকভেনম ও অন্যান্য ওষুধ সরবরাহ করা হয়।
কিন্তু সাপের কামড় সম্পর্কে মানুষের মধ্যে অবৈজ্ঞানিক ভ্রান্ত ধারণা এখনও বিদ্যমান। ফলে দেশে বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে সাপে কামড়ানোর ঘটনা ঘটলেও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার চর্চা এখনও ভালোভাবে শুরু হয়নি।
সাপের দংশন থেকে বাঁচতে এই বর্ষার মৌসুমে সবাইকে সাবধানে চলার পরামর্শ দিয়েছেন সাভারের বেদেপল্লীর একজন সাপুড়ে রমজান আহমেদ। তিনি বাড়িঘর এবং আঙ্গিনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও শুষ্ক রাখার পাশাপাশি রাতের বেলা অন্ধকারে চলাচল না করার পরামর্শ দেন।
এদিকে এই প্রাণীটিকে নির্বিচারে হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুল হাসান খান।
তিনি জানান, বৃষ্টির মৌসুমে সাপের উপদ্রব বেড়ে যাওয়া নতুন কিছু নয়। এসময় সাপের আবাসস্থল ডুবে যাওয়ার কারণে তারা ডিম পাড়তে শুকনো ও উঁচু ভূমিতে আসে। এছাড়া বিষধর গোখরা এবং কেউটে সাপের মূল খাবার ইঁদুর হওয়ায় তারা লোকালয়ের আশেপাশে বাসা বাঁধে।
তবে প্রতিবার এভাবে সাপ মেরে ফেলায় জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে।
তিনি বলেন, সাপ মারা গেলে ইঁদুরকে প্রাকৃতিকভাবে দমন করা কঠিন হয়ে পড়বে। যার বিরূপ প্রভাব পড়বে ফসলে।
এছাড়া মেডিকেল গবেষণায় সাপের বিষ খুবই মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় একটি উপাদান হওয়ায় এ প্রাণীটি সংরক্ষণের মাধ্যমে তার সুবিধা কাজে লাগানোর কথাও জানান তিনি।
সাপ সংরক্ষণে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোয় সাপের খামার তৈরির পাশাপাশি এদের না মেরে আশেপাশের সাপুড়েদের খবর দেয়ার কথাও তিনি জানান।
বন সংরক্ষক মোহাম্মদ জাহিদুল কবির জানান, কোন বাড়িতে সাপ পাওয়া গেলে সেটিকে না মেরে বন বিভাগকে খবর দিতে হবে। বাংলাদেশের মাত্র ৫ শতাংশ সাপ বিষধর হয়ে থাকে এবং এই বিষধর সাপগুলো সাধারণত শান্ত স্বভাবের হয়। তাই আতঙ্কিত হয়ে সাপের অযৌক্তিক হত্যা বন্ধ করতে হবে।
এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করে তুলতে প্রতিটি এলাকায় লিফলেট বিতরণ ও মসজিদে মাইকিংয়ের মাধ্যমে প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ গ্রহণের কথা জানান তিনি।
এসএ/