বঙ্গমাতা বিজয়ের সাহসী প্রেরণা
প্রকাশিত : ১২:৩৮, ৮ আগস্ট ২০২০
সংগ্রামমুখর জীবনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশকেই গড়ে তোলেননি, বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলা ও বাঙালিকে নিয়ে গেছেন উচ্চতর আসনে। দেশের নেতা হয়ে উঠেছেন বিশ্বের নেতা। বাঙালি জাতির কাছে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন গর্বিত জাতির পিতা। এই সময়টাতে মেধা-প্রজ্ঞা আর সাহসে বিশ্বস্ত ও নির্ভরশীল সহযোদ্ধার ভূমিকা রেখেছেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। আমাদের বঙ্গমাতা।
১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম। ছোট নদী বাইগারতীর ঘেঁষে ছবির মতো সাজানো সুন্দর একটি গ্রাম টুঙ্গিপাড়া। এখান থেকেই বাংলার মমতাময়ী মা ফজিলাতুন্নেছা হয়ে উঠেছেন সবার বঙ্গমাতা। বঙ্গমাতা প্রতিদিন খবরের কাগজ পড়তেন। কোথায় কী ঘটছে, কে কী বলছে সব পড়তেন। তাঁর নিজেরও ছিল বিচক্ষণ ক্ষমতা। সব দিক ভেবে তিনি নিজেই বিশ্লেষণ করতেন।
ষাটের দশক ছিল বঙ্গমাতার আত্মত্যাগের বছর। বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে বন্দি। চলছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। সে সময় আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন বঙ্গমাতা। দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে সভা করেছেন, অর্থ জোগাড় করেছেন। মামলা তদারক করতে আইনজীবীদের কাছে ছুটেছেন। পাশাপাশি সন্তানদের লেখাপড়া এবং আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আদরে-শাসনে বঙ্গমাতা আগলে রেখেছেন নিজের সংসারকে। বন্দি থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের দিকনির্দেশনামূলক পরামর্শ নিতেন। তিনি অসীম সাহসী, ধৈর্যশীল, বুদ্ধিমতী। আগরতলা ষড়যন্ত্রের মিথ্যা মামলা দিয়ে যখন বঙ্গবন্ধুকে জেলে রাখা হয়, সে সময় বঙ্গমাতার বিচক্ষণ বুদ্ধি রাজনীতিতে এক নতুন ভাষা তৈরি করে। যে ভাষা আপস নয়—সংগ্রাম-সংগ্রাম-সংগ্রাম। আর সংগ্রামের সেই চেতনায় বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন লড়াই করেছেন বাংলার জন্য, বাঙালির জন্য। আর তাতে প্রেরণা দিয়েছেন আমাদের বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন—
আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছো, লেখো তোমার জীবনের কাহিনি। বললাম, লিখতে যে পারি না; আর এমন কী করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলো জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করছি।
...আমার স্ত্রী যার ডাকনাম রেণু। আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরো একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী]
বঙ্গবন্ধু লিখতে থাকলেন। প্রথম লাইনটি এরকম—‘আমার জন্ম হয় ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে...’।
তারপর খাতার ওপরে কালো কালিতে বাংলা অক্ষরের সমন্বয়ে যে শব্দমালা রচিত হলো বঙ্গবন্ধুর কলমে, সেই সব অক্ষর বাঙালি জাতির ইতিহাস হয়ে উঠল। হয়ে উঠল সময়ের প্রতিচ্ছবি। প্রকাশ পেল সংগ্রামমুখর জীবনের একেকটি দিনের কাব্যময় অনুভূতি। লেখার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর প্রতি বঙ্গমাতার এই অসামান্য উত্সাহ-অনুরোধ যদি না থাকত, তাহলে বাঙালি কি পেত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীর কথা’?
দেশ ও মানুষের মুক্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু একাত্তরে যুদ্ধের ডাক দিলেন। ১৯৭১-এর সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের মূল প্রেরণা দিয়েছেন বঙ্গমাতা। বলেছেন, ‘...তোমার মনে যে কথা আসবে সে কথা বলবে। বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে তোমার যে স্বপ্ন সেই কথাগুলোই তুমি স্পষ্ট করে বলে দিবে।’ বঙ্গবন্ধু তার স্ত্রীর প্রতি সম্মান রেখে সেই দিন সাহসী উচ্চারণে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
হাজার বছরের বাঙালির সংগ্রামমুখর ইতিহাসে বাঙালি জাতি বারবার যার নেতৃত্বে জেগে উঠেছে তিনি বঙ্গবন্ধু। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাকে যিনি সাহসী প্রেরণায় আলোর পথ দেখিয়েছেন তিনিই আমাদের বঙ্গমাতা। সংসারজীবন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ, সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ, আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগ। সবকিছুতেই ক্লান্তিহীন ছোটাছুটি। মহীয়সী নারী তিনি। মমতামাখা আদর্শের আলো তিনি। বাংলা ও বাঙালির প্রাণপ্রিয় বঙ্গমাতা তিনি।
আমাদের আছে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার ইতিহাস। স্বাধীনতার ইতিহাস। আমাদের আছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার ইতিহাস। এই ইতিহাসের পাতায় পাতায় যার স্বর্ণালি স্পর্শ রয়েছে, তিনি আমাদের বঙ্গমাতা। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শুধু স্ত্রী হিসেবেই নয়, তিনি ছিলেন আদর্শ বাঙালি পরিবারের মা হিসেবে অনন্যা। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি বাঙালি জাতিকে সাহস দিয়েছেন। দীক্ষা দিয়েছেন। সংসার পরিজনের বাইরেও তার দূরদর্শিতা ছিল রাজনীতিতেও। তিনি একজন আত্মত্যাগী দেশপ্রেমিক। বঙ্গমাতা, আমাদের স্বপ্নজয়ের সারথি। বিজয়ের সাহসী প্রেরণা।
লেখক :শিশুসাহিত্যিক ও সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি
এমএস/