করোনা নিয়ে ধর্মীয় বক্তাদের অপব্যাখ্যা, বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
প্রকাশিত : ১৮:১৭, ২৯ মার্চ ২০২০ | আপডেট: ১৯:৩০, ৩০ মার্চ ২০২০
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশেও এ ভাইরাসের ছোবলে পাঁচ জনের মৃত্যুসহ আক্রান্ত হয়েছে ৪৮ জন। এর সংক্রমণ ঠেকাতে সারাদেশে সরকার ১০ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে জনগণকে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন ও সতর্কতার সাথে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হয়েছে। তবে এসব উদ্যোগের মাঝেও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতিকে আরো বিপজ্জনক করে তুলছেন একশ্রেণির মানুষ।
অবৈজ্ঞানিক তথ্য ও ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে বিশেষ একটি গোষ্ঠী। একইসঙ্গে এগুলোকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরালও করছে তাদের ভক্তদের একাংশ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবে বেশ কিছুদিন ধরেই এরকম কিছু ভিডিও সয়লাব হয়ে পড়েছে। সেসব ভিডিওগুলোতে বলা হচ্ছে, করোনা ভাইরাস বিধর্মীদের ওপর একটা গজব। তাদেরকে শায়েস্তা করতেই আল্লাহ এই ভাইরাস পাঠিয়েছেন। ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দিয়ে কেউ কেউ বলছেন, করোনা ভাইরাস আতঙ্কে মাস্কের পেছনে না ঘুরে, তাদের কথা শুনলেই মুক্তি মিলবে। তাদের বক্তব্য হলো- মুসলমানরা পাচঁ ওয়াক্ত নামাজ পড়লে আর বিশেষ দোয়া পড়লে আল্লাহ অবশ্যই আপনাকে বিপদমুক্ত রাখবেন। আবার কেউ কেউ স্বপ্নে পাওয়া তদবির পালনেরও পরামর্শ দিচ্ছেন।
সম্প্রতি মাওলানা কাজী ইব্রাহীমের একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, তিনি দাবি করছেন, তিন ঘণ্টার একটা ইন্টারভিউয়ে তার সঙ্গে করোনা ভাইরাসের কথা হয়েছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে করোনার পরিকল্পনার ব্যাখ্যা করে বলেছে, বাংলাদেশে তাদের বড় আক্রমণের পরিকল্পনা নেই। তবে দেশে যারা ইসলামবিরোধী আছে তাদের ছাড়বে না। করোনা ওই বক্তাকে বলেছে বাংলাদেশের ভারতীয় ‘অসভ্য’ চ্যানেল, ডিসলাইন যেন ডিসকানেক্ট করে দেয়। যদি না দেয় তাহলে দেশটিতে তারা আক্রমণ করবে।
আরেকটি ভিডিওতে মুফতি এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী নামক এক পীর বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে কোন ভাইরাস বিশ্বাস করি না। কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাসূল (সা.) এর একটি হাদিসে আছে পাখির ডাকে শুভ-অশুভ বলে কিছু নাই, আর সংক্রামক ব্যাধি বলতে কিছু নাই।
এর বাস্তবতা তুলে ধরে এ বক্তা আরো বলেন, যদি একজনের ভাইরাস আরেকজনের শরীরে যেত, তাহলে আফ্রিকার জঙ্গলে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস করতেছে, তাদের একজনও তো বাঁচার কথা ছিলো না। কমলাপুর রেলস্টেশনের বস্তিতে হাজার হাজার মানুষ বসবাস করছে, এদেরকে ভাইরাস ধরে না কেন? এরা তো নর্দমার পাশে থাকে। বরং যারা এসিতে থাকে, স্প্রিংয়ের খাটে ঘুমায় আর রোস্ট খায়, সব সংক্রমণ এদেরকে ধরে কেন? সুতরাং বুঝা যায়, যার কপালে রোগ আছে তাদেরকেই ধরবে, আর যার কপালে রোগ নাই তাদেরকে ধরবে না। সুতরাং কোন সংক্রমণ-অসংক্রমণ কাউকে ধরতে পারে না।
জনসমাগম এড়াতে ওয়াজ, মিলাদ-মাহফিল ও জামাতে নামাজ পড়া এড়িয়ে চলার কথা বলা হলেও কিছু বক্তা এসব নির্দেশনার নিয়ে বিরূপ সমালোচনা করছেন। তারা বলছেন, একটি মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সরকারকে নির্দেশনা দিয়ে মসজিদে যেতে বাধা দিচ্ছে। তারা বলছে, পৃথিবীর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট আর নিরাপদ স্থান মসজিদ। তাই মসজিদে জামাতে নামাজ পড়ায় কোনো ভয় নেই। তারা খুব দ্বিধাহীনভাবে এমন নির্দেশনা মানতেও চান না।
মাওলানা সিফাত হাসান ও ইয়াহিয়া তাকি নামের দুইজন ইসলামী বক্তা করোনা ভাইরাস নিয়ে বয়ানে করোনাকে চীনাদের জন্য আল্লাহর পাঠানো ‘গজব’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাদের মধ্যে মাওলানা তাকি বলেছেন, ‘চীন পারে নাই, বাংলাদেশ সরকার কোনোভাবেই কোনো প্রস্তুতি নিয়ে করোনা ভাইরাস প্রতিহত করতে পারবে না। একমাত্র পথ তওবা করা।’ আর মাওলানা সিফাত হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশের সরকার যতই প্রস্তুতি নিক, ডাক্তার আর সচেতনতা দিয়ে এই আজাব, গজব থেকে বাঁচা যাবে না। তিনি বলেন, আমাদের বলেল্লাপনা বন্ধ করতে হবে৷’
তবে এসব বিষয় তাদের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের কাউকেই ফোনে পাওয়া যায়নি।
এসব প্রসঙ্গে দেশের প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ একুশে টেলিভিশনকে বলেন, ‘দোয়া পড়েন, বিশেষ প্রার্থনা করেন, তাতে অসুবিধা নেই৷ বলা যায়, এরকম জাতীয় সংকটে দোয়া বা বিশেষ প্রার্থনা খুবই ভালো বিষয়। এতে মহান স্রষ্ট্রার দয়া পাওয়া যাবে। দেশের সব মানুষরাই নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী এরকম দোয়া বা প্রার্থনা করতে পারেন। তবে করোনা প্রতিরোধে চিকিৎসকদের দেয়া পরামর্শ এবং সতর্কতা অবশ্যই মেনে চলতে হবে৷ আর যারা গজব বা স্বপ্নের কথা বলছেন, আমি মনে করি তারা তাদের মনগড়া কথা বলছেন৷ তাহলে তো সৌদি আরব, ইরানের লোক আক্রান্ত হতো না৷ মুসলমানদের করোনা ভাইরাস আক্রমন করতো না৷ এইসব অবাস্তত বক্তব্যের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া দরকার৷’
গুজবে কান না দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, কতিপয় হুজুর সবকিছু ভালোভাবে না বুঝে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এসব বিভ্রান্তিমূলক প্রচার করছে। এগুলোর বৈজ্ঞানিক কোন যুক্তি নেই।
এবিএম আব্দুল্লাহ আরো বলেন, ‘অনেকেই বলছে তুলসি পাতা খেলে ভালো হয়ে যাবে, অনেকেই বলে থানকুনি পাতা খেলে ভালো হয়ে যাবে, আবার অনেকেই বলছে তাবিজ-কবজ এসবে ভালো হয়ে যাবে। আমার বক্তব্য হলো, যদি থানতকুনি পাতা খান, খেতে পারেন। এসব খাদ্যের অবশ্যই পুষ্টিগুণ আছে। তাবিজ-কবজ নেন, নিতে পারেন। তবে, অবশ্যই চিকিৎসকদের নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন এবং জনসমাগম এড়িয়ে চলবেন। লঞ্চ, বাস, ট্রেনসহ যেগুলোতে ভিড় বেশি সেগুলোতে এ মুহূর্তে যাবেন না।
এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আরো বলেন, ‘ওয়াজ মাহফিল, ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো আপাতত সাধারণ মানুষের না যাওয়াই ভালো। কারণ, সাধারণ মানুষের অনেকের মাঝেই এ ভাইরাস সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে, আর সে যদি এ অবস্থায় মসজিদে আসে, তাহলে তার মাধ্যমে সবার মধেই করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে যেতে পারে। সুতরাং সবাইকে সর্বোচ্চ সচেতন থাকতে হবে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া একুশে টেলিভিশনকে বলেন, ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানে আসলে এসব বক্তব্যের কোন ভিত্তি নেই। আমাদের সমাজে এরকম অনেক ধরনের মানুষ আছে, যারা আসলে কি বলে না বলে তারা নিজেরাও ভালো করে জানে না। এগুলোকে এতো বেশি গুরুত্ব দেয়ার দরকার নেই। কিছুদিন গেলে মানুষ এমনিতেই বুঝতে পারবে যে, এগুলো বিভিন্নজনের ছড়ানো গুজব রটনা। যেহেতু এসবের সাইন্টিফিক কোন ভিত্তি নেই, ধর্মের নাম নিয়ে যদি কেউ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত হবে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া।’
তিনি বলেন, ‘গনমাধ্যম যদি এসব বিষয়ে নিজেরা সতর্ক থাকে এবং মানুষকে সতর্ক করে, তাহলে সাধারণ মানুষ সচেতন হবে। এখন আপনাদের দায়িত্ব হলো সংবাদ ও প্রচারণার মাধ্যমে সত্যটা মানুষের সামনে তুলে ধরা। মানুষ সচেতন হলে যখন বুঝতে পারবে এসব আলেমরা এসব গুজব ছড়ায়, তখন এমনিতেই তারা চুপ হয়ে যাবে। এটাকে এতো গুরুত্ব দেয়ার দরকার নেই।’
এ বিষয়ে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম মুফতি মিজানুর রহমান একুশে টেলিভিশনকে বলেন, ‘কোন দেশে যখন এ জাতীয় কোন মহামারি আসে, কোরআন হাদিসের মতে এটা কখনো কখনো মানুষের অন্যায় অপরাধের কারণেও আজাবের ফয়সালা হিসাবে হয়। আবার কখনো কখনো আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষার জন্যও বিপদ আপদ দেন। কেন এসব অসুখ আসলো সেটা আমরা সহজে বলে দিতে পারি না। এখন কিছু নামধারী আলেম যদি বলে, এই ভাইরাসে ডাক্তারের পরামর্শ ও সচেতনতা কোন কাজে আসবে না, তাহলে তো এটা খুবই গর্হিত কাজ। কিন্তু রাসূলের (সা.) তো স্পষ্ট নির্দেশনা আছে যে, কোন ধরনের বালা মুসিবত বা রোগ ব্যাধি যদি আসলে, এর থেকে বাঁচার জন্য চিকিৎসা নিতে হবে। রোগ বালাইয়ে চিকিৎসা নেয়া, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, হাত-পা, ঘরবাড়ি, আসবাপত্র জীবাণুমুক্ত রাখা - এই কাজগুলো করা তো আমাদের দায়িত্ব। কারণ এটা ইসলামের নির্দেশ, রাসূল (সা:) এসব ব্যাপারে আমাদের সতর্ক করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘সচেতন থাকার পাশাপাশি এইসব রোগবালাই থেকে, জীবাণু বা ভাইরাস থেকে যেন আমরা মুক্ত থাকতে পারি -সেজন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া, আল্লাহ রহমত কামনা করা উচিত। এর পাশাপাশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া যে, আমাদের কোন ভূলের কারণে যদি এসব আজাবের ফায়সালা হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহ যেন আমাদের অপরাধগুলো মাফ করে দেন।িএকদিকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া, আরেকদিকে বাহ্যিকভাবে সচেতন থাকা, ডাক্তারদের পরামর্শ নেওয়া -দুটোই একসাথে চালিয়ে যেতে হবে। এটাই হচ্ছে শরীয়তের মূল বক্তব্য।’
করোনা ভাইরাস বিধর্মীদের উপর আল্লাহর গজব কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পৃথিবীতে কোন গজব বা মহামারি আসলে সেটা যে শুধু বিধর্মীদের উপর আসবে তা নয়। সেসব এলাকা বা আশেপাশের আল্লাহ ভক্ত ধার্মীক লোকদের ওপরও আসে। অতএব এটাকে এককভাবে বিধর্মীদের উপর গজব বলার সুযোগ নেই। যখন ব্যপাক ধরনের মসিবত আসে, তখন সেটা সবজায়গাতেই ছড়াতে পারে। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আলেমওলামাদেরকে এসব ব্যপারে না কথাবার্তার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। যদি কোন সুনির্দিষ্ট কোন বিধান জানা না থাকে, তাহলে ওনি যেন জেনে নেয় অথবা সে বিষয়ে চুপ থাকেন। কারণ না জেনে গুজব ছড়ানো মারাত্বক ধরনেন গুনাহের কাজ।
উল্লেখ্য, দেশে এ পর্যন্ত ৪৮ জনের শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে পাঁচজন মারা গেছেন। সুস্থ হয়েছেন ১১ জন এবং চিকিৎসাধীন আছেন ৩২ জন।