ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

বঙ্গবন্ধু, তার জীবন ও রাজনীতি

জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী

প্রকাশিত : ১৫:০৪, ২৯ জুন ২০২০

একেক জাতির ইতিহাসে একেক নেতার নাম, রাষ্ট্রনায়কের নাম, স্রষ্টার নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত হয়ে যায়। সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে লেনিনের, তুরস্কের সঙ্গে কামাল আতাতুর্কের, ভারতের সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর, নয়া চীনের সঙ্গে মাও সেতুং-এর নাম যেমনভাবে জড়িয়ে আছে, বাংলাদেশের সঙ্গে তেমনি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। এ এমন এক প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, ওই সত্যকে অস্বীকার করার চেষ্টা বাতুলতার নামান্তর। দুঃখের বিষয়, লজ্জার বিষয়- সে চেষ্টাও হয়েছে এবং সে চেষ্টা করুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সে চেষ্টা কারা করেছিল, কেন করেছিল, কিছুই রহস্যাবৃত নয় আমাদের কাছে। 

রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণ করে এরা বঙ্গবন্ধুকে জাতির স্মৃতি থেকে মুছে ফেলার অপচেষ্টাও করেছিল। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যার দিন জাতীয় শোক দিবস সংক্রান্ত আইনি সিদ্ধান্ত ওরা বাতিল করে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে এ দিনটি উদযাপন বন্ধ করে দেয়। সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারে ইতিহাসেও এর মতো সভ্যতা-শালীনতা এমনকি কাণ্ডজ্ঞান-বিরিহিত অপকর্মের দ্বিতীয় নজির খুঁজে পাওয়া ভার। এই শোকের দিনকে আনন্দ ও উৎসবের দিনে পরিণত করার উকট পরিকল্পনাও কারও কারও মাথায় এসেছিল। অনেক রকমের মস্তিষ্কবিকৃতি রয়েছে, তবে এই বিকৃতিও তুলনাবিহীন। 

হাইকোর্টের রায়ে ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এবং বর্তমানে জরুরি অবস্থার সরকার এর বৈধতা মেনে নিয়েছে। দিনটি সরকারিভাবে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হবে। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে এবং সরকারপ্রধানসহ আরও দুজন উপদেষ্টা ওইদিন টুঙ্গিপাড়ায় যাবেন, বঙ্গবন্ধুর মাজারে গিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন- সংবাদসূত্রে আমরা এ তথ্য জানতে পারলাম। এই শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ভেতর দিয়ে যে বার্তাটি সারাদেশ পাবে, তা হলো- জাতির পিতা, রাষ্ট্রের স্থপতি পরিচয়ে বঙ্গবন্ধু- এ এক প্রতিষ্ঠিত সত্য। দলীয়ভাবে এ সত্য কিছুদিনের জন্য ছাইচাপা থাকতে পারে, কিন্তু সত্যের স্ফুলিঙ্গ নেভে না।
 
সত্যের সঙ্গে অসত্যের বিরোধ চিরকাল। অসত্য যদি কোনোভাবে ক্ষমতায় আসে। তখন এই বিরোধটা প্রকট হয়ে ওঠে। অসত্য কখনও নিজের শক্তিতে দাঁড়াতে পারে না। তার প্রয়োজন হয় সহায়ক শক্তির। যেমন রাজনৈতিক ক্ষমতা। রাজনৈতিক ক্ষমতার লম্বা হাত। সে হাত সংস্কৃতির নিরপেক্ষতার দুর্গ পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে। বাংলাদেশে এর বড় দৃষ্টান্ত বাংলা একাডেমী। বাংলা একাডেমীর কাজ পুরোপুরি সাংস্কৃতিক- বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা প্রকাশনা ইত্যাদি। বাংলা একাডেমী সরকারি অর্থে পরিচালিত, যদিও বিস্তর বই প্রকাশনার সূত্রে এর নিজস্ব আয়েরও একটা উপায় আছে, তবে এর বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজন হয় সরকারি অর্থ বরাদ্দের। অনেক ভালো কাজ সম্পন্ন হয়েছে সরকারি অর্থ বরাদ্দের সুবাদে। এমনি একটি প্রকল্পের আওতায় বাংলা একাডেমী দেশের পাঁচজন জাতীয় নেতার জীবনীগ্রন্থ প্রকাশের যে উদ্যোগ গ্রহণ করে, বঙ্গবন্ধুর জীবনীগ্রন্থ রচনা তার অন্তর্ভুক্ত।

