ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

শ্রদ্ধাঞ্জলি সাংবাদিক বেবী মওদুদ

দুলাল আচার্য

প্রকাশিত : ১১:৫৪, ২৫ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ১৩:৪০, ২৫ জুলাই ২০২০

সাংবাদিক বেবী মওদুদ

সাংবাদিক বেবী মওদুদ

আজ (২৫ জুলাই) সাংবাদিক বেবী মওদুদের ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। জীবনের শেষ কয়েকটা বছর ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে ২০১৪ সালের ২৫ জুলাই মৃত্যুর কাছে হার মানেন তিনি। সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নারী নেত্রী, সাংস্কৃতিক কর্মী, সচেতন রাজনৈতিক কর্মী নানা পরিচয়ে তিনি পরিচিত ছিলেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্সসহ মাস্টার্স করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। নব্বইয়ের দশকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনেও সোচ্চার ছিলেন তিনি। কর্মজীবনে ‘সাপ্তাহিক ললনা’, ‘দৈনিক সংবাদ’, ‘দৈনিক ইত্তেফাক’, ‘দৈনিক মুক্তকণ্ঠ’ ও ‘বিবিসি’-তে কাজ করেছেন বেবী মওদুদ। 

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)’র ‘বাংলা বিভাগ’টি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার অনন্য ভূমিকা ছিল তার। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। ছিলেন ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকও। জীবনের শেষ দিকে বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকমের স্যোসাল এফেয়ার সম্পাদক ছিলেন। নবম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের একজন সম্মানিত সদস্য হিসেবে জনপ্রতিনিধিত্ব করেছেন বেবী মওদুদ।

আমার কাছে তিনি ছিলেন একজন স্নেহময়ী মা, বড় বোনের প্রতীক। জাতির পিতার কন্যা শেখ রেহানা প্রকাশিত ও সম্পাদিত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজ করতে গিয়ে বেবী আপাকে অনেক কাছ থেকে জানার সুযোগ হয়েছিল আমার। একই সঙ্গে তাঁর স্নেহধন্য হওয়ায় অনেক স্মৃতিময় ঘটনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করারও সৌভাগ্য হয়েছিল। আজ বেবী আপা নেই কিন্তু তাঁকে ঘিরে অনেক কথা, অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কাছে এক বড় আবেগের জায়গা ছিল। 

সুধাসদনকে মনে করতেন তাঁর সেকেন্ড হোম। প্রতিদিন সুধাসদনে যাওয়া যেন বেবী আপার রুটিন ছিল। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শেখ হাসিনার গ্রেফতারে তিনি প্রচন্ডভাবে ভেঙ্গে পড়েন। নিঃসঙ্গ মনে হতো তাঁকে। অসহায়ের মতো বিচিত্রা অফিসে আসতেন। কারও সঙ্গে খুব একটা কথা বলতেন না। সময়টা এতটাই বৈরি ছিলো যে তখন আমাদের সবার মনেই এক অজানা আতঙ্ক দেখা দেয়। বিচিত্রা অফিসের চারদিকে সব সময়ই গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন ঘুর ঘুর করত। অফিসে আসা-যাওয়ার মাঝেই বিষয়টা আমরা বুঝতে পারতাম। 

ইতোমধ্যে অনেক লেখক নানা রহস্যজনক কারণে বিচিত্রায় লেখা বন্ধ করে দেন। এমনকি আয়ের উৎস যে বিজ্ঞাপন তাও অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিল তখন। একদিন বেবী আপা বললেন, আর পারছি না। পত্রিকাটি বুঝি আর চালানো যাবে না। কোথায় পাব এত টাকা? সে বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর বিচিত্রা বন্ধ হয়ে যায়। 

উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালের ১ অক্টোবর থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি থেকে শেখ রেহানার সম্পাদনায় নতুনভাবে, নতুন ব্যবস্থাপনায় চলা শুরু হয় বিচিত্রার। একই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে বেবী আপার কল্যাণে বিচিত্রায় আমারও পথচলা।

