ঢাকা, শুক্রবার   ১১ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীর বর্ণাঢ্য জীবন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৩:৪৮, ২০ জুন ২০২০

Ekushey Television Ltd.

বরেণ্য সাংবাদিক ও জাতীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী। প্রগতিশীল ছাত্রনেতা, ভাষাসংগ্রামী, বিপ্লবী রাজবন্দী, তেজোদীপ্ত সাংবাদিক-এমন বহু পরিচয়ের বিরল সমাবেশ ঘটেছিল তার ব্যক্তিত্বে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন অকুতোভয় সাংস্কৃতিক যোদ্ধা হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তিনি পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর প্রাক্তন মহাপরিচালক কামাল লোহানী আজ সকাল ১০টায় না ফেরার দেশে চলে যান (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন)। গত ১৭ জুন ২০২০ বুধবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে রাজধানীর পান্থপথের হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হন প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী।

দীর্ঘদিন ধরে তিনি ফুসফুস ও কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত ছিলেন। ১৯ জুন ২০২০ শুক্রবার তার নমুনা পরীক্ষার রিপোর্টে করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। এরপর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। অবশেষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।

জন্ম ও পরিবার

কামাল লোহানীর জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন ব্রিটিশ সাম্রাজের অধীনে বাংলায় (সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার সনতলা গ্রামে)। তার পুরো নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। তার বাবা প্রয়াত আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী। মা মরহুমা রোকেয়া খান লোহানী। শৈশবেই মা-কে হারান তিনি। এরপর কলকাতায় ফুপু-মার বাড়িতে এবং পরবর্তীকালে চাচার কাছে পাবনায় বেড়ে ওঠেন।

১৯৬০ সালে কামাল লোহানী বিয়ে করেছিলেন তারই চাচাতো বোন দীপ্তি লোহানীকে। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যয়নকালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী এবং আন্দোলনের সাথী ছিল স্ত্রী দীপ্তি লোহানী। প্রয়াত দীপ্তি লোহানী ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন শব্দসৈনিক।

কামাল লোহানী ও দীপ্তি লোহানী দম্পতির এক ছেলে ও দুই মেয়ে। তারা হলেন-সাগর লোহানী, বন্যা লোহানী, ঊর্মি লোহানী। প্রত্যেকেই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট। পুত্র সাগর লোহানী পেশায় সাংবাদিকতা এবং চিত্র নির্মাণের সাথে যুক্ত। জ্যেষ্ঠ কন্যা বন্যা লোহানী চাকুরীর পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করছেন। কনিষ্ঠ কন্যা ঊর্মি লোহানী অনলাইন আর্কাইভ গুণীজন ডট কম পরিচালনায় সম্পৃক্ত ।

শিক্ষাজীবন

কলকাতায় শিশু বিদ্যাপীঠে তার পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে পাবনা চলে আসেন কামাল লোহানী। ভর্তি হন পাবনা জিলা স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে। ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। এই কলেজ থেকেই উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। তরুণ বয়সেই কলজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন তিনি।

দেশপ্রেমের অনন্য নজির

১৯৫২ সালে রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি মাত্র ১৬ বছর বয়সে; রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। কলেজে অধ্যয়নকালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনে শামিল হন তিনি। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের পাবনা সফরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও মুসলিম লীগ সম্মেলন ভণ্ডুল করে দিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি এবং প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হন।

এ পথ মসৃণ নয় জেনেও তিনি ১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচনে নব্যগঠিত যুক্তফ্রন্টের হয়ে কাজ করতে গিয়ে পুনরায় গ্রেফতার হন। এই কারাবাসের সময়ে তিনি কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে দীক্ষিত হন এবং আজীবন সেই আদর্শে অবিচল ছিলেন। ১৯৫৫ সালে পুনরায় গ্রেপ্তার হলে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখের সঙ্গে একই জেলকক্ষে বন্দিজীবন কাটান। সেই বন্দি দিনগুলোতে তিনি বঙ্গবন্ধুর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হন এবং তার স্নেহসান্নিধ্যে আসেন।

১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের সময় সাংবাদিক হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। সংসার, পেশা আর সক্রিয় রাজনীতি নিয়ে তার সময় পার হচ্ছিল তখন। একে এক মুসলিম লীগ বিরোধী আন্দোলন, ছয় দফা, ১১ দফা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে তার সশরীরে উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, মাতৃভূমির মাটিকে শোষণমুক্ত করে স্বাধীনতা উপহার দিতে তিনি কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন। এরই ধারাবাহিকতায় দেশকে দখলদারমুক্ত ও মুক্তিফৌজকে সহযোগিতা এবং পূর্ব পাকিস্থানের জনগণকে উজ্জীবিত রাখতে ভারত সরকার, সংস্কৃতি ও বেতারকর্মীদের সম্মিলিত প্রয়াসে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এ বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন কামাল লোহানী।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেই প্রথমবারের মতো বাঙালি জাতির বিজয়ের সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেদিনের সেই চূড়ান্ত বিজয়ের ঘোষণা পাঠ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন কামাল লোহানী।

সাদামাটা জীবনযাপন

জীবনযাপনে খুব সাদামাটা-সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন কামাল লোহানী। তার পোশাক-পরিচ্ছদে কোনো বাহুল্য কখনই ছিল না। একছাঁটের লম্বা ঝুলের সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী তার একমাত্র পরিধেয়। স্যুট-কোট পরতে হবে বলে একবার রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে বিদেশে যেতেও অস্বীকৃতি জানান তিনি।

সফল সাংবাদিক, দক্ষ সংগঠক, মননশীল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

ঢাকায় ১৯৫৫ সালে দৈনিক মিল্লাত-এ সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন কামাল লোহানী। পরবর্তীকালে তিনি বিভিন্ন সময়ে দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তা-সহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নে দু-দফায় যুগ্ম-সম্পাদক এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হন। তিনি গণশিল্পী সংস্থার সভাপতি ছিলেন। ১৯৬২ সালে স্বল্পকালীন কারাবাসের পর কামাল লোহানী সদ্যগঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রায় সাড়ে চার বছর এ দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

তার জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল সংস্কৃতিচর্চা। পঞ্চাশের দশকে সংস্কৃতি সংসদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা গড়ে ওঠে তার। বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটি, ছায়ানট প্রভৃতি প্রথম সারির সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। নকশী কাঁথার মাঠ, শ্যামা, ক্ষুধিত পাষাণ নৃত্যনাট্যে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।

মার্কসবাদী আদর্শে ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন রাজনৈতিক আদর্শে সাংস্কৃতিক সংগঠন 'ক্রান্তি'। ক্রান্তির সবচেয়ে বড় সম্পদ তার গণসঙ্গীত। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সালের বাঁধভাঙা তুমুল গণআন্দোলনের দিনগুলোতে ক্রান্তিসহ তিনি বাংলার হাটে-মাঠে গণসঙ্গীত গেয়ে উজ্জীবিত করেছেন এদেশের মানুষকে। এর উদ্দেশ্যই ছিল বাংলার নিপীড়িত মানুষকে অভয় দেয়া।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের তৎপরতায় বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক হিসেবে ঢাকায় নিয়োগপ্রাপ্ত হন কামাল লোহানী। ১৯৭৩ সালে তিনি ফিরে আসেন সাংবাদিকতা পেশায়। ১৯৮১ সালে তিনি সংবাদপত্রের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। এরপর নব উদ্যমে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন কামাল লোহানী।

তিনি আমাদের দেশের আরেকজন প্রথিতযশা সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ফয়েজ আহমেদের সঙ্গে মিলে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কামাল লোহানী বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি ছিলেন চার বছর এবং কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন দুই দফায়। কামাল লোহানী উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

লেখক জীবন

কামাল লোহানীর লেখা প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে- ‘আমাদের সংস্কৃতি ও সংগ্রাম’, ‘আমরা হারবো না’, ‘সত্যি কথা বলতে কি’, ‘লড়াইয়ের গান’, ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নৃত্যশিল্পের বিস্তার’, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার’, ‘এদেশ আমার গর্ব’, ‘মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার’, ‘যেন ভুলে না যাই’, ‘রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতার’, ‘দ্রোহে প্রেমে কবিতার মত’ প্রভৃতি। এছাড়াও তার ঘটনাবহুল সাংবাদিকতা জীবন সম্পর্কে তার নিজের বাণীকে লেখ্যরূপে প্রেস ইন্সটিটিউট অফ বাংলাদেশ প্রকাশ করেছে ‘অগ্রজের সঙ্গে একদিন’।

সম্মাননা ও পদক:

২০১৫ সালে সাংবাদিকতায় একুশে পদক লাভ করেন কামাল লোহানী। তিনি জাহানারা ইমাম পদক পেয়েছেন ২০০৮ সালে। কলকাতা পুরসভার দ্বিশতবর্ষ সম্মাননা পেয়েছেন তিনি ১৯৯১ সালে। প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক সম্মাননা এবং রাজশাহী লেখক সংঘ সম্মাননা পান তিনি। এ ছাড়া ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর ক্রান্তি স্মারক- ২০০৩, ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর ঋষিজ সম্মাননা ও স্মারক সহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।

আমৃত্যু তার দীপ্ত কণ্ঠ সোচ্চার ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। তিনি সবসময় ভেবেছেন দেশের সাধারণ মানুষের কথা, দেশের মঙ্গলের কথা। সংগ্রামে-মিছিলে মাঠে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন যে মানুষটি, আজ তিনি জীবনের ওপারে। আমরা তাকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। পরম করুণাময় তার দেশপ্রেম ও সকল সৎকর্ম কবুল করুন।

এমবি//
 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি