‘ডেটা সুরক্ষা আইন’ নিয়ে আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের উদ্বেগ কেন?
প্রকাশিত : ১৭:২১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | আপডেট: ১৭:২৩, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
বাংলাদেশের সরকার 'ডেটা সুরক্ষা আইন' প্রণয়নের যে উদ্যোগ নিয়েছে তাতে বেশ খোলামেলা আপত্তি উঠেছে আমেরিকার দিক থেকে। সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে আমরিকার রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, এ ধরণের আইন প্রণয়ন করা হলে আমেরিকান কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে পারে।
রাষ্ট্রদূতের এ বক্তব্য বিভিন্ন মহলে বেশ কৌতুহল তৈরি করেছে। বাংলাদেশ 'ডেটা সুরক্ষা আইন' করলে আমেরিকার আপত্তি কোথায়?
বাংলাদেশ সরকার বলছে, এই আইন বাস্তবায়ন হলে দেশের নাগরিক এবং প্রতিষ্ঠানের তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হবে এবং বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহারকারীদের তথ্য অনুমতি ছাড়া বিক্রি করতে পারবে না।
ডেটা সুরক্ষা কী?
ফেসবুক, টুইটার এবং গুগলসহ ইন্টারনেটে নানা ধরণের ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ ব্যবহার করছেন বাংলাদেশিরা। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের সব তথ্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর কাছে সংরক্ষিত থাকে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশে বসে যারা ফেসবুক ব্যবহার করছেন, তাদের প্রতিটি ক্লিকের তথ্য ফেসবুকের কাছে সংরক্ষিত থাকে। যেমন - আপনি কোথায় লাইক দিচ্ছেন, কী শেয়ার করছেন, কোন ধরণের বিষয় সার্চ করছেন - এ সবকিছুই ফেসবুকের ভান্ডারে জমা থাকে।
এভাবে প্রতিটি অ্যাপ এবং ওয়েবসাইটও তাদের ব্যবহারকারীদের তথ্য সংরক্ষণ করে।
বাংলাদেশ সরকার চায় বাংলাদেশের ভেতর থেকে যারা এসব ব্যবহার করছেন তাদের তথ্যগুলো দেশের ভেতরেই সংরক্ষণ করা হোক। অর্থাৎ সব বিদেশি কোম্পানিকে বাংলাদেশের ভেতরে ডেটা সেন্টারে তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে।
প্রস্তাবিত আইনে কী আছে?
ডেটা বা উপাত্ত সুরক্ষা আইনের প্রস্তাবিত খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ব্যবহারকারীদের তথ্য-উপাত্ত বাংলাদেশের ভেতরে কোনো কেন্দ্র বা ‘ডেটা সেন্টারে’ সংরক্ষণ করতে হবে। মূলত এ বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মি. হাস।
প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ বা সংরক্ষণ করতে হলে তার সম্মতি থাকতে হবে। এ ধরণের তথ্য কেউ সংগ্রহ করতে চাইলে ব্যবহারকারীর সম্মতিপত্র দেখা হবে। কোন স্পর্শকাতর তথ্য সংগ্রহ করা যাবে না। যেসব তথ্য বা উপাত্ত সংগ্রহ করা হবে, তা সংগ্রহকারীর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হতে হবে। 'অপ্রয়োজনীয়' কোন তথ্য সংগ্রহ করা যাবে না।
প্রস্তাবিত আইনে আরো বলা আছে, নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য তথ্য সংরক্ষণ করা যাবে। যে উদ্দেশ্যে তথ্য বা উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে, তা প্রয়োজনীয় না হলে অথবা মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে এসব তথ্য নষ্ট করে ফেলতে হবে। যিনি তথ্য দেবেন, তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হওয়ার কোনরকম সম্ভাবনা থাকলে তথ্য নেয়া যাবে না।
যারা তথ্য সংগ্রহ করবেন, তারা কী উদ্দেশ্যে সেটা নেবেন, কেন ও কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তা তথ্য দাতাকে পরিষ্কার করে বলতে হবে। যে উদ্দেশ্যে তথ্য নেয়া হবে, সেটা অন্য কোন কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
এসব দেখাশুনা, নিয়ন্ত্রণ এবং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি সংস্থা গঠন করা হবে, যার প্রধান হবেন একজন মহাপরিচালক।
উদ্বেগ কেন?
ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার সময় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার জে হাস উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের উপাত্ত বাংলাদেশের ভেতরে সংরক্ষণ বা ‘ডেটা লোকালাইজেশন’ করা হলে অনেক 'স্টার্ট আপ' বন্ধ হয়ে যাবে। অনেক বাংলাদেশি ব্যবহারকারী যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক অনেক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সেবা ব্যবহার করতে পারবেন না।
ডেটা বাংলাদেশে সংরক্ষিত হলে সেখানে বাংলাদেশ সরকারেরও প্রবেশাধিকার থাকবে। সেক্ষেত্রে সেসব তথ্য অন্যদের হাতে চলে যেতে পারে বলে তাদের আশংকা রয়েছে।
গত বছর যখন এই আইনের খসড়া প্রকাশ করা হয় তখন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক প্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইটিআইএফ (ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড ইনোভেশন ফাউন্ডেশন) তাদের এক প্রকাশনায় আশঙ্কা প্রকাশ করে যে ‘ডেটা লোকালাইজেশন’ বাধ্যতামূলক করা হলে পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৬ শতাংশ কমে যাবে।
এই আইন বাস্তবায়িত হলে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্যবসাায়িক লেনদেন রয়েছে এমন অনেক ব্যবসায়ীরাও।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ‘সংবেদনশীল’ ডেটা বাংলাদেশের ভেতরের ডেটা সেন্টারে রাখলে সেই ডেটার সুরক্ষা বিঘ্নিত হতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশের অ্যামেরিকান চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট এরশাদ আহমেদ।
“ব্যবসায়ী হিসেবে আমাদের কাছে অনেক গ্রাহকের তথ্য আছে। তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক হিসেবে একাধিক ব্র্যান্ডের - যারা একে অন্যের প্রতিযোগী – অর্থনৈতিক লেনদেনের তথ্য আমাদের কাছে থাকে। আমরা যখন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য পাঠাই তখন পণ্যের সাথে এই তথ্যও পাঠানো হয়। এখন ডেটা সেন্টার হলে সব ডেটা সেই সেন্টারে রাখতে হবে এবং আন্ত:দেশীয় ডেটা ট্রান্সফার প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে।”
মি. আহমেদের মতে প্রস্তাবিত খসড়ায় ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক উপাত্তের বিষয়টি আলাদাভাবে বিবেচনা করা হয়নি এবং ফেসবুক বা গুগলের মত গ্লোবাল ফার্মগুলোর শর্ত ও নীতিমালা আমলে নেয়া হয়নি।
ডেটা ট্রান্সফার প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়া ছাড়াও যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকলে তথ্য ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে এবং তথ্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে বলেও মনে করেন মি. আহমেদ।
“সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি এখন বিশ্বের সব বড় প্রতিষ্ঠানের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যবহারকারী চাইবেন না যে তাদের তথ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ুক। এসব ঝুঁকির জন্য গ্রাহক বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের ভেতরের ডেটা সেন্টারে নিজেদের তথ্য রাখার ব্যাপারে আগ্রহী হতে চাইবেন না।”
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে যখন এই আইনের খসড়া প্রস্তাব প্রকাশ করা হয় তখনও বেশ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘ডেটা লোকালাইজেশন’ সংক্রান্ত এই ধারাটি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল বলে জানান মি. আহমেদ।
মি. আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশে যেই ডেটা সেন্টারগুলো থাকবে, সেখানে ডেটা কতটা সুরক্ষিত থাকবে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড তারা মানতে পারবে কি না বা সেখানে কী ধরণের ডেটা সংরক্ষিত থাকবে, এসব বিষয়ে প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় অস্পষ্টতা রয়েছে।”
এরশাদ আহমেদ জানান আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের পক্ষ থেকে এসব উদ্বেগের বিষয়ে এরই মধ্যে কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করা হয়েছে।
কর্তৃপক্ষ কী বলছে?
এই আইন বাস্তবায়িত হলে বিদেশের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সেবা ব্যবহার করা বাংলাদেশি নাগরিকদের তথ্যের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ।
এই বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, “প্রত্যেকটা দেশের অধিকার আছে তাদের নাগরিকদের তথ্য নিজেদের দেশের ভেতরে রাখতে চাওয়ার। আমার দেশের ও দেশের মানুষের তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সেই তথ্য আমরা দেশের ভেতরে রাখতে চাই।”
“আমেরিকা তাদের দেশের নাগরিকদের তথ্য তো সারাবিশ্বে ছড়িয়ে রাখে না। তাহলে বাংলাদেশের নাগরিকদের তথ্য দেশের ভেতরে রাখতে চাইলে বাধা কোথায়?”
মি. জব্বার বলেন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের তথ্য-উপাত্ত রাখতে তাদের নিজেদের ডেটা সেন্টার তৈরি করতে হবে না কারণ বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে একাধিক ডেটা সেন্টার রয়েছে।
তিনি প্রশ্ন তোলেন, “অনেক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানই সিঙ্গাপুরে ডেটা সেন্টারে তথ্য সংরক্ষণ করে আঞ্চলিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। সেখানে রাখতে পারলে বাংলাদেশে রাখতে সমস্যা কোথায়?”
তবে মি. জব্বার বলেন প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইনটি এখনও খসড়া পর্যায়ে রয়েছে এবং এতে প্রস্তাবিত নীতিমালা পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে, কাজেই এখনই এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এসবি/