ঢাকা, শনিবার   ০২ নভেম্বর ২০২৪

কেমন আছেন ‘কুঁড়েঘর’র মোজাফফর আহমেদ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২৩:২৪, ২৬ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১৬:৪৮, ২৩ এপ্রিল ২০১৮

অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের ছয়জন উপদেষ্টার মধ্যে একমাত্র জীবিত উপদেষ্টা। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। জীবনের ক্রান্তিলগ্নে অপেক্ষা করছেন ওপারের ডাকের জন্য। তার বর্তমান অবস্থা নিয়ে লিখছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইনের প্রতিবেদন আলী আদনান

বক্তৃতা নয়, বাণীঃ

১৯৩৭ সাল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে।  আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে আছেন ভারতের মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী। আদর্শবাদী সাধু পুরুষ। সবার কাছে তিনি পরিচিত মহাত্মা গান্ধী নামে। তিনি দেশ সফরে বেরিয়েছেন। আসবেন পূর্ববঙ্গের কুমিল্লায়। চান্দিনায় তার জনসভা। পার্শ্ববর্তী উপজেলা দেবীদ্বারের কিশোর মোজাফফর আহমেদ পায়ে হেঁটেই রওনা দিলেন জনসভার উদ্দেশ্যে। কিন্তু জনসভাস্থলে পৌঁছার আগে সভা শেষ হয়ে গেল। কিশোর মোজাফফর পথিমধ্যে একথা শুনে সভা ফেরত লোকদের কাছে জানতে চাইলেন, মহাত্মা গান্ধীজী কী বলেছেন? লোকেরা উত্তর দিল, তিনি বক্তৃতা নয়, বাণী দিয়েছেন। বাণীতে বলেছেন, হিন্দু- মুসলমান এক হয়ে যাও। ব্রিটিশ তাড়াও। নিজেরা ভেদাভেদ করলে ইংরেজ তাড়াতে পারবেনা।

কৌতুহলী মোজাফফর জানতে চাইলেন, আর কী বলেছেন? লোকেরা উত্তর দিল, গান্ধীজী আর কিছু বলেন নি। এটুকু বলেই রওয়ানা দিয়েছেন।

মুগ্ধ হয়ে গেলেন পনের ষোল বছরের বালক মোজাফফর। এমন নেতাই তো চাই। যারা কথা কম বলেন, কিন্তু কাজ বেশি করে। সেদিনের সেই কিশোর পরবর্তীতে সারাজীবন মহাত্মা গান্ধীর আদর্শকেই অনুসরন করেন। তাকে দেশবাসী গ্রামে গঞ্জে, মাঠে ময়দানে, জনসভায় মিছিলে লুঙ্গি পড়ে ছুটতে দেখে। হ্যাঁ, প্রথাবিরোধী রাজনীতিবিদ মোজাফফর আহমেদ।

তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন স্বাধীনতা পদকঃ

২০১৫ সালে দেশের গণমাধ্যমগুলো একযোগে একটি সংবাদ ছাপিয়েছিল। মোজাফফর আহমেদের `স্বাধীনতা পদক` প্রত্যাখ্যান। পদক পাওয়ার প্রতিযোগিতায় বা সাধনায় যেখানে অনেকে অনেকভাবে ব্যস্ত সেখানে তিনি পদক প্রত্যাখ্যান করছেন? সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে তখন জানানো হয়েছিল, `স্বাধীনতা পদক` প্রদানের ইতিহাসে এটি ব্যতিক্রম ঘটনা। কেউ কখনো পদক প্রত্যাখ্যান করেছে এমন নজির আর নেই। সাংবাদিকরা তখন ঘিরে ধরেছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদকে। সবার প্রশ্ন, কেন তিনি পদক প্রত্যাখ্যান করছেন? উত্তরে সহজ সরল হাসি দিয়ে বলেছিলেন, `পদকের আশায় তো মুক্তিযুদ্ধ করিনি`! এমন উত্তরের পরে অবশ্য পাল্টা কোন প্রশ্ন করার সুযোগ থাকেনা।

প্রত্যাখ্যান করার ঘটনা এটা নতুন নয়। আগেও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু তার বাল্যবন্ধু মোজাফফর আহমেদকে আমন্ত্রণ জানালেন মন্ত্রীসভায় যোগ দিতে। যদিও বা রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন ছিল, তথাপি তাদের বন্ধুত্ব ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন, বিরোধী দলে থেকেই আমি স্বস্তি পাব। পার্ক রোডের বাড়িটিতে পড়ন্ত বিকেলে এই প্রতিবেদক তার স্ত্রী আমিনা আহমেদের কাছে জানতে চান, কেন তিনি (মোজাফফর আহমেদ) বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন? উত্তরে হাসি দিয়ে আমিনা আহমেদ বললেন, `ইগো প্রব্লেম?` তিনি কী ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বে ভুগছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে আমিনা আহমেদ বলেন, `তা নয়। তখন বঙ্গবন্ধুর আশেপাশে এমন কিছু সুবিধাবাদীর দাপট, তিনি (মোজাফফর আহমদ) সেখানে গেলেও কোনো কাজ করার সুযোগ পেতেন না।`

এক বিশাল কর্মময় জীবনঃ

অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের ৯৭ বছরের জীবনটি ভীষণ কর্মময়। ১৯২২ সালে জন্ম নেওয়া এই ব্যক্তিত্ব ১৯৩৭ সালে জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। রাজনীতি করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের লোভনীয় চাকরি ছেড়েছেন। মোজাফফর আহমেদের স্ত্রী আমিনা আহমেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি (মোজাফফর আহমেদ) যখন ঢাকা কলেজের শিক্ষক তখন থাকতেন আজমপুরে আট/ আই কলোনির বাসাতেই। সেখানেই ভাষা আন্দোলনকে সংগঠিত করার মিটিং হয়েছিল। যদিও তখনো মোজাফফর আহমেদ- আমিনা আহমেদের বিয়ে হয়নি, তথাপি ভাষা আন্দোলনে আমিনা আহমেদ ছিলেন সর্বকনিষ্ট কর্মী।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে মোজাফফর আহমেদ দেবীদ্বার থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তদানীন্তন মুসলিম লীগের শিক্ষামন্ত্রী মফিজুল ইসলামকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে নজির সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। ১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্থানকে স্বায়ত্ত্বশাসন করার প্রস্তাব করে তিনি অনেক রাঘব বোয়ালের রাজনীতিতে ধাক্কা দিয়েছিলেন। যদিও বা সেই প্রস্তাব পাশ হয়েছিল, তথাপি তখন সেটা খুব সহজ কথা ছিলনা। না বললেই নয়, পূর্ব পাকিস্থান গণপরিষদে তার প্রস্তাবের পক্ষে বক্তৃতা করে জোরালো সমর্থন দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে ইতিহাসের মহানায়ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছয় দফা প্রথমদিকে যারা জোরালোভাবে সমর্থন করে এগিয়ে নিয়েছিলেন তাদের অন্যতম অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ।

১৯৬৮ সালে ন্যাপ দু`ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একভাগ মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে থাকলেও অন্য অংশ অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে আলাদা হয়ে যায়। কেন এই বিভক্তি?

কোনো কোনো তাত্ত্বিক এটার জন্য বিশ্ব রাজনীতিতে কমিউনিজমের পতনকে দায়ী করলেও  তাঁর স্ত্রী আমিনা আহামেদ সহজ সরলভাবে এই প্রতিবেদককে বললেন ভিন্ন কথা। তার ভাষায় ঐ সময় ভাসানী সাহেবের উপর আস্থা রাখা যাচ্ছিল না। তাছাড়া বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি আইয়ুব খানকে সমর্থন দিচ্ছিলেন। রাওয়ালপিন্ডির বৈঠকে যোগ দিতে এদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহামেদ।

মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ে তাজউদ্দিন আহমেদ ছয় জন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদকে নিয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। যেখানে মাওলানা ভাসানী, মণি সিং, মনোরঞ্জন ধরের মতো রাজনীতিবিদরা ছিলেন। তাদের অন্যতম কমরেড মোজাফফর আহমেদ। বাম সমর্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে তখন একটি বিশাল মুক্তিযোদ্ধাবাহিনীও গঠন করা হয়েছিল। তার নেতৃত্বও দিয়েছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিদেশে জনমত গঠন করতে তিনি ভূমিকা রেখেছিলেন। তাকে তখন জাতিসংঘের বিশেষ অধিবেশনে যোগ দিতেও হয়েছিল।

১৯৭৯ সালে তিনি পুনরায় দেবীদ্বার থেকে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে `কুঁড়েঘর` মার্কায় প্রার্থী হন। `আমার নাম মোজাফফর, মার্কা আমার কুঁড়েঘর` এই স্লোগানে দোকানে দোকানে তাকে সহজ সরল ভাবে ভোট চাইতে দেখা যায়। যদিও বা পাতানো সেই নির্বাচনে তার প্রাপ্ত ভোট দেখানো হয়েছিল মাত্র ১ শতাংশ তথাপি বন্দুকের নলের দিকে বুক তাক করে করা সেই সাহসী রাজনীতি ইতিহাসে দাগ কেটে গেছে।

জীবনভর আত্মগোপন, কারাগার হুলিয়াঃ

নিরিবিলি রাজনীতি করার সুযোগ তিনি কখনো পাননি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান তার নামে হুলিয়া জারি করেন। তখন তার মাথার দাম হাঁকা হয়েছিল। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত বেশীর ভাগ সময় তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে নিহত হওয়ার পর তাকে আবার আত্মগোপনে যেতে হয়। শুধুমাত্র রিক্সাভাড়া পকেটে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে এরশাদ ক্ষমতায় এলে তাকে আবার আত্মগোপনে যেতে হয়। তার স্ত্রী আমিনা আহমেদ স্কুলে চাকরী করে সংসার চালাতেন।

সততাকে ব্রত করেছিলেন তিনিঃ

রাজনীতিতে অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ সততাকে ব্রত করেছিলেন। তার প্রতীকের মতো জীবনটাও ছিল কুঁড়েঘরময়। কিছুদিন আগে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন, কুঁড়েঘরের মোজাফফর বারিধারার ফ্ল্যাটে কেন? সত্যি কথা হচ্ছে, এটি তার মেয়ে জামাতার ফ্ল্যাট। মেয়ের জামাতা প্রয়াত ডা. সৈয়দ খালেদুজ্জামান ছিলেন তার কাছে সন্তানতুল্য। অল্প বয়সে জামাতার জীবনাবসান খুব ভাল ভাবে মেনে নিতে পারেননি তিনি।

আজীবনের স্বপ্নদ্রষ্টাঃ

অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের স্ত্রী আমিনা আহমেদকে জিজ্ঞাশা করেছিলাম, জ্ঞান থাকা অবস্থায় রাজনীতি নিয়ে তার দর্শন কী ছিল? আমেনা আহমেদ বলেন, তিনি স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষ। তিনি বিশ্বাস করেন, শোষণমুক্ত রাজনীতি, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবেই। এবং তা করবে তরুণরা।

বেঁচে থাকুন তিনিঃ

প্রকৃতির চিরাচরিত নিয়মের বিরুদ্ধে আমরা কেউ যেতে পারবোনা। এর পরও প্রত্যাশা, তিনি আরো কিছুদিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকুন। সমাজতন্ত্রের আদর্শ লালনকারী এ রাজনীতিবিদ ধর্ম-কর্মে বিশ্বাস করতেন। আল্লাহর উপর ছিল তার অগাধ আস্থা। সহজ সরল এই রাজনীতিবিদের জন্য শ্রদ্ধা।

একান্ত বিশ্রামের অপেক্ষায় তিনিঃ

বর্তমানে বারিধারার পার্ক রোডে মেয়ের বাড়িতে থাকেন তিনি। গত মাস দেড়েক ধরে জ্ঞান নেই। দিনে দু`বার ডাক্তার এসে দেখে যায়। পৃথিবীতে থেকেও পৃথিবীর অনেক কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন। দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনের সঙ্গী স্ত্রী ও বিধবা মেয়েই সর্বক্ষণ আগলে রাখছেন তাকে। ইতোমধ্যে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, শিল্পমন্ত্রী আমীর হোসেন আমুসহ অনেকে দেখে গেছেন তাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় খোঁজ খবর নেন। অনেকে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন। বিশিষ্ট কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী তাকে নিয়ে `ক্রান্তিকালের মহানায়ক` শিরোনামে লিখে পুরনো ইতিহাসকে অনেকের সামনে নতুন করে জাগিয়ে দিয়েছেন। সব কিছুর মায়া ত্যাগ করে তিনি অপেক্ষা করছেন পরপারের জন্য।

ছবি: অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ।

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি