ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

করোনায় চাপের মুখে বাংলাদেশের অর্থনীতি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:৩৪, ১৬ মার্চ ২০২০

করোনা ভাইরাস শুধু স্বাস্থ্য ঝুঁকি নয় গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকেই নাড়িয়ে দিচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কমে যেতে পারে। চাকুরি হারাতে পারেন মানুষ। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে কার্যত এক দেশ থেকে অন্যদেশ বিচ্ছিন্ন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ভাইরাসটি আরও জটিলভাবে আঘাত করলে বিশ্বের অর্থনীতিতে বছরে উৎপাদন কমবে ৩৪ হাজার ৬৯৭ কোটি ডলার।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও করোনাভাইরাস আঘাত হেনেছে। সোমবার পর্যন্ত ৮ জনের শরীরে করোনাভাইরাস সনাক্ত হয়েছে। সারাদেশে আজ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার জন হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন বলে জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিও ঝুঁকিতে পড়বে। আমদানি-রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামালের আমদানি সঙ্কটে দেশের ব্যবসায়ীরা বড় অঙ্কের ক্ষতির সম্মুখিন হবেন। অর্থনীতির দুর্দশার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ ২০টি দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। ক্ষতিগ্রস্থ ২০ দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড। 

বড় ধরণের সংক্রমন ঠেকাতে আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। 

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে রপ্তানি আয় এমনিতে ধসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি কমেছে চার দশমিক সাত নয় ভাগ। অব্যাহতভাবে কমছে পোশাক রপ্তানি। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র এই পণ্যটির প্রধান বাজার। করোনাভাইরাসের কারণে সেখানকার বাজারে ইতোমধ্যেই প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ইতালিতে মানুষ ঘর থেকেই বের হতে পারছে না। যেখানে ১৪৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ গত বছর। ধীরে ধীরে একই পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে গোটা ইউরোপে এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও৷ বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ৬২ ভাগ আসে ইউরোপ থেকে আর ১৮ ভাগই যুক্তরাষ্ট্র থেকে। 

তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন তারা এরই মধ্যে চাহিদা কমে যাওয়ার আঁচ পেতে শুরু করেছেন। কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক বিদেশী এক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা বাজারে শতকরা তিন দশমিক এক ভাগ বিক্রি ইতোমধ্যে কমে গেছে, কমে যেতে শুরু করেছে ক্রেতাদের কার্যাদেশও। এফবিসিসিআই’র সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের ভয় হচ্ছে ইউরোপ নিয়ে। সেখানে যদি করোনা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে পোশাকের চাহিদা অনেক কমে যাবে৷ মানুষ যদি ঘর থেকে বেরই না হতে পারে তাহলে পোশাক কিনবে কিভাবে?’ 

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে বাংলাদেশের অন্যতম পথ হচ্ছে পণ্য রপ্তানি। তবে সেই পথে করোনা ভাইরাসের পাগলা ঢেউ লেগেছে। শুরুতে চীনা কাঁচামাল ও পণ্যের সংকটের কারণে ছোটখাটো ধাক্কা খেয়েছে কমবেশি সব পণ্য রপ্তানি খাত। মাসখানেক আগেও বিষয়টিকে বড় ধরনের সমস্যা মনে হলেও সেটি ছিল আসলে উপসর্গ। প্রাণঘাতী ভাইরাসটি ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের একশর বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়ায় বড় দুশ্চিন্তা ভর করেছে।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪ হাজার ৫৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। তখন প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ১০ শতাংশের মতো। তবে চলতি ২০১৯–২০২০ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস থেকেই রপ্তানি আয় কমতে থাকে। শেষ পর্যন্ত অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ২ হাজার ২৯১ কোটি পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ। তবে করোনাভাইরাসের কারণে বছর শেষে পণ্য রপ্তানি আয়ের চেহারা আরও খারাপ হতে পারে- অনেক উদ্যোক্তা ইতিমধ্যেই এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচকই নিম্নমুখী। তার মধ্যেও ভাল করছিল রেমিট্যান্স। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ১০৪২ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ ভাগ বেশি। এই গতি ধরে রাখা এখন কঠিন হয়ে যাবে বাংলাদেশের জন্যে।

যেইসব দেশ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সেখানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ইতোমধ্যে কমে গেছে। সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশি শ্রমিক বা ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনমত আয় করতে না পারলে দেশে পরিবারের কাছে আগের মতো টাকা পাঠাতে পারবেন না৷ তাই স্বভাবতই রেমিট্যান্স কমতে থাকবে৷ এর প্রভাব পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে৷

করোনার প্রভাবে বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দামে ২০০৮ সালের পর সবচেয়ে বড় পতন হয়েছে৷ শুধু চলতি বছর ৫০ ভাগ কমে অপরিশোধিত ব্রেন্ট বিক্রি হচ্ছে ৩৩ ডলারে৷ এই পরিস্থিতি খবু সহসায় কাটবে এমন আভাস মিলছে না৷ কারণ বৈশ্বিক অর্থনীতি ধীর হলে জ্বালানির চাহিদা এমনিতেই কমতে থাকে৷ অন্যদিকে তেলের উৎপাদন কমিয়ে বাজার সামাল দেয়ার বিষয়েও একমত হতে পারেনি সৌদি আরব ও রাশিয়া৷

এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে বড় ধরনের লোকসান গুণতে হবে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেল নির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোকে৷ বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের বড় অংশটাই কিন্তু আসে এই অঞ্চল থেকেই৷  

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুই চালিকা শক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স৷ রপ্তানি আয় কমে গেলে দেশের শিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের আয় কমে যাওয়া বা কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা তৈরি হবে৷ অন্যদিকে প্রবাসীরা টাকা পাঠানো কমিয়ে দিলে তাদের পরিবার দেশে আগের মত খরচ করতে পারবেন না৷ এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসা বাণিজ্যে৷ কমে যাবে বেচাকেনা৷ চাহিদা কমে গেলে ভোক্তা পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির মুখে পড়বে।

অর্থনীতিবিদদের পূর্বাভাস বলছে, অর্থনৈতিকভাবে আরও একটি দুর্বল বছর হতে যাচ্ছে ২০২০ সাল। করোনার প্রভাব ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের বড় মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-রেল সংযোগ, কর্ণফুলী টানেল ছাড়াও প্লাস্টিক খাত, ওষুধ শিল্প ও খুচরা যন্ত্রপাতির বাজারে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। 

এমএস/এসি
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি