নারীর ভাগ্য উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেন দোহারের আরিফা
প্রকাশিত : ১৬:৪০, ১৩ নভেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১৭:১৮, ২১ নভেম্বর ২০১৭
কিছু মানুষ নিজের পাশাপাশি অন্যের জন্যও চিন্তা করে থাকেন। এজন্য হয়ে উঠেন উদ্যোক্তা। স্বপ্ন দেখেন এবং অন্যকেও স্বপ্ন দেখাতে পছন্দ করেন। তেমনি একজন হলেন দোহারের শতাধিক বেকার নারীর কর্মসংস্থান করে দেওয়া আরিফা আক্তার বেপারী। তিনি স্বপ্ন দেখেন তার এলাকায় বেকার থাকবে না। সবাই কাজ করে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাবেন।
এলাকায় তিনি কারো কাছে আরিফা আপা আবার কারো কাছে আরিফা ভাবি হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। ব্যক্তিগত জীবনে তার দুই সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে সংসার। বড় ছেলে রিজুয়ান বেপারী উপজেলার মইতপাড়ায় ড্যাফোডিলস্ হাই স্কুলের ৭ম শ্রেণির ও ছোট ছেলে রায়য়ান বেপারী সাতভিটা ফাস্টগ্লোরি স্কুলে ২য় শ্রেণির শিক্ষার্থী। স্বামী রজ্জব আলী বেপরী প্রবাসী। সব মিলে আরিফা আক্তার বেপারীর পরিবার সুখী পরিবার হিসেবে পরিচিত।
তবে সুখী এ জীবনের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামের এক ইতিহাস।
এই সংগ্রামের কাহিনী জানতে শনিবার একুশে টেলিভিশন অনলাইনের এ প্রতিবেদক গিয়েছিল আরিফা আক্তার বেপারীর বাড়িতে।
তিনি জানান, ছোটবেলা থেকেই নিজে কিছু করার জন্য এগিয়ে চলেছেন। কখনো পেরেছেন আবার কখনো পারেননি। তাতে কখনো দুঃখ হয়নি। চেষ্টা করেছি অনবরত।
একসময়ে তার ভাবনার আকাশে দোলা দিতে থাকে কীভাবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের প্রসার ও সম্প্রসাণের মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্ত নারীসমাজ গঠন করা যায়। আর এ ইচ্ছাকে মনে প্রাণে ধারন করে বিরামহীনভাবে তার মেধাশক্তিকে কাজে লাগাতে থাকেন। এরমধ্যে পরিবারের সম্মতিতে আরিফা আক্তারের স্বপ্নের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বিয়ে।
কিন্তু তীল তীল করে গড়ে ওঠা আরিফার লালিত স্বপ্নের মৃত্যুঘটেনি বিয়ের কারণে। উল্টো বিয়ের পরেই তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে এক ধাপ এগিয়ে আসে। শুরু হয় আরিফার নতুন করে পথচলা। আর এ কাজে অনুপ্রেরণা ও সহায়তা দিয়েছেন তার স্বামী রজ্জব আলী বেপারী।
২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) থেকে পাটের বহুমুখী ব্যবহারের উপর কসটিং, স্কিল ডেভেলপমেন্ট, হায়ার স্কিল ডেভেলপমেন্ট, কোয়ালিটি ইনপ্রুপমেন্ট, ডাইং, প্রিন্টিংও ফিনিমিয়ের ওপর ২১ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নতুন করে উদ্যোগী হন তিনি। সেখান থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
নিজ বাড়িতে সাতটা সেলাইমেশিন দিয়ে প্রথমে নারীদেরকে হাতে কলমে কাজ শেখান আরিফা আক্তার। এক সময়ে তা ব্যাপক আকার ধারন করে। তার হাতে অন্তত শতাধিক নারী প্রশিক্ষণ নিয়ে সমাজে মাথা উচু করে বাঁচার চেষ্টা করছেন। তাদের একজন নারিশা এলাকার ফরিদা ইয়াসমিন। গত তিন বছর যাবৎ শিখছেন এ কাজ। এখন তিনি থ্রি-পিচ সেলাই, ব্লক, বাটিকের কাজ করেন। তাতে মাসে বেশ টাকা পান ঘরে কাজ করে। এতো গেল ফরিদার কথা। আরিফার কাছ থেকে থ্রি-পিচ, ব্লক বাটিক, ফ্লোর ম্যাট ও চুমকির কাজ শিখে দোহারের চরাঞ্চল নারিশা জোয়ার এলাকার রাসেদা এখন বাড়িতে বসে কাজ করে মাসে অন্তত ১৫-২০ হাজার টাকা আয় করেন।
এছাড়া নারিশা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী সালমা আক্তার, সাদিয়া আক্তারসহ আরও অনেক নারী আরিফার বাতিঘরে এসে নিজের বাতিঘর তৈরি করছেন।
তবে আরিফা আক্তার বেপারী একুশে টেলিভিশনের অনলাইনের এ প্রতিবেদককে আরও জানান, আমার স্বামী ব্যতীত আমার এ কাজের পিছনে যেই মানুষগুলোর সব চাইতে বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছি তারা হলেন- সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীমুল হক পাভেল, নুরুল করিম ভূঁইয়া, সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) শামীম আরা নিপা ও বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কেএম আল-আমীন, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সাদিয়া আফরিন ও সাবেক মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রহিমা বেগম।
তিনি বলেন, তাদের অনুপ্রেরণা ও সার্বিক সহযোগিতা ছাড়া কখনো আমি এতদূর আসতে পারতাম না। বর্তমান ইউএনও কেএম আল-আমীন স্যার আমার এ কাজটাকে সাধুবাদ জানিয়ে তিনি নিজ উদ্যোগে আমাদের এই কর্মমুখী নারীদের জন্য একটি দোকানের ব্যবস্থা করেছেন। যাতে করে আমরা দোহারের প্রাণকেন্দ্র জয়পাড়ায় বসে আমাদের এ শিল্পটাকে এগিয়ে নিতে পারি। চলতি সপ্তাহে জেএসসি পরীক্ষা শেষ হলে উপজেলা জয়পাড়া মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় চালু হতে যাচ্ছে নারীদের কর্মমুখী শিক্ষার কার্যক্রম। যেখানে নারীরা শিখবে ও তৈরি করবে, থ্রি-পিচ, ব্লকবাটিক এর কাজ, পুথি দিয়ে বিভিন্ন হস্তশিল্প, যেমন পার্স ব্যাগ, ফুলদানি ও ঘর সাজানোর জন্য দৃষ্টিনন্দন শো-পিচসহ আরও কত কি। এছাড়া পাট দিয়ে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত নানা ধরনের ব্যাগ, ফ্লোর ম্যাড, জায়নামাজের পাটিসহ আরও অনেক কিছু। পাটের ব্যবহৃত জিনিসপত্র সহজেই বাজারজাত করা যায়, সে লক্ষে তিনি প্রতিদিন কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি একুশে টেলিভিশনের অনলাইনের এই প্রতিবেদককে আরও বলেন, আমার ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। আমার স্বপ্ন ছিল আমি সমাজের অবহেলিত নারীদের জন্য কাজ করবো। সেই স্বপ্ন আমার অনেকটা পূরণ হয়েছে। বাকি জীবনটাও নারীদের জন্য কাজ করতে চাই।
এদিকে আরিফার মেধা ও প্রতিভামূল্যায়ন ঝুলিতে ইতোমধ্যেই আছে ২০১৩ সালে দোহার উপজেলা সেরা জয়িতা পুরস্কার, ২০১৪ সালে ঢাকা জেলা সেরা জয়িতা এবং ২০১৬ সালে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে তিনি একাধারে উপজেলা, জেলা ও ঢাকা বিভাগীয়ভাবে সেরা জয়িতা হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। একাধারে তিনি দোহার উপজেলা মহিলা অধিদপ্তর পরিচালিত উপজেলা মহিলা উন্নয়ন সংস্থার সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আরিফার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে প্রায় ৩০ জন নারী কাজ করেন।
তিনি বলেন, ক্ষুদ্র শিল্পের মাধ্যমে আমাদের নারীরা ঘরে বসেই কাজ করে স্বাবলম্বী হতে পারেন। কেবল প্রয়োজন ইচ্ছা শক্তি। এজন্য সরকারের কাছে তার আবেদন নারী উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের সরকারিভাবে সহায়তা করা। যাতে এ শিল্প দক্ষ শিল্পে পরিণত হবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কেএম আল আমীন বলেন, আরিফা আক্তার বেপারীর কথা আমি শুনেছি। তার সুদক্ষ নেত্রীত্বে একঝাক নারী তার বাড়িতে হাতে কলমে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে। আমি তার ওখানে সরেজমিনে গিয়েছিলাম। তিনি বলেন, ইতমধ্যে আমি এই শিল্পটাকে এগিয়ে নিতে জয়পাড়া মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটে নিজ দায়িত্বে একটি দোকান নিয়ে দিয়েছি। যাতে করে তিনি তার স্বপ্নটাকে আরও এগিয়ে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যা যা করার প্রয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাব।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সাদিয়া আফরিন বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে আরিফা আক্তার দোহার উপজেলায় গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়া সে উপজেলার আটটি বাল্যবিবাহ বন্ধে তার সাহসী ভূমিকা প্রশাসনে অত্যন্ত প্রসংশিত হয়েছে। এজন্য আমাদের দোহার উপজেলা মহিলা অধিদপ্তর তাকে সব সময় সার্বিক সহযোগিতা করে আসছি।
এমএ/এসএইচ/ডব্লিউএন