বেশকিছু বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে শেষপর্যন্ত বিগত একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে দুই খণ্ডে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : জীবন ও রাজনীতি’। বঙ্গবন্ধুর ওপর এটি বাংলাভাষার প্রথম পূর্ণাঙ্গ জীবনীর স্বীকৃতি লাভ করবে। ইংরেজিভাষায় অবশ্য ইতিপূর্বে প্রকাশিত এসএ করিমের ‘শেখ মুজিব, ট্রয়াম অ্যান্ড ট্র্যাজেডি’ এ ধারায় প্রথম বই। এক গবেষণার ফল এ বইয়ের সঙ্গে বাংলা একাডেমী প্রকাশিত দুই খণ্ডে সমাপ্ত বইয়ের তুলনা অন্য কেউ করবেন। সেজন্য যে বিশেষ যোগ্যতার প্রয়োজন, তা আমার নেই। আমি শুধু একটি মৌলিক প্রভেদের কথা বলতে চাই। ইংরেজি বইটি গ্রন্থকারের একক গবেষণার ফল, আর বাংলা বইটি একাধিক ব্যক্তির সমষ্টিগত গবেষণার ফল। এই সমষ্টির কাজ সম্পন্ন হয়েছে বা পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেছে বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ। ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শাহ এএমএস কিবরিয়া, যিনি ঘাতকের গ্রেনেড হামলায় ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি নিহত হন। ফাউন্ডেশনের বর্তমান কর্ণধার জনাব মোনায়েম সরকার একদল গবেষকের কাজের সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করে সবার কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত বইয়ের সম্পাদকও তিনি। তার ভূমিকায় বইটির পরিকল্পনা, রচনা, তথ্য সংগ্রহ, সম্পাদনা ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। কৃতজ্ঞতা স্বীকারেও কোনো কার্পণ্য করেননি তিনি। কাউকে দোষারোপ না করে একটি সংক্ষিপ্ত বাক্যে তিনি জানিয়েছেন। বিভিন্ন কারণে গ্রন্থটি প্রকাশে দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর জীবনীর সিংহভাগ জুড়ে থাকবে রাজনীতি, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। সব রাজনীতিকের জীবনী বলতে তাদের রাজনৈতিক জীবনই বোঝায়। আত্মজীবনী ও এঁদের বেলায় ব্যক্তিজীবনের কাহিনী নয়। বঙ্গবন্ধুর বেলায় ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন ছিল একটি প্রান্তবর্তী বিষয়। তিনি যে-ধরনের রাজনীতি করেছেন, সেখানে রাজনীতি তার দিনরাত্রির সব প্রহর দাবি করেছে। তিনি সে দাবির কাছে নতিস্বীকার করেছেন। এর মধ্যেও তার এই জীবনীগ্রন্থে ব্যক্তি মুজিবের দেখা মেলে, কচিৎ কদাচিৎ এবং কয়েকটি ব্যক্তিগত পত্রে আমরা সেই ব্যক্তিটিকে পাই। অত্যন্ত ব্যস্ত জীবনেও তাঁর পুত্র পরিচয়ে, স্বামী ও পিতা পরিচয়ে, নিকটাত্মীয়দের প্রতি স্নেহ ও প্রীতিপরায়ণ ব্যক্তি হিসেবে, তাঁর সমগ্র পরিচয়, কোনোদিন অজানা ছিল না দেশবাসীর কাছে। নানা সূত্রে আমরা এ বিষয়ে যা জানার জানতে পেরেছি। তার জীবনীরচয়িতার কাছে আমাদের মুখ্য দাবি, তাঁর রাজনৈতিক জীবন তুলে ধরা- সে রাজনীতি কীভাবে তাকে গড়েছিল আর তিনি সে রাজনীতিকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিলেন তার বিশদ উপস্থাপনা। 

অবিভক্ত বাংলার ‘৩৭ (১৯৩৭)-এর নির্বাচন ও ‘৪৭-এর দেশবিভাগ এবং স্বাধীনতা এই দশকের রাজনীতি মূলত মুসলিম লীগের উত্থান ও সাফল্যের কাহিনী। এই সাফল্য মুসলিম লীগের একক কৃতিত্ব নয়, এর পেছনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অবদানও প্রচুর। ভারত বিভক্তির জন্য জিন্নাহ ও তার মুসলিম লীগকে দায়ী করার প্রবণতা এখন ক্ষান্ত। পণ্ডিত নেহরু, সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল পরিচালিত কংগ্রেসের দায়দায়িত্ব ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ইতিহাসবিদের দৃষ্টিতে। শেখ মুজিব ওই দশকেই তার রাজনীতি শুরু করেন মুসলিম লীগের তরুণ ও তেজী কর্মী হিসেবে এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নজর কাড়েন। তাঁর এই রাজনৈতিক শিষ্যত্ব তার রাজনৈতিক চেতনার বিকাশে অত্যন্ত কার্যকর হয়েছিল। তাঁর এই শিষ্যত্ব থেকেই শেষপর্যন্ত আওয়ামী লীগের তথা স্বাধিকার আন্দোলনের নেতৃত্বের দায় তাঁর ওপর বর্তেছিল। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির এবং দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতির যে পাঠ তিনি গ্রহণ করেছিলেন সোহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে, সেটা তিনি কোনোদিন ভোলেননি।
 
মুসলিম লীগ রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগ রাজনীতির ঊর্ধ্বতন আমাদের রাজনীতির ইতিহাসে একটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এ ঘটনায় যারা প্রধান পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁদের মধ্যে প্রধান। প্রাক-সাতচল্লিশ মুসলিম রাজনীতির লক্ষ্য পূরণ হওয়ার পর সেই লক্ষ্যের মধ্যে যুগোপযোগী পরিবর্তন আনতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয় পাকিস্তানের শাসকরা, যারা সবাই মুখে গণতন্ত্রের কথা বলতেন। কিন্তু বাস্তবে গণতন্ত্রের চর্চা করেননি। পূর্বপাকিস্তানে ক্ষমতার আসনে ছিল মুসলিম লীগ, আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল তাদের। কিন্তু বছরের পর বছর তারা আইনসভার শূন্য আসনে কোনো উপনির্বাচন দেয়নি। প্রথম যে উপনির্বাচন দিলো তাতে লজ্জাজনকভাবে পরাজিত হলো মুসলিম লীগ। অর্থাৎ ইতিমধ্যে এই দল তার সংশ্লিষ্টতা হারিয়েছিল, এমনকি পূর্বপাকিস্তানের প্রতি কেন্দ্রের যে অবহেলা, তারও প্রতিবাদ করার নৈতিক বল হরিয়ে বসেছিল।

শেখ মুজিবের উত্থানের পেছনে যে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পটভূমি তার জীবনী যিনিই লিখুন, যেভাবেই লিখুন, সেটা গুরুত্বসহকারে বিবেচনার দাবি রাখে। সেই হতাশা ও বঞ্চনার যুগে তিনি পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান পুরুষে পরিণত হন। তাঁকে দমন করার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। সবচেয়ে মারাত্মক প্রচেষ্টা ছিল তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করা। প্রবল প্রতিবাদ প্রতিরোধের মুখে এ মামলা পরিত্যক্ত হয়। এই মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে তিনি যখন মুক্ত হয়ে আসেন ততদিনে তিনি বীরের মর্যাদা লাভ করেছেন। তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে সব বাঙালির আশা- আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। যে আস্থা তার ওপর অর্পিত হয়েছিল তিনি তার মর্যাদা রক্ষা করেছেন, নিজে শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থেকেও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা হয়ে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় নিশ্চিত করেছিল সত্তরের নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হওয়ায় একাত্তরে তাজউদ্দিন আহমদের সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের বৈধ সরকারের দাবি নিয়ে কথা বলার ও কাজ করার অধিকার ছিল। সন্দেহ মাত্র নেই যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ভিত্তি রচনা করেছিল শেখ মুজ্জিবের নেতৃত্বে সত্তরের নির্বাচনে জয়। 

স্বাধীনতার পর, রাষ্ট্রপ্রধান সরকারপ্রধানের ভূমিকায় শেখ মুজিবের কৃতিত্ব নিয়ে ঐকমত্য নেই। সৈয়দ আনোয়ারুল করিম এককথায় এই সময়কে ট্রাজেডি বলে রায় দিয়েছেন। ট্র্যাজেডি বলতেই বোঝায় নায়কের পতন। নায়কের মৃত্যু ও তার পতন একসূত্রে গাঁথা। ট্র্যাজেডির এই ব্যাখ্যা। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকে তার পতনের অনিবার্য পরিণতি, এই সরল ব্যাখ্যা আমাকে সন্তুষ্ট করে না। আসলেই তার পতন হয়েছিল কিনা সেটাও বিতর্কের বিষয়। আমার ধারণা, তিনি ব্যর্থতার মধ্যদিয়ে বেরিয়ে আসার এক নতুন দিকনির্দেশনার দিকেই অগ্রসর হচ্ছিলেন। চক্রান্তকারীরা তাকে সে সুযোগ দেয়নি। তার মৃত্যুর জন্য ঘাতকের ভূমিকা প্রত্যক্ষ হতে পারে। কিন্তু চক্রান্তকারীদের পরোক্ষ ভূমিকা পরোক্ষ বলেই গৌণ নয়। দেশে ও বিদেশে এই চক্রান্তের জাল বিস্তৃত হয়েছিল। তার হত্যা-পরবর্তী ১৫ বছরের সেনাশাসন এই চক্রান্তের পরিধি নির্দেশ করে।

একদিকে অন্ধ বিরোধিতা, অন্যদিকে অন্ধ মোহ- এই দুই প্রবণতার আকর্ষণমুক্ত হয়ে একটি বস্তুনিষ্ঠ জীবনী রচনার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় মোনায়েম সরকার সম্পাদিত গ্রন্থে। এজন্য গবেষকদেরকে সব ঘটনার উৎস সন্ধান করতে হয়েছে এবং এতকাল অজানা বেশকিছু গোপনীয় দলিল খুঁজে পেতে হয়েছে। সত্যানুসন্ধানের আন্তরিক প্রচেষ্টার এই ফসল এতদিনের একটা অভাব পূর্ণ করল, এজন্য গ্রন্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই আমাদের অকুণ্ঠ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার পাত্র।


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি