হকিংয়ের লেখা নিবন্ধ
আমাদের গ্রহ এখন দুঃসময় পার করছে
প্রকাশিত : ১৬:৩৩, ১৫ মার্চ ২০১৮
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কেন্দ্রস্থল কেমব্রিজ শহরে ২০ বছর বয়স থেকেই বিজ্ঞানী সম্প্রদায়ের মধ্যে আমি জীবন কাটাচ্ছি। এই বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের মধ্যে থাকা আন্তর্জাতিক তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানীদের একটি ছোট গ্রুপ আছে, যে গ্রুপের অনেকে নিজেদের সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছানো মানুষ ভাবতে পছন্দ করেন। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকা এসব মানুষের সঙ্গে কেটেছে আমার কর্মজীবন। এর বাইরে কিছু বই লেখায় অর্জিত হয়েছে তারকাখ্যাতি। সেইসঙ্গে শারীরিক অসুস্থতার কারণে জনবিচ্ছিন্ন আমি। আর এটি ভাবতে প্রলুব্ধ করেছে যে আমার সাফল্যের চূড়া অন্যদের চেয়ে উঁচু।
আমেরিকা এবং ব্রিটেনে সম্ভ্রান্ত শ্রেণিকে প্রত্যাখ্যানের যে ঘটনা দৃশ্যমান হলো, সেখানে নিশ্চিতভাবেই অন্য এলিটদের মতো নিজেকে আমজনতার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে মনে করেছি। ব্রিটিশ ভোটারদের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়া (ব্রেক্সিট) এবং আমেরিকান জনগণের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পকে নির্বাচিত করার সিদ্ধান্তকে আমরা যে চোখেই দেখি, এখন বিশ্লেষকরাও মনে করে, এ দুটি ঘটনা সেই সব মানুষের ক্রোধের ফল, যারা মনে করে তাদের নেতারা তাদের স্বার্থ দেখে না।
এমন এক মুহূর্তে ঘটনা দুটি ঘটেছে, যখন সবখানেই বিশেষজ্ঞ ও এলিট শ্রেণির উপদেশ-পরামর্শ জনগণ প্রত্যাখ্যান করা শুরু করেছে। আমি কিন্তু এই এলিটদের বাইরের কেউ নই। ব্রেক্সিট ভোটের আগে আমিও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলাম, ইইউ থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়া দেশটির বিজ্ঞান গবেষণাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এটি ব্রিটেনকে পশ্চাদগামী করে ফেলবে। কিন্তু ভোটাররা রাজনৈতিক নেতা, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, শিল্পী, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী ও চিত্রতারকা-কারও কথাই আমলে নেননি।
বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক পরিণতি এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ক্রমবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই ভোট কী প্রভাব ফেলবে, তা নিশ্চিতভাবে বোধগম্য। কারখানাগুলোর স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি ইতিমধ্যেই গতানুগতিক উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছে। সেইসঙ্গে কমিয়ে দিয়েছে কর্মসংস্থান। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কর্মসংস্থানে ধস নামিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সংকটে ফেলেছে।
ইতিমধ্যেই বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে উঠেছে। এসব প্রযুক্তি সেই বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দেবে। ইন্টারনেট এবং আরও কিছু ক্ষেত্র খুব ছোট ছোট গ্রুপে থাকা লোকজনকে বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জন করার সুযোগ করে দিচ্ছে। কিন্তু চাকরির সুযোগ পাচ্ছে খুবই কমসংখ্যক মানুষ। এটি অবশ্যম্ভাবী যে এতে দৃশ্যমান অগ্রগতি হলেও এটি সামাজিকভাবে ধ্বংসাত্মক পরিণতি আনছে।
অর্থনৈতিক ভাঙনের ধারাবাহিকতায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে, যেখানে আর্থিক খাত থেকে খুব কমসংখ্যক মানুষ বিপুল পরিমাণ পারিতোষিক নিয়ে যাচ্ছে এবং তাঁদের লোভের ঘুঁটি হিসেবে আমরা তাঁদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছি।
আরেকটি বিষয় হলো, বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপ্তির কারণে আর্থিক বৈষম্যের চেহারা অতীতের চেয়ে ফুটে উঠছে অনেক বেশি। বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এলাকার ধনিক শ্রেণির জীবনযাপন কেমন, তা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে মোবাইল ফোন ব্যবহারের সামর্থ্য থাকা একজন গরিব মানুষ অত্যন্ত পীড়াদায়ক অনুভূতি নিয়ে দেখছে। সাব-সাহারান এলাকায় এখন যত মানুষ বিশুদ্ধ পানি পায় না, সেখানে এখন তার চেয়ে বেশিসংখ্যক লোকের হাতে মোবাইল ফোন। তার মানে উত্তরোত্তর জনাকীর্ণ হতে থাকা আমাদের এই গ্রহে কিছুদিনের মধ্যেই এমন অবস্থা তৈরি হবে, যেখানে প্রায় কারও পক্ষে বৈষম্য থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব হবে না।
এখন সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, মানব ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে আমাদের এই গ্রহে সম্মিলিতভাবে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আমাদের সামনে কয়েকটি ত্রাসোদ্দীপক চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়িয়েছে। সেগুলো হলো জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য উৎপাদন, জনসংখ্যার আধিক্য, নানা প্রজাতির প্রাণীর বিলুপ্তি, মহামারি রোগ, মহাসাগর দূষিত হয়ে ওঠা ইত্যাদি। এগুলো আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, আমরা মানবসভ্যতার অগ্রগতির পথে ভয়াবহতম সময়ে রয়েছি।
আমরা বাস করা গ্রহটিকে ধ্বংস করার প্রযুক্তি আমরা আবিষ্কার করে ফেলেছি। কিন্তু এই গ্রহ থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রযুক্তি এখনও আমরা বের করতে পারিনি। হয়তো কয়েক শ বছরের মধ্যে আমরা অন্য গ্রহে পাড়ি জমাতে পারবো। কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের হাতে একটাই গ্রহ আছে। তাই এই গ্রহ রক্ষার স্বার্থেই আমাদের মিলেমিশে কাজ করা দরকার। এটা করতে হলে দেশের মধ্যে কিংবা এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের বিভাজনরেখার দেয়াল ভেঙে ফেলতে হবে।
(সদ্য প্রয়াত স্টিফেন হকিংয়ের এই প্রবন্ধটি ২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় ছাপা হয়। লেখাটি ইংরেজি থেকে অনুদিত )
একে//