এশিয়ার দেশগুলোর জন্য শ্রীলঙ্কা একটি সতর্কবার্তা
প্রকাশিত : ২১:১৭, ১৮ জুলাই ২০২২
গভীর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা। এই সংকটের প্রেক্ষিতে বিশাল বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। দেশটির জনগণের বিক্ষোভের মুখে এরইমধ্যে পালিয়ে গেছেন রাষ্ট্রপতি। শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতেও বাধ্য হয়েছেন তিনি। এশিয়ার আরও দেশ শ্রীলঙ্কার মতো একই ধরনের সংকটে পরতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ এর প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিভা। এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি।
সম্প্রতি আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেছেন, "উচ্চ ঋণের মাত্রা এবং সীমিত নীতির দেশগুলো অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়বে। এমন দেশগুলোর জন্য একটি সতর্ক বার্তা দিচ্ছে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি।
তিনি বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোও টানা চার মাস ধরে টেকসই মূলধনের বহিঃপ্রবাহের মুখে পড়ছে, যা উন্নত অর্থনীতির পথে বাধা সৃষ্টি করছে।
শ্রীলঙ্কা তার ২২ মিলিয়ন মানুষের জন্য খাদ্য, জ্বালানি এবং ওষুধের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানির জন্য অর্থের যোগান পাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি প্রায় ৫০% এবং খ্যাদ্যের দাম প্রায় ৮০% বেড়েছে দেশটিতে। এই বছর মার্কিন ডলার এবং অন্যান্য প্রধান বৈশ্বিক মুদ্রার বিপরীতে শ্রীলঙ্কার রুপির মূল্যও হ্রাস পেয়েছে।
অনেকে সাবেক রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকসেকে দোষারোপ করেছেন, এবং বলছেন করোনা মহামারীর কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
বছরের পর বছর ধরে, শ্রীলঙ্কা বিপুল পরিমাণ ঋণ করেছে , গত মাসে এটি ২০ বছরে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রথম দেশ হিসেবে বিদেশি ঋণ খেলাপি হয়েছে।
এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশ একই পথে রয়েছে বলে মনে করছেন আইএমএফ প্রধান।
লাওস
পূর্ব এশিয়ার দেশ লাওসে ৭৫ লাখের বেশি মানুষ বাস করে। দেশটি কয়েক মাস ধরে বিদেশি ঋণ শোধ করতে না পেরে দেউলিয়ার ঝুঁকিতে আছে। ইউক্রেনে রাশিয়ান অভিযান শুরুর পর দেশটিতে তেল ও খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, লাওসে জ্বালানি সংগ্রহের জন্য মানুষকে দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। চলতি বছর লাওসের মুদ্রার মান মার্কিন ডলারের তুলনায় এক শতাংশের বেশি কমেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ মুনাফা হারের কারণে ডলার শক্তিশালী হয়েছে। আর তাতে বিভিন্ন দেশের স্থানীয় মুদ্রাগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে ও ঋণের বোঝা বাড়ছে। আমদানি খরচ বেড়ে গেছে।
ইতিমধ্যে অনেক ঋণের মধ্যে থাকা লাওসকে ঋণ শোধ ও জ্বালানি আমদানির খরচ মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, গত বছরের ডিসেম্বরে দেশটির রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার।
তবে ২০২৫ সাল পর্যন্ত দেশটিকে একই পরিমাণে ঋণ শোধ করে যেতে হবে, যা দেশটির মোট দেশজ রাজস্বের প্রায় অর্ধেক।
পাকিস্তান
মে মাসের শেষ থেকে পাকিস্তানে জ্বালানির দাম প্রায় ৯০ শতাংশ বেড়েছে। সরকার জ্বালানি ভর্তুকি বন্ধ করে দেওয়ার পর এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়। দেশটি এখন তাদের খরচের লাগাম টানতে চাইছে।
পণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়ছে দেশটিতে। জুন মাসে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ২১ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
শ্রীলঙ্কা ও লাওসের মতো পাকিস্তানেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। গত বছরের আগস্ট থেকে তা প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে।
এক বছরের জন্য বড় আকারের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ১০ শতাংশ কর আরোপ করেছে পাকিস্তান সরকার। এর মধ্য দিয়ে ১৯৩ কোটি ডলার পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আর এর মধ্য দিয়ে সরকারের রাজস্ব ও খরচের মধ্যকার ব্যবধান কমানোর চেষ্টা করা হবে।
গত মাসে পাকিস্তান সরকারের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দেশটির জনগণকে চা খাওয়ার পরিমাণ কমানোর পরামর্শ দেন। পাকিস্তান বিশ্বের সবচেয়ে বড় চা আমদানিকারক। চা আমদানির জন্য বছরে ৫১ কোটি ৫০ লাখ ডলার পরিমাণ অর্থ খরচ করেছে দেশটি।
মালদ্বীপ
মালদ্বীপে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি ঋণের পরিমাণ বাড়তে দেখা গেছে। এ ঋণের পরিমাণ তাদের জিডিপির তুলনায় ১০০ শতাংশের বেশি।
পর্যটন খাতের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল এ দেশের অর্থনীতিতেও করোনা মহামারির প্রভাব পড়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, দ্বীপ রাষ্ট্রটি সুনির্দিষ্টভাবে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিজনিত ঝুঁকিতে আছে। কারণ, দেশটির অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগ্যান বলছে, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে আছে মালদ্বীপ।
বাংলাদেশ
বাংলাদেশে গেল ৮ বছরের মধ্যে গত মে মাসে মুদ্রাস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৪২ শতাংশে পৌঁছেছে। রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়ায় জরুরি নয় এমন পণ্য আমদানি বন্ধ করতে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। বিদেশে থাকা লাখ লাখ প্রবাসীকে রেমিট্যান্স পাঠানোয় আরও বেশি উৎসাহ দিতে বিভিন্ন নিয়ম শিথিল করেছে এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে ভ্রমণও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল রেটিংসের বিশ্লেষক কিম এং তান বিবিসিকে বলেন, চলতি আয়-ব্যয়ে অর্থনৈতিক ঘাটতির ফলে চলমান অর্থনীতিতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা সরকার ভর্তুকি বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়বে। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য ইতিমধ্যে আইএমএফ ও অন্য দেশের সরকারের দ্বারস্থ হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশকে সরকারি ব্যয়ে পুনঃঅগ্রাধিকার দিতে হবে এবং ভোক্তাদের কেনাকাটার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে।
এসবি/