সেন্সরে বাদ যাওয়া সিনেমা-ই গেল সার্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে
প্রকাশিত : ১১:০৩, ১৯ আগস্ট ২০১৮ | আপডেট: ১৪:০৬, ২০ আগস্ট ২০১৮
বাংলাদেশের সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র না পাওয়া সিনেমাই প্রদর্শিত হলো সার্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। আর বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করা এ সিনেমাটিকে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পাঠিয়েছে খোদ সেন্সর বোর্ড। জসিম আহমেদ পরিচালিত ‘দাগ’ সিনেমার ক্ষেত্রে ঘটেছে এমন ঘটনা। এ নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে চলচ্চিত্র পাড়ায়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ‘দাগ’ এর চিত্রনাট্য। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের নারীদের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতন; ১২ মিনিট দৈর্ঘের এই শর্টফিল্মের মূল গল্প। আর এমনই এক নির্যাতনের ঘটনার দৃশ্যায়নে ‘অশ্লীলতার’ অভিযোগে বাংলাদেশে সিনেমাটির প্রদর্শনে বাঁধা দেয় সেন্সর বোর্ড।
দাগ সিনেমা সেন্সর বোর্ডের আটকে দেওয়া সেই চিঠি
কিন্তু আলোড়ন তৈরি হয় যখন এই সিনেমাটিই গত ২২ থেকে ২৭ মে’তে আয়োজিত সার্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশের সিনেমা হয়ে প্রদর্শিত হয়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে প্রদর্শনের অনুমতি না পেলেও বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম বড় আসর কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় সিনেমাটি।
কানে প্রদর্শনের পর যুক্তরাষ্ট্রের ছোট পর্দায় সম্প্রচারের জন্য পরিবেশক পেয়ে যায় জসিম আহমেদের দাগ।
শতাব্দী ওয়াদুদ, শশী ও বাকার বকুলের মতো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে নির্মিত ‘দাগ’ এর পরিচালক জসিম আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, দাগ সিনেমাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বানানো হয়েছে। সেসময় যে বর্বরতা হয়েছে সেটিকেই আমি পর্দায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
সিনেমাটিকে আমরা ২০১৭ সালে শুধু ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখাতে চেয়েছিলাম। আমরা প্রেক্ষাগৃহ অথবা অন্য কোনো বড় জনসমক্ষে এটা দেখাতে চাইনি। কিন্তু আমাদেরকে তখন ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি অশ্লীলতার অভিযোগ তুলে।
সেন্সর বোর্ডের কাছে ‘অশ্লীলতার’ সংজ্ঞা জানতে চেয়ে জসিম আহমেদ বলেন, আমাদের দেশে অশ্লীলতার সংজ্ঞা কী? মুক্তিযুদ্ধে এদেশের মা-বোন ধর্ষিত হয়েছে। এটার দৃশ্যায়ন তো অশ্লীলতা না। এই দৃশ্য দেখলে দর্শকের কান্না পাবে; তাদের মধ্যে অশ্লীলতার জন্য বিকৃত কোনো কাম জেগে উঠবে না। আর ছবিটিতে যদি সমস্যা থাকতো তাহলে সেটি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে সার্ক চলচ্চিত্রে কেন প্রদর্শিত হলো? যে সেন্সর বোর্ড আটকে দিলো সেই সেন্সর বোর্ডই তো সিনেমাটিকে সেখানে পাঠালো। তাহলে কী সেন্সর বোর্ড দ্বৈত নীতিতে চলে?
সেন্সর বোর্ড এবং দাগ সংশ্লিষ্টদের থেকে পাওয়া তথ্যমতে, গত বছরের অক্টোবরে ছাড়পত্রের জন্য সেন্সর বোর্ডে আবেদন করা হয় দাগ এর পক্ষ থেকে। ২৯ অক্টোবর বোর্ড থেকে পাঠানো এক চিঠিতে সিনেমাটির প্রযোজক ও পরিচালক জসিম আহমেদকে সিনেমাটির ৩৫ সেকেন্ড অংশ কেটে পুনরায় সেন্সর বোর্ডে জমা দিতে বলা হয়। ৮ মিনিট ১০ সেকেন্ড থেকে ৮ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডের মধ্যেকার ওই অংশটিতে ‘অশ্লীল দৃশ্য/সংলাপ’ আছে বলে উল্লেখ করা হয় ওই চিঠিতে।
এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সেন্সর বোর্ডের সচিব মোহাম্মদ আলী সরকার বলেন, এই ছবিটির ছাড়পত্র যখন আটকে দেওয়া হয় তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে হলে আগে জানতে হবে। এর জন্য সময় প্রয়োজন। তাছাড়া কোনো ছবি কেন সেন্সর পেলো না তা ভালো বলতে পারবেন বোর্ড সদস্যরা। আমি এ বিষয়ে জেনে পরে কথা বলবো।
দাগ এর বিষয়ে জানতে সেন্সর বোর্ডের সদস্য এবং বাংলাদেশ চলচিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার এই প্রতিবেদককে বলেন, দাগ এর ছাড়পত্র আমরা আটকাইনি। ছাড়পত্র দেব না তেমনটাও বলিনি। সিনেমাটিতে কিছু জায়গায় সমস্যা ছিলো; সেটি কেটে পুনরায় জমা দিতে বলেছি।
যে সেন্সর বোর্ড দাগ সিনেমাটিকে দেশে প্রদর্শনের অনুমতি দেয়নি, সেই বোর্ড-ই চলচ্চিত্রকে সার্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শনের জন্য নির্বাচিত করে। সেন্সর বোর্ডের সেই চিঠি।
তাহলে সিনেমাটিকে কেন সার্কে পাঠানো হলো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিনেমাটিকে সার্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পাঠানোর জন্য আমিই সেটির নাম প্রস্তাব করি। আমি জানতাম জসিম (দাগ এর পরিচালক) ওই অংশটুকু কেটে জমা দিয়েছে। কিন্তু সে যে দেয়নি এটা আমার জানা ছিলো না। ভুল বোঝাবুঝি এটুকুই হয়েছে। যদি আমি বিষয়টা জানতাম তাহলে এর নাম কখনোই প্রস্তাব করতাম না।
বোর্ড কোন সিনেমাকে কীসের ভিত্তিতে ‘অশ্লীল’ বলে ঘোষণা করে এমন প্রশ্ন করা হলে গুলজার বলেন, দেখেন অশ্লীলতার সংজ্ঞা নিয়ে তো কোনো আইন নেই। তবে যেটা আমাদের সবার কাছে অশ্লীল লাগে সেটাই অশ্লীল। এটা মানুষের অনুভুতি-অনুধাবনের বিষয়। দাগ সিনেমাটিতে যে লম্বা সময় ধরে একটা ধর্ষণ দেখানো হয়েছে এটা অশ্লীল। এত লম্বা সময় নিয়ে তো দেখানোর দরকার ছিলো না, তাই না? ধর্ষণ হচ্ছে এটা বুঝানো হলেই হতো। গল্পের সঙ্গে যায় না এমন বিষয়গুলোই অশ্লীল।
আলোচনা সমালোচনা
এদিকে দাগ চলচিত্রটিকে সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র না দেওয়া এবং পরে সার্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পাঠানোর বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে দেশীয় ফিল্ম পাড়ায়।
নাম প্রকাশ না করে এক চলচ্চিত্র পরিচালক বলেন, সেন্সর বোর্ডের এমন দ্বৈত এবং হঠকারী সিদ্ধান্তে দেশের চলচ্চিত্র জগতেরই ক্ষতি হচ্ছে। জসিম হয়তো আন্তর্জাতিক বাজার দিয়ে তার সিনেমার লগ্নি করা টাকা উঠিয়ে নিয়েছে। কিন্তু কোনো এক তরুণ বা নতুন নির্মাতার সঙ্গে যদি এমনটা করা হতো তাহলে সে পথে বসে যেতো। আর এমন হলে সেই নির্মাতা তো দ্বিতীয়বার আর সিনেমা বানাবে না। ফলে এমন ঘটনা দেশীয় চলচ্চিত্রের জন্যই ক্ষতিকর।
এ বিষয়ে তরুণ নির্মাতা এবং পরিচালক আনন্দ কুটুম বলেন, যে সিনেমা অশ্লীলতার দায়ে ছাড়পত্র পেলো না সেটিকে তথ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় হয়ে সুদূর শ্রীলংকা (সার্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে) পাঠিয়েছে খোদ সেন্সর বোর্ড। এমন কর্মকান্ডে বোর্ডের ‘হিপোক্রেট’ চরিত্র ফুটে ওঠে।
/ এআর /