বুদ্ধিবৃত্তিক অর্থনীতিবিদ ড. আখলাকুর রহমান
প্রকাশিত : ১৬:১৩, ২৫ মে ২০২০
অধ্যাপক ড. এম আখলাকুর রহমান।-ছবি সংগৃহীত।
অধ্যাপক ড. এম আখলাকুর রহমান ছিলেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের একজন সুপরিচিত অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ। অর্থনীতিতে বিশেষ অবদানের জন্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমিতি তাকে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করে। জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পর তিনি লাভ করেছেন আরো একাধিক পুরস্কার। ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক।
বরেণ্য এই অর্থনীতিবিদ ১৯২৫ সালের ৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জের তেঘরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সাত ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। বাবা দারাস চৌধুরী ছিলেন একজন ভূপতি। পেতল, কাপড় এবং ভূমির ব্যবসা ছাড়াও গ্রামের পাঠশালায় শিক্ষকতা করতেন তিনি।
আর এ পাঠশালাতেই মাত্র তিন বছর বয়সে শুরু হয় শিশু আখলাকের প্রাথমিক শিক্ষা। এরপর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার জন্যে প্রথমে বালাগঞ্জ ও পরে হবিগঞ্জে যান। ইন্টারমিডিয়েট করেন সিলেটের মদনমোহন কলেজ থেকে। খুব ভালো ফল করায় এরপর তিনি বিএ পড়তে চলে যান তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের আলীগড়ে। আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৪৭ সালে তিনি বিএ সম্পন্ন করেন।
ঢাকায় ফিরে অর্থনীতিতে এমএ-তে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর তা শেষ করে একই বিভাগে যোগ দেন প্রভাষক হিসেবে। দু’বছরের মাথায়ই রিসার্চ এসিস্টেন্ট হিসেবে চলে যান ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারে। এরপর যোগ দেন পাকিস্তানের পেশওয়ার ইউনিভার্সিটিতে। এ সময় তিনি পাকিস্তান ইকনমিক জার্নালের সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
এরপর ড. আখলাকুর রহমান যোগ দেন করাচিতে অবস্থিত পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকনমিক্সের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ হিসেবে। সেখানে থাকাকালেই ১৯৬২ সালে তিনি পিএইচডি সম্পন্ন করেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে। দেশে ফিরে অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
ড. আখলাকুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনও উল্লেখযোগ্য। সিলেটের মদনমোহন কলেজে পড়ার সময় থেকেই রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি হয়। পূর্ববঙ্গে সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের সক্রিয় কর্মীদের একজন ছিলেন তিনি। রাজনৈতিক তৎপরতার কারণে সেসময় পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন সরকারের রোষানলেও পড়েন তিনি।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ড. আখলাক। সে সময় তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন তরুণ প্রভাষক। একটি দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি গঠনে মাতৃভাষার গুরুত্ব তুলে ধরে যেসব অভিমত তিনি রেখেছেন তা আজো প্রণিধানযোগ্য।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও ভূমিকা রেখেছেন তিনি তার আদর্শিক এবং নৈতিক সমর্থন দিয়ে। ১৯৭১ সালে করাচিতে তিনি ছিলেন পাকিস্তানের একটি সুপরিচিত ব্যাংক ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে। যুদ্ধ শুরু হলে সেখানকার আটকে পড়া বাঙালীদের জন্যে অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করেন ডা. আখলাক।
ড. আখলাক ছিলেন একজন নীতিবান মানুষ। সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদী রাজনীতির অনুসারী হওয়ার কারণে কর্মজীবনে অনেক বড় বড় সুযোগ হাতছাড়া হলেও নীতির প্রশ্নে কখনো আপস করেন নি। গভীর আত্মমর্যাদাবোধের কারণে নিজ থেকে কখনো কারো কাছে কিছু চান নি ড. আখলাক। এমনকি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে একটা সময় দীর্ঘ কারাভোগ করলেও পরবর্তীতে এর কোনো সুবিধাও তিনি নেন নি। একজন সমাজবাদী হিসেবে নিজের আর্থিক সমৃদ্ধি সত্ত্বেও দরিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের কথা কখনো ভোলেন নি ড. আখলাক। দরিদ্রের সেবায়, অসহায়ের সমর্থনে যখন যেখানে ডাক পড়েছে, ছুটে গেছেন।
একবার সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ে ম্যালেরিয়া মহামারী আকারে দেখা দিল। ড. আখলাক তখন অষ্টম বা নবম শ্রেণির ছাত্র। কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীকে নিয়ে ছুটে গেলেন তিনি। দেখেন মৃতপ্রায়, অর্ধউলঙ্গ মানুষগুলো ঘরের ছাদে, গাছের ডালে ঝুলছে। সঙ্গে সঙ্গে এসওএস পাঠিয়ে সাহায্যের আবেদন জানালেন। অবিলম্বে সাড়া এলো। সারা পৃথিবী থেকে মানুষ এগিয়ে এসেছিল বানিয়োচংয়ের এই দুর্গত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে।
ম্যালেরিয়া আক্রান্তদের সেবা করতে করতে ড. আখলাক নিজেও পড়লেন ম্যালেরিয়ার কবলে। মাসাধিককাল তিনি কোমায় ছিলেন শিলংয়ের একটি হাসপাতালে। দীর্ঘ ছয়মাস চিকিৎসার পর সুস্থ হলেন ড. আখলাক। এসব কারণেই পরবর্তী জীবনে দেশে এবং দেশের বাইরে ম্যালেরিয়া নির্মূলের বিভিন্ন কার্যক্রমে ড. আখলাককে আমরা দেখি সফল ভূমিকায়।
আধ্যাত্মিকতার প্রতিও তার ছিল এক দুর্নিবার আকর্ষণ। আর এ আকর্ষণের কারণেই ১৯৭৪ সাল থেকে যোগধ্যানের অনুশীলনে একাত্ম হন। ধ্যানের শক্তিকে ব্যবহার করে বহু মানুষকে হিলিং করেন তিনি। ১৯৮৩ সালে যোগ মেডিটেশন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ড. আখলাকুর রহমান।
ড. আখলাকুর রহমান ১৯৯২ সালের ৪ মে ৬৭ বছর বয়সে মারা যান। তার মহাপ্রয়াণ দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলের এক অপূরণীয় শূন্যতা।
এনএস/