শিক্ষানুরাগী ও দানবীর অমৃত লাল দে’র মৃত্যুবার্ষিকী আজ
প্রকাশিত : ১৬:২৬, ১৪ জুন ২০২০ | আপডেট: ১৬:৫৭, ১৪ জুন ২০২০
অমৃত লাল দে
সবাই তাঁকে ডাকতো বড় কাকু। সব সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নতিকল্পে অকাতরে দানের মধ্য দিয়ে তিনি লাভ করেছেন অসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আজ তিনি নেই, তবে রেখে গেছেন তাঁর আদর্শ ‘কর্মই ধর্ম’।
যে মানুষটি পাহাড়সম দারিদ্র্য নিয়ে পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন, সেই মানুষটিই এখন পেয়েছেন দানবীর খ্যাতি। যে মানুষটি অর্থের অভাবে মা-বাবা-ভাইয়ের চিকিৎসা করাতে পারেননি, তাঁর সহযোগিতায় এখন শত শত অসহায় রোগী পাচ্ছে বিনামূল্যে চিকিৎসা। যিনি শৈশব-কৈশোরে আর্থিক সংকটে শিক্ষার তেমন একটা সুযোগই পাননি, সেই না পাওয়ার অনুভূতি থেকেই শিক্ষার প্রতি জন্মেছে তাঁর গভীর ভালোবাসা। তাই শিক্ষা বিস্তারে তিনি রেখেছেন অতুলনীয় স্বাক্ষর। তাঁর প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই ক্ষণজন্মা প্রবাদপুরুষটি হলেন- মানবপ্রেমিক অমৃত লাল দে।
অমৃত লাল দে ১৯২৪ সালের ২৭ জুন তৎকালীন ফরিদপুর জেলার আঙ্গারিয়া গ্রামের একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম রাসমোহন দে এবং মা সারদা দেবী। বাবা রাসমোহন ছিলেন সাধারণ কৃষক। অমৃত লালসহ পাঁচ সন্তান ছিল রাসমোহনের। একান্নবর্তী সংসারের ব্যয়ভার বহন করতে হিমশিম খেতে হতো তাঁকে। অর্থাভাবে লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যায় অমৃত লালের। অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মারা যান মা। চাক্ষুষ মায়ের মৃত্যু দেখার পর অমৃত লালের জীবনে আসে বিরাট পরিবর্তন। ১৯৩৯ সালে ১৫ বছরের কিশোর অমৃত লাল দে তাঁর পরিবারে দেখেন অভাবের তীব্রতা। অসুস্থ বাবা কাজে যেতে পারতেন না।
তাঁর দূরসম্পর্কের ভাই বলরাম বিড়ির কারখানায় কাজ করতেন। তাঁর সহযোগিতায় কার্তিকপুর বাজারে একটি বিড়ির কারখানায় কাজ শুরু করেন অমৃত লাল। দিন-রাত পরিশ্রম করেও সংসারের অভাব দূর করতে পারলেন না। ১৯৪২ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। গ্রামে তাঁর বিড়ির কাজ বন্ধ হয়ে গেল। গ্রামে কাজ না থাকায় কাজের সন্ধানে বরিশালে আসেন অমৃত লাল। কাজ নেন কালিবাড়ী রোডস্থ জীবন বিড়ি ফ্যাক্টরিতে। সেখানে প্রতিদিন দুই টাকার মতো আয় হতো তার। জীবন বিড়ি কারখানার ম্যানেজার সুরেশ বাবু কালিবাড়ী রোডে একটি নতুন দোকান নিলেন। সেই দোকানে ম্যানেজারের পদে অমৃত লালের চাকরি হলো মাসিক ৬০ টাকা বেতনে। তার সঙ্গে অতিরিক্তভাবে বিড়ি বেঁধে আরো মাসে ৫০-৬০ টাকা আয় করা যেত। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মমতা। অমৃত লালের সংসারে সচ্ছলতা উঁকি দিতেই জীবন বিড়ির মালিক অমৃত লালকে ম্যানেজারের পদ থেকে সরিয়ে সেখানে তাঁর এক নিকটাত্মীয়কে বসালেন। অমৃত লাল দে আবার বিড়ি বাঁধার দায়িত্ব পেলেন।
এরই মধ্যে একটি দোকান নিয়েও অর্থাভাবে তা চালু করতে পারছিলেন না। বন্ধু অনন্ত কুমার দাস কলকাতা থেকে ফিরলেন। দুজনে মিলে ঠিক করলেন পান-বিড়ির দোকান খুলবেন। ১২ টাকা পুঁজি নিয়ে গরিব ও দুস্থ মানুষের সেবা, একটি সমৃদ্ধিশালী দেশ গঠন ও শৃঙ্খলাবোধ—এই তিনটি আদর্শকে সামনে রেখে ১৯৪৮ সালে বরিশালের বিবিরপুকুর এলাকায় বন্ধু অনন্ত কুমার দাসের সঙ্গে মিলে নিজ হাতে বিড়ি তৈরি করে তা বিক্রি শুরু করেন অমৃত লাল দে। ধীরে ধীরে সেই প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ বাংলার অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। নাম তার কারিকর বিড়ি ফ্যাক্টরি।
জীবনের অন্তিম অধ্যায়ে অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি তাঁর সার্থক সমাপ্তি টানলেন। নিজের নামে মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯৩ সালের ১৪ জুন (৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪০০) ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষ পাড়ি জমান পরপারে। তবে তাঁর কীর্তি আর মানবসেবা অনুসরণ করে হাঁটছেন সাদা মনের মানুষ ছোট ভাই বিজয় কৃষ্ণ দে। কারিকর বিড়ি ফ্যাক্টরি ও অমৃত ফুড প্রডাক্ট-এর ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর ভানু লাল দে (ভাতিজা) বলেন, ‘প্রতিবছর অন্তত অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী অমৃত পরিবারের অনুদানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে।’
এরই ধারাবাহিকতায় অমৃত লাল দের ভাই রাখাল চন্দ্র দে ও বিজয় কৃষ্ণ দে নগরে প্রতিষ্ঠা করেছেন অমৃত লাল দে কিন্ডারগার্টেন। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন অমৃত লাল দে আয়ুর্বেদ ও ইউনানি মহাবিদ্যালয় ও অমৃত লাল দে সংগীত একাডেমি। এ ছাড়া অমৃত-যোগমায়া আধ্যাত্ম চর্চা এবং অমৃত লাইব্রেরিও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ভানু লাল দে আরও বলেন, ‘চলমান বৈশ্বিক মহামারীতে দেশের হাজারো কোভিড-১৯ আক্রান্ত মানুষের সাথে আমাদের পরিবারের বর্তমান অভিভাবক বিজয় কৃষ্ণ দে-ও আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ। তার আশু রোগ মুক্তিতে সকলের কাছে প্রার্থনা করার অনুরোধ করছি।
এছাড়াও তিনি বলেন, আমাদের বড় কাকু দুর্যোগের সময় মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। তিনিই শিখিয়েছেন দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে। ১৯৮৮ ও ১৯৯০ সালে বন্যার সময় দাদা বানভাসি মানুষের পাশে ছিলেন। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর যখন দক্ষিণাঞ্চলসহ গোটা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে তখন অমৃত পরিবার সাধ্যানুযায়ী ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ছুটে গিয়েছে দুর্গত মানুষের পাশে। অমৃত পরিবার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের হাতে পৌঁছে দেয় ত্রাণসামগ্রী। ভবিষ্যতেও থাকতে চাই। যতদিন বেঁচে থাকব অমৃত লাল দের আদর্শ ধারণ করব।’
কেআই/এনএস/