ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

‘বাহবা’ দানকারীরাই মোদীর চরিত্রে হতবাক

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ 

প্রকাশিত : ১৯:৫৮, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯ | আপডেট: ১৩:০২, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯

নাগরিকত্ব সংশোধন বিলের বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে- ফাইল ছবি

নাগরিকত্ব সংশোধন বিলের বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে- ফাইল ছবি

বর্তমানে একুশে টেলিভিশন’র নিজস্ব প্রতিবেদক। তিনি দৈনিক ইত্তেফাক, ডেইলি নিউএইজ, এনটিভি’র কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক ছিলেন ও বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি’র নেতৃত্ব দিয়েছেন। একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৭’তে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘আসমত আলীর অনশন’ প্রকাশিত হয়। তার বহু গবেষণা প্রবন্ধ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।

ভারত জুড়ে এখন বিক্ষোভ। কোন কোন অঞ্চলে বয়ে যাচ্ছে রক্তের ধারা। বিষয় নাগরিকত্ব সংশোধন বিল (ক্যাব) এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি)। চলতি বছরের মাঝামাঝি ও শেষ দিকে এ দুই পদক্ষেপ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিরোধের মুখে পড়তে হচ্ছে ভারত সরকারকে। সারাদেশে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ সরকারের প্রণিত এ আইনের বিরুদ্ধে নেমেছে। সমালোচনায় পড়েছে মোদী সরকার। যারাই এক সময় মোদীকে ‘বাহবা’ দিতেন তারাই মোদীর এমন কর্মকাণ্ডে হতবাক হয়েছেন।

সদ্যপ্রণীত নাগরিকত্ব সংশোধন বিল‘র (ক্যাব) প্রতিবাদে বর্তমানে উত্তাল ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গসহ বেশ কয়েকটি রাজ্য। এসব রাজ্যে হরতাল, অবরোধ, ট্রেন-বাসে অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলেছেন সাধারণ মানুষ। বিক্ষোভ চলছে খোদ রাজধানী দিল্লীতেও। ক্যাববিরোধী গণআন্দোলন বন্ধে ইতোমধ্যেই আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মণিপুরের একাধিক জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে মোবাইল ও ইন্টারনেট পরিষেবা। রাজপথে বিক্ষোভে নেমেছেন হাজার হাজার মানুষ। গত সোমবার পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন অন্তত ৫ জন বিক্ষোভকারী। এ পরিস্থিতিতে স্পর্শকাতর অঞ্চলগুলিতে পা না রাখার পরামর্শ দিয়েছে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। ক্যাবকে বৈষম্যমূলক আখ্যায়িত করে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের আহবানও জানিয়েছে জাতিসংঘ।

আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন দেশটির শিক্ষার্থীরাও। দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ও আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে পুলিশি নির্যাতন ও সহিংসতার ঘটায় প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস। মুম্বাই থেকে হায়দ্রাবাদ, ব্যাঙ্গালোর থেকে কলকাতা সর্বত্র এই আইনের বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন দেশের ছাত্রছাত্রীরা। পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায় রাজ্য সরকার এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বিশাল পদযাত্রা ও সমাবেশও করেছে। প্রতিবাদ এখন আর শুধু উত্তর-পূর্ব ভারতেই সীমাবদ্ধ নেই। মুম্বাই বা চেন্নাইয়ের আইআইটি থেকে শুরু করে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি বা হায়দ্রাবাদের মৌলানা আজাদ উর্দু ইউনিভার্সিটিতেও আছড়ে পড়েছে বিক্ষোভের ঢেউ।

এনআরসি এবং ক্যাব এর বিরুদ্ধে যেন জ্বলছে পুরো ভারত- ফাইল ছবি

নাগরিকত্ব আইন ঘিরে দেশের নানা প্রান্তে বিক্ষোভ দানা বেঁধেছে। নাগরিকত্বের এই নয়া আইন ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে বলে সরব বিরোধী দলগুলো। নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসির প্রতিবাদ করছে কংগ্রেস। আইনটি প্রত্যাহারের দাবিতে সরব তারা। সোচ্চার তৃণমূল কংগ্রেস। পশ্চিমবঙ্গে এ নয়া আইন ও এনআরসি বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হবে না বলে ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একই ঘোষণা দিয়েছে কংগ্রেস ও বিজেপি বিরোধীদের দ্বারা পরিচালিত বেশিরভাগ রাজ্য সরকার। ঠিক এ পরিস্থিতিতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের গুরুত্ব বোঝাতে মাঠে নেমেছেন মোদী সরকার। তবে বিষয়টিতে তারা তেমন একটা জুতসই যুক্তি দিতে পারছেন না। 

এদিকে প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়া সহিংস বিক্ষোভের জন্য পরোক্ষভাবে শুধু মুসলমানদের দায়ী করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ঝাড়খন্ডে এক নির্বাচনী সভায় মোদী বলেন, ‘এই সব আগুন কারা লাগাচ্ছে, সেটা তাদের পোশাক দেখলেই চেনা যায়। আমার ভাই ও বোনেরা। এই যে দেশে আগুন লাগানো হচ্ছে, টেলিভিশনে যে সব ছবি আসছে সেগুলো কি আপনারা দেখেছেন?’ আর এর পেছনে কংগ্রেসের মতো বিরোধী দলগুলি উসকানি দিচ্ছে বলেও প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন। বিরোধীরা প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যকে সরাসরি একটি বিশেষ ধর্মের মানুষের প্রতি সাম্প্রদায়িক আক্রমণ হিসেবেই চিহ্নিত করছেন।

কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএস’র কর্মী পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ক্ষমতার প্রথম দিন থেকে অনেকেই ভালোভাবে নিতে পারেনি। কারণ সবারই কমবেশি ধারণা ছিল মোদী ধর্মের ক্ষেত্রে সৌহাদ্যপূর্ণ না হয়ে বরং উগ্রতার দিকে চলে যেতে পারেন এবং ভারত ক্রমান্বয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গা হারাবে। ক্ষমতার পরের দিন থেকে ঠিক সেটিই দেখা গেলো। ক্রমান্বয়ে গাঢ় হতে লাগলো মোদীসহ বিজেপি নেতাদের মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব। তারই অংশ হিসেবে ২০১৮ সালে মাঝামাঝিতে মোদী সরকার হঠাৎ কাজ শুরু করলো আসামের ‘নাগরিকপঞ্জি গঠনে’। যদিও এই উদ্যোগটা আসামের বাংলাভাষী মানুষদের বিরুদ্ধে কিন্তু আড়াল থেকে বললে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। সেটা পরবর্তী কার্যক্রমে ধরা পড়ে।

গত বছরে জুন-জুলাই থেকে শুরু হওয়া আসামে নাগরিকপঞ্জি বা হালনাগাদে প্রায় ৪০ লাখ বাংলাভাষীকে অবৈধ ঘোষণা করে ভারতের এনআরসি। পরবর্তিতে আসাম সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জাতীয় নাগরিকত্ব নিবন্ধনে (এনআরসি) ৩ কোটি ১১ লাখ লোক আবেদন করেছিলেন। সেখান থেকে ১৯ লাখকে বাদ দেয়া হয়েছে। চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়াদের ১৭-১৮ লাখ হিন্দু বাঙালি রয়েছেন বলে অনুমান করা হচ্ছে। ‘অবৈধরা’ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে আসামে অবস্থানের প্রমাণপত্র দেখাতে পারেনি এমনটি ভারত সরকারের দাবি। 

বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশে এনআরসিতে এমনটি করার মাধ্যমে ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র বা হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র হিসেবে গঠন, মোদীর ভোটব্যাংক রাজনীতি ও বাংলাদেশকে চাপে রাখা এমনটি করা হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এদিকে চলতি বছরে ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ২৭ তম বছর পূর্ণ হওয়ার মাত্র দুই দিনের মাথায় দেশটির কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংশোধনী অনুমোদন করে। যা ৯ ডিসেম্বর পার্লামেন্টে যায় এবং পরবর্তিতে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে আইনে (নাগরিকত্ব সংশোধন আইন) পরিণত হয়। 

কি আছে নাগরিত্ব সংশোধন আইনে?

এতে মুসলমানদের বাদ দিয়ে অন্য প্রধান ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের ভারতে নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ করা হয়। এ আইনে যেসব হিন্দু ধর্মাবলম্বী নাগরিকত্বহীন অবস্থায় ভারতে বসবাস করছেন তাঁরাই প্রধান সুবিধাভোগী হবেন। পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশে ‘ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার’ হয়ে দেশ ছেড়েছেন তাদের নাগরিকত্বের জন্য এ আইন করা হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়। এতে হিন্দুরা ভারতে আর অবৈধ অভিবাসী বিবেচিত হবেন না। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলে সেসবও তুলে নেওয়া হবে। একইভাবে ভারতে আসা শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি বা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরাও সুবিধা পাবেন।

তবে যারা ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতে এসেছেন, তারাই কেবল এ রকম সুবিধা দাবি করতে পারবেন। তবে সরকার ‘ধর্মীয় নিপীড়ন’র ব্যাখ্যা দেয়নি। ধর্মীয় নিপীড়নের ঘটনা কীভাবে প্রমাণিত হবে, সে সম্পর্কেও আইনে কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। আইনে অমুসলমানদের নাগরিকত্ব পাওয়ার কিছু শর্তও শিথিল করা হয়েছে। আগে নাগরিকত্ব পেতে বসবাসের সর্বশেষ ১৪ বছরের মধ্যে ১১ বছর ভারতে থাকার শর্ত ছিল। এখন সেটা পাঁচ বছর করা হচ্ছে।

কি বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

এ আইনের মধ্য দিয়ে ভারত হিন্দুদের জন্য একটি স্থায়ী নিরাপদ আশ্রয় এমনটি উপস্থাপন করতে চায় সরকার। যেমনভাবে ইসরায়েল ইহুদিদের জন্য একটি রাষ্ট্র। এ যেন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েই ভারত রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য থেকে সরে দাঁড়ালো। এতে দেশটির সংবিধানের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধেছে বলে মনে করছে বিরোধীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। 

এদিকে নতুন আইনগত সংশোধনী সবচেয়ে জটিল অবস্থা তৈরি হয়েছে আসামে। সেখানে যেসব অমুসলমান ইতিমধ্যে এনআরসিতে নাগরিকত্ব হারিয়েছেন, তারা এই আইনে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন কি না, তা স্পষ্ট নয়। কারণ আগে তারা এনআরসিতে অন্তর্ভুক্ত হতে আবেদন করেছিলেন ভারতীয় নাগরিক দাবি করে। এখন নতুন আইনে সুবিধা পেতে হলে আবেদন করতে হবে বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তান বা অফগানিস্তানের নাগরিক হিসেবে। যা হবে স্পষ্টতই প্রতারণামূলক ও স্ববিরোধিতামূলক। 

ভারতের প্রস্তাবিত নতুন নাগরিকত্ব আইন বাংলাদেশের জন্যও এক অস্বস্তির কারণ বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। বিষয়টিতে এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা ব্যাপকহারে নিপীড়িত হচ্ছে। 
এ আইনের মাধ্যমে ভারত ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে সরে আসায় দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বেশ খারাপ একটি বার্তাই বহন করছে। ভারতের এই আইন দক্ষিণ এশিয়ার সকল রাষ্ট্রকে নীরবে সাম্প্রদায়িকতার উসকে দিচ্ছে। এতে আফগানিস্তান থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত পুরো অঞ্চলে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতিনির্ধারণে ধর্মীয় বিবেচনা বাড়তি গুরুত্ব পাবে। 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী- ফাইল ছবি

ভাটা পড়ছে মোদীর জনপ্রিয়তায়?

অন্যদিকে যারাই মোদীকে ‘বাহবা’ দিতেন তারাই মোদীর এ আইনের জন্য সরব হওয়া নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এর আগে এক জরিপে নরেন্দ্র মোদীকে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিক বলা হয়েছে।

২০১৭ সালে লাভলি প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটি’র (এলপিউ) সমীক্ষায় দেশের ২,৪৬৪ জনের উপর সমীক্ষা চালিয়ে এ কথা জানানো হয়। ঐ বছর ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ মার্চের মধ্যে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছে। এলপিউ-এর পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশের 'অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি'ই মোদীর পক্ষে ভোট টানতে বেশি সহায়তা করেছে। দশ জনের মধ্যে আট জনই বলেছেন যে দেশের আর্থিক অবস্থা ভালো। কিন্তু মোদীর এ জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে এমনটি দেশের সব অঞ্চলের বিক্ষোভই বলে দিচ্ছে।

এমএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি