‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি’
প্রকাশিত : ১১:৩৭, ১৩ আগস্ট ২০২০
আলজেরিয়ায় ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ট্রোর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সে সময় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ফিদেল কাস্ত্রোর একটি উক্তি আজও বিখ্যাত হয়ে আছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে সে সময় ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আই হ্যাভ নট সিন দ্য হিমালয়াস। বাট আই হ্যাভ সিন শেখ মুজিব। ইন পারসোনালিটি অ্যান্ড ইন কারেজ, দিস ম্যান ইস দ্য হিমালয়াস। আই হ্যাভ দাজ হ্যাড দি এক্সপেরিয়েন্স অব উইটনেসিং দ্য হিমালয়াস।’
বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়— ‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমতুল্য। আর এভাবেই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি।’
উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালে ন্যাম সম্মেলন উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর আলজেরিয়া সফর ছিল নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্মেলনেই, ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত পৃথিবী গড়তে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। আরও একটি বড় কারণ, এই সম্মেলন শেষে ঘোষণাপত্রে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলো তাদের সমর্থন দেয়।
১৯৭৩ সালের ৫ থেকে ৯ই সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত হয় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন-ন্যামের চতুর্থ শীর্ষ সম্মেলন। এতে প্রথমবারের মত যোগ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সদ্য স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের অবস্থান সৃদৃঢ় করতে ভূমিকা রাখে এই সফর।
সম্মেলনে সৌদি বাদশাহ ফয়সাল, যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো, কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রো, মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফিসহ অন্যান্য বিশ্বনেতারাও অংশ নেন।
সম্মেলনে মোট দু'দফা বক্তব্য রাখেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। ৮ই সেপ্টেম্বর স্বাগত ভাষণে সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদবিরোধী মজলুম জনগণের ন্যায্য সংগ্রামের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থনে জানাতে ‘জোটনিরপেক্ষ নীতি’ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন, 'আমি শুরুতেই জাতীয়তাবাদী মুক্তি আন্দোলনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের যেসব গণমানুষ শহীদ হয়েছে তাদের শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি। জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম আজও অব্যাহত ভিয়েতনাম, এঙ্গোলা, মোজাম্বিক, নামিবিয়া, গিনি বিসাওসহ ল্যাটিন আমেরিকা ও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। তাই একটি বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়তে আমাদের সবাইকে এক হয়ে শোষিতের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।'
সম্মেলনের ফাঁকে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী বিশ্বনেতার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধু। যাদের মধ্যে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, কিউবার বিপ্লবী প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো।
এখানে উল্লেখ্য যে- বিশ্ব-গণমাধ্যম এবং রাষ্ট্রনায়কদের চোখে বঙ্গবন্ধু ছিলেন ক্ষণজন্মা পুরুষ। তাদের কাছে বঙ্গবন্ধু এক অনন্য সাধারণ নেতা। যিনি ‘স্বাধীনতার প্রতীক’ বা ‘রাজনীতির ছন্দকার’। তারা মনে করেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন জনগণের নেতা এবং তাদের সেবায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন।
তাকে দেয়া ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে এই দেশপ্রেমিক নেতার প্রতি দেশের সাধারণ মানুষের গভীর ভালোবাসা প্রতিফলিত হয়েছে বলেও তারা মনে করেন।
বিদেশী ভক্ত, কট্টর সমালোচক এমনকি শত্রুরাও তাদের নিজ নিজ ভাষায় তাঁর উচ্চসিৎ প্রশংসা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় এবং নিহতের পর, এমন কি বিভিন্ন সময়ে রাজধানীর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শনকালে বিশ্ব নেতারাও শেখ মুজিবুর রহমান যে জনগণের নেতা এবং তাদের সেবায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন বঙ্গবন্ধু ভবনে রক্ষিত পরিদর্শক মন্তব্য বইয়ে তাই বলেছেন।
প্রসঙ্গত, কিউবা বিপ্লবের নেতা ও দেশটির সাবেক ফিদেল কাস্ত্রোর জন্মদিন আজ। ১৯২৬ সালের ১৩ অগাস্ট অবৈধ সন্তান হিসেবে কিউবায় জন্ম নেন ফিদেল আলেহান্দ্রো কাস্ত্রো রুৎজের। স্পেন থেকে দেশটিতে বাণিজ্য করতে আসা আনহেল মারিয়া বাউতিস্তা কাস্ত্রো নামে একজন ধনী কৃষক ছিলেন তার পিতা। সেই বাবার খামারের ভৃত্য ছিলেন মা লিনা রুৎজ গনজালেজ। যদিও পরবর্তীতে সেই ভৃত্যকে নিজের রক্ষিতা হিসেবে রেখে দেন কাস্ত্রোর পিতা।
বিশ্বব্যাপী যখন কমিউনিস্ট সরকারগুলোর একের পর এক পতন হতে শুরু করেছে; ঠিক তখনই কমিউনিস্টদের বৃহত্তম শত্রু বলে পরিচিত মার্কিন দোরগোড়াতেই সমাজতন্ত্রের ধ্বজা তুলে ধরে রেখেছিলেন কিউবায় রাষ্ট্রনায়ক ফিদেল কাস্ত্রো।
তখন সমর্থকেরা তাকে সমাজতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হিসেবেও বিবেচনা করতেন, যে কি না জনগণের কাছে কিউবাকে সম্মানের সঙ্গে ফেরত দিয়েছিলেন। যদিও বিরোধীদের প্রতি চরম দমন-পীড়ন চালানোর অভিযোগও রয়েছে জনপ্রিয় এই রাষ্ট্রনায়কের বিরুদ্ধে।
১৯২৬ সালে ফিদেল কাস্ত্রোর জন্মের পর তার মাকে নিজের স্ত্রীর মর্যাদা দেন তার পিতা। সান্টিয়াগোর ক্যাথলিক স্কুলে নিজের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ফিদেলের। পরে তিনি হাভানার কলেজ এল কলেজিও ডে বেলেন-এ যোগ দেন। যদিও খেলাধুলার দিকে অতি মাত্রায় মনযোগী থাকায় পড়াশোনায় খুব বেশি ভাল করতে পারেননি তিনি।
১৯৪০-এর দশকে হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ার সময়ে তিনি নিজেকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেন। পরে ১৯৪৮ সালে মি. কাস্ত্রো কিউবার একজন ধনী রাজনীতিবিদের কন্যা মার্টা ডিয়াজ বালার্টের সঙ্গে আবদ্ধ হন বিবাহ বন্ধনে। যার মাধ্যমে দেশটির এলিট শ্রেণীতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ ছিল তার, তবে এসবের বদলে তিনি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যান মার্ক্সবাদে।
তার বিশ্বাস ছিল, কিউবার লাগামহীন পুঁজিবাদের কারণে দেশটির যাবতীয় অর্থনৈতিক সমস্যার উদ্ভব এবং একমাত্র জন বিপ্লবের মাধ্যমেই এই সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকানোর পর আইন পেশায় যুক্ত হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি আর সেখানে সফলতার মুখ দেখতে পাননি। এই পরিস্থিতিতে নিজের রাজনীতি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তখন প্রায়ই সহিংস বিক্ষোভে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতেন তিনি।
পরে ১৯৫২ সা ফুলগেন্সিও বাতিস্তা একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট কার্লোস প্রিয়র নেতৃত্বাধীন সরকারকে উচ্ছেদ করেন তিনি। তখন বাতিস্তার সরকারের নীতি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতই, যা ছিল কাস্ত্রোর বিশ্বাসের সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
যে কারণে বাতিস্তা সরকারকে উৎখাতের জন্য তিনি একটি গোপন সংগঠন গড়ে তোলেন; পরবর্তীতে তিনি যার নাম দেন, ‘দ্য মুভমেন্ট’। যদিও তখন কিউবা পরিণত হয়েছিল উচ্ছৃঙ্খল ধনীদের এক স্বর্গরাজ্যে। তৎকালীন সমাজে যৌন ব্যবসা, জুয়া এবং মাদক চোরাচালানের মতো কাজ এক চরম আকার ধারণ করেছিল। যে কারণে এক বড় ধরনের সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে সান্টিয়াগোর কাছে মোনাকাডা সেনা ছাউনিতে একটি আক্রমণের পরিকল্পনা করেন কাস্ত্রো ও তার দল।
যদিও তাদের সেই আক্রমণটি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়; এতে বহু বিপ্লবী হয় প্রাণ হারান আর নয়তো ধরা পড়েন। আর সেই বন্দিদের মধ্যে কাস্ত্রোও ছিলেন। পরবর্তীতে একই বছর শুরু হয় তাদের বিচার কাজ। সেই বিচারের শুনানিগুলোকে কাস্ত্রো ব্যবহার করতেন দেশের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের ঘটনাবলী ফাঁস করে দেওয়ার অনন্য এক মঞ্চ হিসেবে।
এ সময় আদালতের সেই শুনানিগুলোতে যেকোনো বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার ছিল, আর এতেই তখন কাস্ত্রোর জনপ্রিয়তা গোটা বিশ্বে বেড়ে যায়। কাস্ত্রোকে অবশ্য তখন মোট ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। তবে সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে ১৯৫৫ সালের মে মাসে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে যান তিনি।
এ দিকে নিজের জেল জীবনের সময়েই তিনি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে বাধ্য হন। যার প্রেক্ষিতে মার্ক্সবাদে নিজেকে আরও ভালোভাবে জড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ পান তিনি।
অপর দিকে মুক্তি পাওয়ার পর পুনরায় নিজের গ্রেফতার এড়াতে তিনি অবৈধভাবে পালিয়ে আশ্রয় নেন মেক্সিকোতে। সেখানে তার পরিচয় হয় আরেক তরুণ বিপ্লবী আরনেস্তো চে গুয়েভারার সঙ্গে।
বিশ্লেষকদের মতে, এসবের প্রেক্ষিতে চে গুয়েভারার সহযোগিতায় এক সময় কিউবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় চলে আসেন অর্ধ শতাব্দীর এই রাষ্ট্রনায়ক। ফিদেল কাস্ত্রোর শাসনামলে দেশটিতে অবশ্য বহু অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।
তখন দেশটির প্রতিটি নাগরিকই বিনামূল্যে উন্নত চিকিৎসা সেবা লাভ করে। যে কারণে বিশ্বের বহু উন্নত দেশের তুলনায় কিউবায় শিশুমৃত্যুর হার কমতে শুরু করে। নিজের শাসনামলের শেষ দশ বছরে চলমান বিপ্লবকে অব্যাহত রাখতে মি. কাস্ত্রো মুক্ত বাণিজ্যের কিছু কিছু দিক গ্রহণ করতে বাধ্য হন।
২০০৬ সালের ৩১ জুলাই নিজের ৮০তম জন্মদিনের দিন কয়েক আগে ছোট ভাই রাউলের হাতে সাময়িক শাসনভার তুলে দিয়ে একটি জরুরি অস্ত্রোপচারে যান তিনি। এ সময় তার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকলে ২০০৮ সালের শুরুর দিকে তিনি রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দেন। পরে ২০১৬ সালের ২৬ নভেম্বর বার্ধক্যজনিত কারণে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হয় বিশ্ব বরেণ্য এই রাষ্ট্রপ্রধানকে।
এসএ/