ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

শিক্ষা সংস্কারক খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা

আনোয়ারুল কাইয়ূম কাজল 

প্রকাশিত : ১৬:০২, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০

খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা

খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা

জাতিসত্ত্বার প্রবক্তা-ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, শিক্ষাসংস্কারক, সমাজহিতৈষী, খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (১৮৭৩-১৯৬৫) ছিলেন মুক্তবুদ্ধি অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার ধারক। ইংরেজ শাসনাধীন ভারতে মুসলমানদের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থান দৃষ্টিভঙ্গির পশ্চাৎপদতা সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ে তিনি নতুন জীবনদৃষ্টি ও বিশ্ববীক্ষা নির্মাণে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। একাধারে তিনি সাহিত্যিক, ধর্মবেত্তা, দেশ বরেণ্য সমাজসেবক, মানবতাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছুফী সাধক। বাঙালি মুসলমানের অহংকার,বাংলার পূণর্জাগরণের সব্যসাচী কারিগর, ঘনঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত বাঙ্গালী জাতির আলোর দিশারী চেতনার বাতিঘর। তিনি ছিলেন তাঁর কালের আলোকিত মানুষ। এ জ্ঞান তাপস আপন উদ্যোগ কর্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মুসলমান জীবন ও মানসে যে শ্রেয় চেতনা নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন তাতে পরিপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেন। দীর্ঘ পরমায়ু তথা জীবনের প্রায় পুরোটা সময় অনগ্রসর মুসলমান জাতির উন্নতির জন্য ব্যয় করেছেন।

প্রাথমিক ও শিক্ষাজীবন
উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এ মনীষী ১৮৭৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নলতা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। শিক্ষা জীবন শুরু হয় নিজ গ্রামেই, মতিলাল ভঞ্জ চৌধুরী নামে একজন শিক্ষকের কাছে হাতেখড়ি। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা ছিলেন পিতামহের এক মাত্র পুত্রের জ্যেষ্ঠ সন্তান। ফলে তাঁর শিক্ষার জন্য পিতা ও পিতামহের আপ্রাণ চেষ্টা এবং আগ্রহ ছিল। বয়স পাঁচ বৎসর পূর্ণ না হতেই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। ১৮৮১ সালে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণির সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে একটি রূপার মুদ্রা পুরষ্কার পান। তিনি নলতার মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয় হতে ৩য়, ৪র্থ, ৫ম ও ৬ষ্ঠ ভাগ অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি টাকী গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে চতুর্থ (বর্তমান সপ্তম) শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৮৮৮ সালের শেষ ভাগে কলকাতায় লন্ডন মিশন সোসাইটি ইন্সটিটিউশনে সেকেন্ড ক্লাসে (বর্তমানে নবম শ্রেণী) ভর্তি হন এবং এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ১৮৯০ সালে কৃতিত্বের সাথে এন্ট্রান্স (বর্তমানে এস.এস.সি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ও বৃত্তি লাভ করেন। তিনি হুগলী কলেজ থেকে ১৮৯২ সালে এফ.এ (বর্তমানে এইচ.এস.সি) এবং ১৮৯৪ সালে কলিকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে সাফল্যের সাথে বি.এ. পাশ করেন। ১৮৯৫ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দর্শন শাস্ত্রে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন।
  
পরিবার
তাঁর পিতা মুনশী মোহাম্মদ মুফিজউদ্দীন এবং মাতা আমেনা খাতুন খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রপিতামহীর ইচ্ছানুসারে ফয়জুননেছা মহারানির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু সংসার জীবন শুরু করেন সরকারী চাকুরিতে প্রবেশের পর। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক কন্যা যিনি শৈশবে মারা যান ও আট পুত্র সন্তানের জনক ছিলেন। পুত্রগণ যথাক্রমে, ব্যারিস্টার মো. সামছুসুজ্জোহা, মো. বদরুদেজ্জাহা, মো. নুরুল হুদা, মো. নাজমুল উলা, মো. জয়নুল ওয়ারা, মো. কামরুল হুদা, মো. মাজহারুস্ ছাফা ও মো. গাওছার রেজা।

চাকরি জীবন
খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা ১৮৯৬ সালের ১ আগস্ট রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের ‘সুপার নিউমারারি’ টিচার হিসেবে যোগদান করেন। তিনি অক্টোবর ১৮৯৬ থেকে মার্চ ১৮৯৭ পর্যন্ত ফরিদপুর জেলার রাজবাড়ি মহকুমার স্কুল সাব ইন্সপেক্টর পদে কর্মরত ছিলেন। ১৮৯৭ সালের ১ এপ্রিল তিনি ফরিদপুর জেলার অতিরিক্ত ডেপুটি ইন্সপেক্টর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এক বছরের মধ্যেই তিনি পদোন্নতি পান বাকেরগঞ্জ উপজেলার ডেপুটি ইন্সপেক্টর পদে। একাধিক্রমে ৭ বছর তিনি বরিশালে অবস্থান করেন। ১৯০৪ সালে তিনি Subordinate Educational Service তিনি Provincial Educational Service এ প্রবেশ করেন। তিনিই প্রথম Inspecting Line থেকে Teaching Line এর জন্য মনোনীত হন। ১৯০৭ সালে তিনি চট্টগ্রামের ডিভিশনাল ইন্সপেক্টর পদে নিযুক্ত হন। ১ এপ্রিল, ১৯১২ সালে প্রেসিডেন্সী এডিশনাল ইন্সপেক্টর পদে নিযুক্ত হন। ১৯১৯ সালে তিনি আবার চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় ইন্সপেক্টর পদে বদলী হন। ১ জুলাই ১৯২৪ তারিখে তিনি Assistant Director of Public Instruction for Muhammadan পদে নিযুক্ত হন। চট্টগ্রামে চাকরিকালে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মুসলমানদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিসের অর্ন্তভুক্ত হন। অতঃপর তিনি শিক্ষাবিভাগের সহকারি ডিরেক্টর নিযুক্ত হন। তিনি কিছুদিন অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা বিভাগের সর্বোচ্চ পদ ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৯২৯ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন।

উপাধি-সাফল্য ও পুরস্কার
শিক্ষা সংস্কারক আহ্ছানউল্লা শিক্ষা ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদান এবং সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে  ১৯১১ সালে ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করে। ঐ বছর ২৮ জুন শিক্ষার প্রসারে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য লন্ডনে Royal society for the encouragement of arts, manufactures & commerce এর সদস্য পদ লাভ করেন। সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় তিনি এম.আর.এস.এ উপাধি লাভ করেন এবং ‘হুজ হু ইন ইন্ডয়াা’ গ্রন্থে তাঁর জীবনী প্রকাশিত হয়। তিনি চাকরিতে প্রবেশের মাত্র ১৫ বৎসরের মধ্যে এই সাফল্য অর্জন করেন। ১৯১৯ সালে ইন্ডিয়ান মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম (আইইএস) ভুক্ত হন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এক দশকের ও বেশি সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোটের (বর্তমান সিনেট) মেম্বার ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি লগ্নে ড. নাথান সাহেবের অধীনে টিচিং কমিটির মেম্বার ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট ও বহুমুখী অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলা একাডেমী তাঁকে ১৯৬০ সালে সম্মানসূচক ‘ফেলোশিপ’ প্রদান করেন। সমাজ সেবা এবং সমাজ সংস্কৃতিতে বিশেষ করে দ্বীন প্রচারের কাজে অবদানের জন্য ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ তাঁকে ১৪০৪ হিজরিতে মরণোত্তর পুরষ্কারে ভূষিত করে।

উল্লেখযোগ্য শিক্ষা সংস্কারসমূহ
১. তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক পরীক্ষার খাতায় পরীক্ষার্থীর নাম লেখার রীতি প্রচলিত ছিল। অনেকের মতে সাম্প্রদায়িকতা বিদ্যমান থাকায় হিন্দু ও মুসলিম পরীক্ষার্থীদের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব হত। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা এর প্রচেষ্টায় প্রথমে অনার্স ও এম.এ পরীক্ষার খাতায় নামের পরিবর্তে ক্রমিক নং (রোল নং) লেখার রীতি প্রবর্তিত হয়। পরবর্তীতে এই.এ এবং বি.এ পরীক্ষার ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীর নাম লেখার রীতি রহিত করা হয়।
২. সে সময় হাই স্কুল ও Intermediate মাদ্রাসা থেকে পাশ করে ছাত্ররা কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেত না। উক্ত মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষার মানোন্নয়ন করেন। ফলে মাদ্রাসা থেকে পাশ করা ছাত্রদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়।
৩. তৎকালীন সব স্কুল কলেজে তিনি মৌলভির পদ সৃষ্টি করেন এবং পন্ডিত ও মৌলভির বেতনের বৈষম্য রহিত করেন।
৪. তখন উর্দুকে Classical Language হিসাবে গণ্য করা হত না। ফলে পশ্চিম বঙ্গের উর্দুভাষী ছাত্রদের অসুবিধা হত। তাঁরই প্রচেষ্টায় উর্দু সংস্কৃতির স্থান অধিকার করে।
৫. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার খসড়া বিল সিনেটে উপস্থাপিত হলে দারুণ বিরোধ সৃষ্টি হয়। পরে তা বিবেচনার জন্য একটি স্পেশাল কমিটি গঠিত হয়। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা উক্ত কমিটির একজন সদস্য ছিলেন এবং তিনি এর আবশ্যকতা সমর্থন করেন।
৬. সরকার মুসলিম শিক্ষার ভার খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা এর হাতে ন্যাস্ত করেন। ফলে বহু মক্তব, মাদ্রাসা, মুসলিম হাইস্কুল এবং কলেজ তাঁরই তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও অমুসলিম স্কুলে মুসলিম শিক্ষকের নিযুক্তি এবং অন্যান্য সরকারি বিভাগের মুসলিম কর্মচারী নিয়োগও তাঁর হাতেই ন্যাস্ত ছিল। 
৭. স্বতন্ত্র মক্তব পাঠ্য নির্বাচন ও মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষার জন্য একমাত্র মুসলিম লেখকের প্রণীত পুস্তক প্রচলনের নিয়ম প্রবর্তন করেন এবং সরকারের অনুমতি নেন। প্রত্যেক মুসলিম বিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয় এবং প্রত্যেকের জন্য মুসলিম রচিত পাঠ্য পুস্তকের ব্যবহার প্রচলন হয়। এ সময় মখদুমী লাইব্রেরী, প্রভিন্সিয়াল লাইব্রেরি ও পরে ইসলামিয়া লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
৮. মুসলিম ছাত্রদের জন্য বৃত্তির ধারা নির্দিষ্ট হয়। বিদ্যালয়ের সকল শ্রেণীর বৃত্তি বণ্টনের পূর্বে তাঁর মতামত গ্রহণ করা হত।
৯. মুসলিম লেখকদের পাঠ্যপুস্তকে লেখার সুযোগ দেওয়া হত। পূর্বে যে সকল লেখক ও পুস্তক ঘৃণিত বলে বিবেচিত হয় সরকারি ব্যবস্থায় তা সমাদৃত হতে থাকে। অল্প সময়ের মধ্যে পুস্তক প্রকাশনা ও লেখদের অবস্থা আশাতীত উন্নতি লাভ করে।
১০. মুসলিম ছাত্রদের জন্য বেকার হোস্টেল, টেলার হোস্টেল, কারমাইকেল হোস্টেল ও মুসলেম ইন্সটিটিউট কলকাতার বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১১. মুসলিম সাহিত্যের বিপুল প্রসার লাভ করে এবং মুসলিম সাহিত্যিকগণ নতুন প্রেরণা লাভ করেন।
১২. বৈদেশিক শিক্ষার জন্য মুসলিম ছাত্র ছাত্রীদের সরকারি সাহায্য প্রদানের নিয়ম নির্ধারিত হয়।
১৩. টেক্সবুক কমিটিতে মুসলিম সদস্য নিযুক্ত হয়, মুনলিম পাঠ্যে ইসলামী শব্দ প্রয়োগ হতে থাকে।
১৩. মুসলিম মহিলাদের জন্য উচ্চ শিক্ষার বিশেষ স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।

এছাড়াও তিনি পরীক্ষক, শিক্ষা বিভাগীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি প্রভৃতি স্থানে আনুপাতিকহারে  মুসলমানদের আসন সংখ্যা নির্ধারণ, নিউ স্কীম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, হাইস্কুলে আরবীকে অধিকতরভাবে সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ করা, আরবী শিক্ষার মধ্যস্থতায় ইংরেজী শিক্ষার ব্যবস্থা করা, মুসলমান ছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশেষ বিশেষ স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করা পিছিয়ে  থাকা মুসলিম সমাজকে স্বমহিমায় উজ্জীবন ও প্রতিষ্ঠার জন্য এমন সব মহতি কর্মে তিনি ব্রতী ছিলেন। 

শিক্ষার উন্নয়নে কল্যাণমুখী ভূমিকা ’সংঘাত নয়, সমতা অর্জন
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা তাঁর সমগ্র জীবনকালে যেমন নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন, তেমনি কলকাতার বিখ্যাত বেকার হোস্টেলসহ কলকাতা ও কলকাতার বাইরে অনেক ছাত্র-হোস্টেল স্থাপনেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯২১ সালে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষভাবে সক্রিয়। ১৯১৯ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে উত্থাপিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পর্যালোচনার জন্য গঠিত স্পেশাল কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন । কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, তিনি অন্য ধর্মাবলম্বীদেরকে অবজ্ঞা করতেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নয়, তাদেরকে ঠেলে ফেলে দিয়ে তাদের আসন দখল করে নয়; বরং যথার্থ যোগ্যতা অর্জন করে তাদের সমকক্ষতা লাভ করা। এক কথায় সংঘাত নয়, সমতা অর্জন। তাই মুসলমানদের জন্য তাঁর প্রবর্তিত এসব ব্যবস্থাপনায় অন্য ধর্মাবলম্ভীরা কোন রকম ক্ষতিগ্রস্ত তো হননি; অধিকন্তু তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানে সকল ধর্মাবলম্বীরাই সমভাবে উপকৃত হয়েছেন। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ, বেকার হোস্টেল, কারমাইকেল হোস্টেল, টেলর হোস্টেল, রাজশাহীর ফুলার হোস্টেল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে তিনি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর সক্রিয় অবদান ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খসড়া বিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে উত্থাপিত হলে দারুণ বিরোধের সৃষ্টি হয় এবং পরে এটি বিবেচনার জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠিত হয়। তিনি এই কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবশ্যকতা সমর্থন করে এর অনুকলে বলিষ্ঠ কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেন।

শিক্ষা বিস্তার ও অনন্য অনুকরণীয় আদর্শ
খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা এর দীর্ঘ চাকরি জীবনের সম্পূর্ণটাই কেটেছে শিক্ষা বিভাগে। তাঁর এই দীর্ঘ সময়ের দিনগুলি ছিল বর্ণাঢ্য, পরিশ্রম ও সাফল্যের সমাহার। একজন সাধারণ শিক্ষক থেকে শিক্ষা বিভাগের সর্বোচ্চ পদে আসন গ্রহণ পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠার এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমা ছিল সত্যিই অনন্য। অফিসের প্রতিটি দায়িত্ব যথাযথভাবে সম্পাদনা করাকে তিনি ধর্ম পালনের অংশ হিসেবে মনে করতেন। তিনি যখন যেখানে যে দায়িত্বে থাকতেন সে অঞ্চলের শিক্ষা প্রসারের জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতেন। পাশাপাশি সমাজ সংস্কার তথা সমাজের সার্বিক উন্নয়নের প্রতিও তিনি ছিলেন সচেষ্ট।

তিনি রাজবাড়ি অতিরিক্ত ডেপুটি ইন্সপেক্টর থাকাকালীন পায়ে হেঁটে মফস্বলে স্কুল পরিদর্শন করতেন। কখনও কখনও তাকে রমজান মাসে ২০ মাইল পর্যন্ত হাঁটতে হয়েছে। তিনি রাজশাহীতে অবস্থানকালে মুসলমান ছাত্রদের শিক্ষার প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করেন। তিনি নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে সংগ্রামের মাধ্যমে মুসলমান ছাত্রদের জন্য দ্বিতল ছাত্রাবাস ‘ফুলার হোস্টেল’ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা’র চাকরি জীবনের একটা বড় অধ্যায় কেটেছে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় ইন্সপেক্টর হিসেবে। চট্টগ্রামের দায়িত্বভার গ্রহণ করার কিছু দিনের মধ্যেই বিভাগীয় কমিশনারের প্রস্তাব অনুসারে সদরের সরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাগুলোর আবশ্যকতা অনুযায়ী স্থান পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠিত হয়। তিনি ছিলেন সেই কমিটির সেক্রেটারি। এক বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করে তিনি কমিটির রিপোর্ট প্রস্তুত করেন। বিভাগীয় কমিশনার তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে বেতন বৃদ্ধির জন্য প্রস্তাব করেন। তাঁর পদের গুরুত্ব বিবেচনা করে মধ্যবর্তী দু'টি গ্রেড অতিক্রম করে বেতন ২৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকায় উন্নীত হয়। চট্টগ্রাম বিভাগের শিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি ছিলেন সদা সচেষ্ট ও আন্তরিক। কর্তৃপক্ষও ছিল তাঁর প্রতি আস্থাশীল। এ সময় চট্টগ্রাম বিভাগে যে অর্থ ব্যয় হত অন্য সব বিভাগে একত্রে সে অর্থ ব্যয় হত না। তাঁর প্রচেষ্টার ফলে চট্টগ্রাম বিভাগে শিক্ষার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়। খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা শিক্ষা বিভাগের সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদানের পর পরিদর্শন বিভাগে দক্ষ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তার অভাব পরিলক্ষিত হয়। এ প্রসঙ্গে এডুকেশন প্রসিডিং এ উল্লেখ করা হয়, ‘The work of the inspectorate Particularly of the Divisonal inspectorate is not satisfactory. The branches of the service requires radical improvement in both ogranisation and efficiency. During the last year the inspectorate lost the services of two exprience officers Mr. Stapleton and KhanBahadur Moulovi Ahsanullah’

গ্রন্থাবলি
১. হজরত মুহাম্মদ (স.)  ২. ইসলাম রবি হজরত মুহাম্মদ (স.) ৩. বিশ্ব শিক্ষক (ইছলাম নবী) ৪. পেয়ারা নবী (শিশু সাহিত্য) ৫. ছেলেদের মহানবী (শিশু সাহিত্য) ৬. ইসলাম ও আদর্শ মহাপুরুষ (ধর্ম) ৭. আল ওয়ারেস  ৮. AL-Waris ৯.কুতুবুল আকতাব হাজী ওয়ারেছ আলী শাহ  ১০. হাজী ওয়ারেস আলী শাহ (সংক্ষিপ্ত) ১১. হাজী ওয়ারেস আলী শাহ (অনুবাদ) ১২. আমার জীবন ধারা ১২. মোস্তফা কামাল ১৩. ইবনে ছউদ ১৪. দরবেশ জীবনী ১৫. হজরত মহর্ষি রুমি আলাইহের রহমত ১৬. হজরত ফাতেমা ১৭. আউলিয়া চরিত ১৮. মহানবীর কথা ১৯. মোছলেম জগতের ইতিহাস ২০. History of the Muslim World ২১. ইসলামের ইতিবৃত্ত ২২. আমাদের ইতিহাস (পাঠ্য পুস্তক) ২৩. ভারতের ইতিহাস (ইংল্যান্ডের ইতিহাস সম্বলিত) ২৪. রাজর্ষি আওরঙ্গজেব ও মুসলিম সভ্যতা (১ম খন্ড- জীবনী ও ২য় খন্ড- পাকিস্তান) ২৫. ইসলামের দান (মুছলিম মনীষীদের অবদান সম্পর্কিত) ২৬. মুসলিম জাহান (১ম, ২য় ও ৩য় খন্ড) ২৭. মুসলিম প্রাচীর ভূ-ভাগের মানচিত্র ২৮. সৌদি আরব ২৯. পরাবৃত্ত ৩০. মধ্য ও দূর প্রাচ্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ৩১. মধ্য ও দূর প্রাচ্যেও মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচয় ৩২. কোরআন ও হাদীসের আদেশাবলী ৩৩. কোরআনের সার ৩৪. হজরতের বচনাবলী ৩৫. কোরআনের শিক্ষা ৩৬. কোরআনের বাণী ও একত্ববাদ ৩৭. বাংলা হাদীস শরীফ (১ম ও ২য় খন্ড) ৩৮. হাদীছ গ্রন্থ ৩৯. সংক্ষিপ্ত হাদীছ ৪০. আল ইসলাম ৪১. নামাজ শিক্ষা (ধর্ম ও ফেকাহ) ৪২. নামাজের সুরা ৪৩. দোয়া ও দুরুদ ৪৪. ইসলামের মহতী শিক্ষা ৪৫.মুসলিমের নিত্য জ্ঞাতব্য ৪৬. মহাপুরুষদের অমীয় বাণী (ধর্মীয় উপদেশ) ৪৭. পাঁচসুরা ৪৮. ইছলামী তালীম ৪৯. বাংলা মৌলুদ শরীফ ৫০. তালীমী দীনিয়াত ৫১. আরবী দোয়া (বাংলা উচ্চারণ ও অনুবাদসহ) ৫২. ইসলাম ও যাকাত (যাকাত সমাজতন্ত্র) ৫৩. দীনিয়াত (১ম-৪র্থ ভাগ) ৫৪. পদার্থ শিক্ষা (১৯০৫) ৫৫. দীনিয়াাত শিক্ষা (১ম-৪র্থ ভাগ) ৫৬. প্রথম পড়া ৫৭. Child's Grammar  ৫৮. The Reader ৫৯. The Primer ৬০. First Book of Translation ৬১. