বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও ঐক্যের প্রতীক শেখ হাসিনা
প্রকাশিত : ১১:০২, ১০ অক্টোবর ২০২০
২৮ সেপ্টেম্বর ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৪তম জন্মদিন। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যার জন্মদিনটি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশও আক্রান্ত হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার এ মহামারী বিচক্ষণতার সঙ্গে মোকাবেলা করছে এবং ইতোমধ্যে সফলও হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিচক্ষণ পদক্ষেপে করোনায় বিশ্বের অপরাপর দেশগুলোর তুলনায় অতি ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুহার কম। এক সময়ের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষে জর্জরিত বাংলাদেশকে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করতে হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ ২০৪১ সালে উন্নত দেশের তালিকায় নাম লেখাতে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে।
বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার এ আশার নাম ‘রূপকল্প-২০২১’ এবং উন্নত দেশে পরিণত করার আশার নাম ‘ভিশন-২০৪১’। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, সরকারি-বেসরকারি প্রশাসন পরিচালনা- সব ক্ষেত্রেই দেশে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও কল্যাণমুখী নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বজয়ের নবতর অভিযাত্রায় এগিয়ে চলেছে।
‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ খেতাবপ্রাপ্ত শেখ হাসিনা এবং তার ছোটবোন শেখ রেহানা ছাড়া পরিবারের আর কেউই জীবিত নেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে বাবা-মাসহ সবাই ঘাতকের হাতে প্রাণ হারান। ঘাতকদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বিদেশে আশ্রয় নেন। বিদেশে অবস্থানকালে ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সিনিয়র কয়েকজন নেতার অনুরোধে সভানেত্রী নির্বাচিত হন।
আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেছেন, শেখ হাসিনাকে দলের সভানেত্রী পদে অধিষ্ঠিত করা হলে ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও ঐক্যের প্রতীক’ হিসেবে আওয়ামী লীগকে আবারও সুসংগঠিত করা যাবে। জনমানুষের আস্থা ফিরে আসবে। পিতৃমাতৃহীন শেখ হাসিনা ৬ বছর পর প্রবাস জীবন থেকে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে অভিজ্ঞ রাজনীতিকের মতোই বলেন, ‘শোককে শক্তিতে পরিণত করতে হবে।’
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রথমবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে। একজন দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তখন থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর মানবিক ও রাজনৈতিক আদর্শ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অবলম্বন করে দেশের উন্নয়নে ও জনগণের কল্যাণে সব সরকারি নীতি নির্ধারণ করেন। ২০০৭ সালে নেতৃত্ব থেকে তাকে সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র হলেও তার ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব, দৃঢ় মনোবল, দেশ ও জনগণের কল্যাণবোধ এবং বিশাল জনসমর্থন থাকার কারণে ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হয়নি।
বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও উন্নতি, দেশের প্রত্যেক মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন ও জীবনমান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের অবদান অস্বীকার করা অসম্ভব। ফলে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন নিয়ে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের পথ সুপ্রশস্ত হয়।
সর্বস্তরের জনগণের জীবনমানের সার্বিক উন্নয়ন ও কল্যাণে গৃহীত নীতি ও সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের পথ সুগম হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, কৃষি উৎপাদন, শিল্প-কারখানার উন্নয়ন, বাণিজ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে দেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যায়। দারিদ্র্যের হার কমে আসে, মাথাপিছু আয় বেড়ে যায়, গড় আয়ু বেড়ে যায়, স্বাস্থ্যসেবা উন্নত হয়, দেশের নাগরিকদের শিক্ষা-জ্ঞান-বুদ্ধি-প্রজ্ঞা অনুযায়ী কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। সামাজিক সেবার মান বৃদ্ধি পায় এবং মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত হয়।
শেখ হাসিনা উন্নয়ন ও কল্যাণমুখী রাজনীতিতে বিশ্বাসী। ডিজিটালাইজেশনের সুবাদে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারে সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতেরও দৃশ্যপট পরিবর্তিত হয়। মানুষের স্বপ্ন ও কল্পনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশ এগিয়ে চলেছে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বের কাতারে শামিল হতে। ২০৩০ সালের মধ্যে শত বছরের মহাপরিকল্পনা ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এটি বাস্তবায়িত হলে উপকূলে নতুন ভূমি জাগবে। দেশের আয়তন বাড়বে। আর এর সবই সম্ভব হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন শেখ হাসিনা। এ মেয়াদকালেও তিনি উন্নত ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে সফল হন। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য মেগা প্রজেক্টগুলো শুরু করেন। এগুলো চালু হলে নিঃসন্দেহে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং দেশ ও জনগণের জীবনমান উন্নত হবে।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই সরকারে ও দলে আমূল পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছেন তিনি। সব বাধা পেরিয়ে ‘ভিশন-২০৪১’ বাস্তবায়নে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাঙালি জাতিকে যে নতুন আশা দেখিয়েছেন, সেদিকেই দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে দেশ। তিনি বাঙালি জাতিকে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, যেখানে সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি থাকবে। যোগ্য মানবসম্পদ কিংবা দক্ষ তথ্যপ্রযুক্তিবিদ হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার বিকল্প নেই। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ে তুলতে শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বর্তমানে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার পথ অনুসরণ করে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে গড়ে তুলতে নানামুখী উদ্যোগ নেন। তিনি একটি কথা প্রায়ই বলতেন- ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই।’ অর্থাৎ মানবিক গুণে গুণান্বিত দক্ষ জনসম্পদ চাই। আর এটি করতে হলে প্রয়োজন সুশিক্ষা। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণেও তার শিক্ষাভাবনা সম্বন্ধে আমরা সম্যক ধারণা পাই। ভাষণে তিনি বলেছিলেন, সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না।
নিরক্ষরতা অবশ্যই দূর করতে হবে। ৫ বছর বয়সে শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য একটা ‘ক্যাশ প্রোগ্রাম’ চালু করতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বার সব শ্রেণির জন্য খোলা রাখতে হবে। একই রকম দূরদর্শী ও কল্যাণ চিন্তাপ্রসূত বঙ্গবন্ধুকন্যার ডিজিটালাইজেশনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় সুবিধা জাতি ভোগ করতে পারছে করোনাকালে দেশের শিক্ষা কার্যক্রম, সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত সচল রাখার মধ্য দিয়ে।
করোনাকালীন বাস্তবতায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় আজকে আমরা যে উদ্যোগ নিয়েছি, এটি সম্ভব হতো না যদি বর্তমান সরকার আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন না দেখাত। এজন্যই যে কোনো দেশের উন্নয়নে ভিশনারি পলিটিক্যাল লিডার গুরুত্বপূর্ণ। একটি রাষ্ট্র ভিশনারি নেতৃত্বগুণেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে স্থির করে। দক্ষ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের সাহায্যেই উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যায়।
বর্তমানে দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রায় শতভাগ অফিস-আদালতের কাজে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা প্রবর্তনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে ধন্যবাদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা। তার দূরদর্শনই বর্তমান বাংলাদেশের শক্তি। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তার যে শিক্ষা ভাবনা ছিল, সেই ভাবনাপ্রসূত শিক্ষাব্যবস্থাকে শতভাগ তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর করা এখন সময়ের দাবি।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশের সারিতে উন্নীত হয়েছে। এর জন্য এ দেশের নারী সমাজের রয়েছে উদ্যোগী ও সক্রিয় অংশগ্রহণ। জাতীয় জীবনের সব পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বিরল অবদান রেখেছেন। কৃষিপ্রধান অঞ্চলে এ ক্ষেত্রের প্রায় ২২ ধরনের কাজের মধ্যে ১৯ ধরনের কাজই হয় নারীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে। অন্যদিকে পোশাকশিল্প দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিশাল অদান রাখছে।
এ শিল্পের শ্রমিকদের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ হচ্ছে নারী। নারীদের এ বিরাট অংশ শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের ফলে তাদের জীবনে একটি মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। আর্থিক উপার্জনের ভেতর দিয়ে তারা ক্ষমতায়নের পথে অগ্রসর হয়েছে। নারীসমাজকে এগিয়ে নেয়ার স্বীকৃতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) মানদণ্ড অনুযায়ী, মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন এর থেকে অনেক বেশি- ২০০০ ডলারের উপরে। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২ দশমিক ৯।
অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচক হতে হবে ৩২ শতাংশ বা এর কম, যেখানে বাংলাদেশের রয়েছে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এ উত্তরণের পেছনে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার ইতিহাস। সরকারের ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়ন একটি বড় অর্জন। এটি সম্ভব হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে।
শেখ হাসিনার সরকার ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ থেকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, আমরা মনে করি সে লক্ষ্য অধরা নয়- বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও ঐক্যের প্রতীক শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগই তা অর্জন করতে পারে।
লেখকঃ অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রেষণে কোষাধ্যক্ষ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
এমবি//