রাজিবের স্বপ্ন ঘুমায় আইসিইউর বিছানায়
প্রকাশিত : ১৯:১৩, ৮ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ১৫:৪২, ২৯ মে ২০২৩
পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার দাশপাড়া গ্রামের প্রয়াত হেলাল উদ্দিন এবং আকলিমা বেগমের ছেলে বড় ছেলে রাজিব হোসেন। শৈশবে বাবা মাকে হারিয়ে দুই ভাইকে নিয়ে কাটতে থাকে তার অসহায় দিনগুলো। চরম দারিদ্র আর মাথার উপর ছাদশূন্য আকাশ চরম বাস্তবতার রোদে পোড়াতে থাকে তাকে। জীবনের সেই কঠিন বাস্তবতার কাছে হেরে যাননি রাজিব। ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম শুরু করেন।
স্বপ্নবাজ রাজিব প্রায়ই তার ভাইদের বলতেন লেখাপড়া শেষ করে বড় চাকরি নেবেন। তাদের দুঃখ মুছে দেবেন। সবাইকে নিয়ে এক সঙ্গে একই ছাদের নিচে সুখের সংসার পাতবেন।
রাজিবের প্রতিজ্ঞার হাত একে একে তাঁর স্বপ্ন ছুঁতে লাগলো। বড় জীবনের পথে তাঁর স্বপ্ন রচনার মঞ্জিল যেন ধীরে ধীরে নির্মিত হচ্ছিল। আলোর মুখ দেখছিল তার রোদে পোড়া স্বপ্নগুলো। লেখাপড়া শেষ করেই তার দায়িত্ব নেওয়ার পর্ব যখন সামনে ঠিক সেই সময়ে নিয়তির নিষ্ঠুর কষাঘাতে তিনি এখন শয্যাশায়ী। অস্তগামী এক সূর্যের নাম। পোড় খাওয়া জীবনে দারিদ্র আর একটু আশ্রয়ের মত কঠিন পরিস্থিতি যখন তাকে দমাতে পারেনি, অথচ একটি দুর্ঘটনা আজ সারা জীবনের কান্নায় রূপ নিয়েছে। সেই দুর্ঘটনায় পরিশ্রমের হাত হারিয়ে এখন তিনি একরাশ শূন্যতা নিয়ে শুয়ে আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসিইউর ৩০নং বিছানায়।
যে হাতে তাঁর দিন বদলের প্রচেষ্টায় স্বপ্নের মঞ্জিল গড়ে তুলেছে, সে হাতখানা এখন আর নেই। সেই হাতের স্পর্শ করতে পারবে না বাস্তবতার পরশ । এমন কঠিন বাস্তবতা তাকে জেঁকে বসেছে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে। একটি দুর্ঘটনা তাকে যেমন থমকে দিয়েছে একই সঙ্গে স্থবির করে দিয়েছে তার স্বজনদের দৈনন্দিন জীবন।
অন্যান্য আত্মীয়- যাদের জীবন অন্ধকারের মুখে, আলোকিত করবেন তাদেরও। কিন্তু স্বপ্নদ্রষ্টাই এখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন হাসপাতালের বিছানায়। জীবন প্রদীপের সমান্তরালে স্বপ্নগুলোও লড়ছে মৃত্যুর সঙ্গে।
বাবা-মা হারানোর পর রাজিবের দায় দায়িত্ব নেন তার নানা। কিছুদিন পরে নানার মৃত্যু হলে রাজিব ও তার দুই ছোট ভাইয়ের লালন পালনের ভার নেন রাজিবের খালা জাহানারা বেগম । মতিঝিল টিএন্ডটি কলোনিতে থাকতন রাজিব । এখানে থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপরে ডিগ্রীতে ভর্তি হন সরকারি তিতুমির কলেজে । লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি একটি কম্পিউটারের দোকানে কাজ করে নিজের ও তার দুই ভাইয়ের খরচ জোগার করতেন।
আত্মপ্রত্যয়ী স্বপ্নবাজ রাজিব এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের আইসিইউতে নিবিড় ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন । যেন কিছুতেই তার এ ঘুম ভাঙছে না। তার জেগে উঠার অপেক্ষায় বাহিরে অগণিত স্বজন আর শুভাকাঙ্ক্ষী।
মাঝে মাঝে উহ আহ! শব্দে তার কষ্টের কথা সামান্য শব্দে প্রকাশ পায় । আর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্বজন কিংবা চিকিৎসক শুনতে পান রাজিবের সেই নীরব আর্তনাদ।
গত মঙ্গলবার বিআরটিসির একটি দোতলা বাসে পেছনের খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে তার গন্তব্যে যাচ্ছিলেন রাজিব । এ সময় স্বজন পরিবহনের একটি বাস তার বাসটিকে ঘেঁষে ওভারটেক করতে গেলে মাঝখানে চাপা পড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাঁর উপার্জনের ডান হাতখানা। সংকটাপন্ন রাজিব এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন।
শনিবার সরেজমিনে ঢামেক আইসিউতে গিয়ে দেখা যায়, আইসিইউর সামনে মানুষের ভিড় ছাঁটাইয়ে বসে আছে রাজীবের খালা ও দুই ছোট দুই ভাই হাফেজ মেহেদি হাসান (১২) ও হাফেজ আবদুল্লাহ (১১)। সঙ্গে আছে তার দুঃসম্পর্কের দুই মামা। আইসিইউর বিছানায় শুয়ে থাকা রাজিবের ডানদিকটা সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো । কপাল ও মাথার ডানপাশটা বেশ ফোলা । একটু পরপর যন্ত্রণায় আহ্ শব্দ করছেন। মাঝে মাঝে একদৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বন্ধ করে ফেলছে তার দু’চোখ। আর চোখজুড়ে ঝরে পড়ছে বেদনার অশ্রুজল।
রাজিবের শারীরিক অবস্থা নিয়ে কথা হয় তার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান ও ঢামেক হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শামসুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে । তিনি বলেন, রাজিব এখন পর্যন্ত সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। তাকে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার পরও আগের চেয়ে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে।
অধ্যাপক শাহীন জানান, রাজিবের সিটিস্ক্যান ও এক্সরে করা হয়েছে । মাথায় প্রচণ্ড আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে । সামনে-পেছনে মাথার খুলিতে ফাটল দেখা গেছে । তার মগজেও আঘাত লেগেছে । ফাটলের স্থান, মগজ ও চোখের পেছনে রক্ত ও পানি জমাট বেঁধে আছে । এ জন্যই সে কাউকে চিনতেও পারছে না। ওর মাথায় অস্ত্রোপচার করা দরকার । কিন্তু হাতের পরিস্থিতির কারণে এখনই তা করা সম্ভব হচ্ছে না ।
রাজিবের খালা জাহানারা বেগম কেঁদে কেঁদে বলেন, রাজিব আমার বোনের ছেলে। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় তার মা ও অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় বাবাকে হারায়। এরপর থেকে মায়ের স্নেহ দিয়ে আগলে রেখেছি ওদের ।গত দশ বছর ধরে আমার কাছে ছিল। সে আমার বাসায় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে তিতুমীর কলেজে স্নাতকে ভর্তি হয় । কিছুদিন আগে সে যাত্রাবাড়ীতে মেসে উঠে। সে টিউশনি করে নিজের খরচ এবং একটি কম্পিউটারের দোকানে কাজ করে ছোট ভাইদের জন্য লেখাপড়ার খরচ জোগাত। সে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। লেখাপড়া শেষ করে সে নিজের পায়ে দাঁড়াবে তার দুই ভাইয়ের দায়িত্ব নিবে এমন স্বপ্নে সে বিভোর ছিল। কিন্তু সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেও বড় সত্য এটাই আজ তার পরিশ্রমের সেই সোনার হাত দুর্ঘটনায় হারিয়ে ফেলেছে । মাথায় প্রচণ্ড আঘাতের কারণে আমাদেরকে ছিনতে পারছে না।
কেঁদে কেঁদে জাহানারা বলছেন, জানি না এই ছেলেটার জীবনে এত দুঃখ কেন । সে জীবনে হারাতে হারাতে আজ নিজেকেই হারাতে বসেছে সে । এই ঘুম ভেঙে সে উঠবে কি এই প্রশ্ন এখন রাজিবকে দেখাতে আসা সবার।
প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ তাকে এক নজর দেখতে আসে। আইসিইউর কঠিন নিয়ম- শৃঙ্খলা ভেদ করে কেউ তাকে দেখতে পারে কেউ না দেখার কষ্ট বুকে চেপে ফিরে যায়। তবুও মানুষ আসে। এখানে যেন মানুষের জনস্রোত। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজিবকে দেখতে এসেছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ।
রাজিবের মামা জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা ক্ষতিপূরণ চাই না শুধু রাজিবের সুচিকিৎসা চাই। রাজিব যেন তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে এটাই এখন তার স্বজনদের এক মাত্র চাওয়া । আমরা এখন রাজিবকে সুস্থ দেখতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আর্কষণ করে তিনি বলেন, রাজিবকে যেন সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেওয়া হয় । প্রয়োজন হলে যেন বিদেশেও নেওয়া হয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজিব দেখতে এসে সরকারি চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানালে জাহিদুল বলেন, আমার ভাগ্নে যদি বেঁচেই না থাকে, তাহলে চাকরি দিয়ে কি হবে, টাকা দিয়ে কি হবে?
রাজিবের ছোট ভাই হাফেজ মেহেদি হাসান জানায়, মা-বাবা মারা যাওয়ার সময় সে ও তার ছোট ভাই আবদুল্লাহ খুব ছোট ছিল । মা-বাবা বলতে তারা বড় ভাই রাজীবকেই বুঝে।
মেহেদি জানায়, ভাইয়ের জন্য দুই ভাই মিলে কোরআন পড়ছেন। মসজিদে দোয়া করিয়েছেন। ভাইয়ের কিছু হলে আমরা বাঁচব না- এ কথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন মেহেদি। কাতর কণ্ঠে ভাইয়ের সুস্থতার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চান।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাজিবকে দেখতে যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। ওই সময় মন্ত্রী জানান, শমরিতা হাসপাতালে কত খরচ হয়েছে তার হিসাব নেওয়া হবে। ওই টাকাও সরকারের পক্ষ থেকে পরিশোধ করা হবে। এছাড়া তার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ সরকার বহন করবে। সুস্থ হলে রাজীব হোসেনকে সরকারি চাকরি দেয়া হবে।
রাজিবের খালা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘সে (রাজিব) এখনও মাঝে মাঝে বলে আমার ডান হাত সোজা করে দাও, কিন্তু সে তো জানে না যে তার ডান হাত আর নেই’।
লিপি আক্তার বলেন, সে যখন বলে- ‘আমার ডান হাতটা এত ভারী লাগছে কেনো? আমি নাড়াতে পারছি না, একটু সোজা করে দাও’ -এটা শোনার পর আমার যে কী কষ্ট তা বুঝাতে পারবো না । ওর হাত তো সোজা করে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না । ওর তো হাতই নেই কীভাবে সোজা করে দেব!
এমন কথা শুনে উপস্থিত সকলেও শোকার্ত হয়ে পড়েন ।আড়ালে সবার চোখ মোছার দৃশ্য অন্তত তাই বলে।
উল্লেখ্য, গত ৩ এপ্রিল দুপুরে রাজধানীর কারওরান বাজারের সার্ক ফোয়ারার কাছে বিআরটিসির একটি দ্বিতল বাসের পেছনের ফটকে দাঁড়িয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব হোসেন। বাসটি হোটেল সোনারগাঁওয়ের বিপরিতে পান্থকুঞ্জ পার্কের সামনে পৌঁছালে হঠাৎ পেছন থেকে স্বজন পরিবহনের একটি বাস বিআরটিসির বাসটিকে গা ঘেঁষে অতিক্রম করে। এ সময় দুই বাসের প্রবল চাপে গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা রাজীবের ডান হাত কনুইয়ের ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর পর সঙ্গে সঙ্গে রাজিব আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পাই।
এরপর তাকে তাৎক্ষণিকভাবে শমরিতা হাসপাতাল ভর্তি করা হয়। একদিন থাকার চিকিৎসা খরচ না চালাতে পেরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয় ।
কেআই/ এআর