বেবী মওদুদ প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তবে শিশু-সাহিত্যিক হিসেবেই তাঁর খ্যাতি ব্যাপক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো- মনে মনে (ছোট গল্প), শেখ মুজিবের ছেলেবেলা, দীপ্তর জন্য ভালোবাসা, পবিত্র রোকেয়া পাঠ, টুনুর হারিয়ে যাওয়া, দুঃখ-কষ্ট ভালোবাসা, গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা, শান্তর আনন্দ, এক যে ছেলে আনু, মুক্তিযোদ্ধা মানিক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার পরিবার, আমার  রোকেয়া ও কিশোর সাহিত্য সমগ্র, নিবন্ধ সমগ্র ‘অন্তরে বাহিরে’। 

বিচিত্রার কাজ করতে গিয়ে বেবী আপার কিছু লেখালেখির কাজও খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। আমি এসবে যুক্ত থাকতে পেরে এখনও গর্ববোধ করি। শিশুতোষ বই ‘দীপ্তর জন্য ভালোবাসা’ বেবী আপার ছোট ছেলে শফিউল হাসান দীপ্তর (পুটু মামা) জীবনের ছায়া অবলম্বনে। কাহিনী একজন প্রতিবন্ধী শিশুর বেড়ে ওঠার। লেখাটির প্রুফ দেখতে গিয়ে আমি অনেকবার কেঁদেছি। আমি মনে করি দীপ্তর জন্য ভালোবাসা বইটি ছোটদের জন্য অসাধারণ দৃষ্টান্ত হয়ে পারে। 

এক সময় দেখতাম বেগম রোকেয়ার নিজের লেখা এবং তাঁর সম্পর্কীয় রেফারেন্স অনেক বই বেবী আপা অফিসে পড়ছেন। আর প্রতিদিনই কিছু কিছু পয়েন্ট চম্পকদাকে কম্পোজ করতে দিতেন। কিছুদিন পর দেখলাম এগুলো সংযুক্ত করে হয়ে গেল ‘পবিত্র রোকেয়া পাঠ।’ বেগম রোকেয়াকে সহজভাবে উপলব্ধি করার একটা অসাধারণ পুস্তিকা। বেবী আপা বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও প্রচুর কাজ করেছেন। 

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর প্রথম দিককার কাজগুলোতে তাঁর শ্রম খুব কাছ থেকে দেখেছি। এই গ্রন্থে আমারও কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। বিচিত্রার শেষের পাতায় প্রতি সপ্তাহে বেবী আপার একটি নিয়মিত কলাম বের হতো। ‘অন্তরে বাহিরে’ নামে এই লেখাগুলো সঙ্কলিত হয়ে পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। যাতে তার ব্যক্তি জীবনের ছায়া ছিল।

এবারের বিষয়টি নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত। মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত ‘নি:সঙ্গ কারাগারে শেখ হাসিনার ৩৩১ দিন’ বইটি প্রকাশের পর বেবী আপা একদিন আমাকে খবর পাঠালেন আমি যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি। একদিন সন্ধ্যায় লালমাটিয়ার তখনকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম অফিসে তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আমাকে একটি খাম দিয়ে বললেন এটা রাখো, মাওলা ব্রাদার্স লেখক সম্মানী দিয়েছে। আমিতো অবাক! আমি যে বিষয়টা বুঝতে পারিনি বেবী আপা সেটা বুঝতে পারলেন, তিনি ড্রয়ার থেকে একটি বই বের করে বললেন নাও। এখানে প্রথম দিককার সংকলিত লেখাগুলো তোমার। উল্লেখ্য, বইটির বাকী অংশে বেবী আপা ও রঞ্জন সেন (বর্তমানে একুশে টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক)-এর লেখা ছিল।

আমি কাছ থেকে যে বেবী আপাকে দেখেছি সেই আপা একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও স্নেহময়ী আদর্শ। বেবী আপা, আমাদের যা শিখিয়েছেন তা আমরা এই প্রজন্মের সাংবাদিকরা কখনই ভুলব না। অন্যায়কে অন্যায়, অসত্যকে অসত্য বলার দৃঢ় সাহস আমরা বেবী আপার জীবন থেকে শিখেছি। আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।

লেখক : সহকারী সম্পাদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

এমবি


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি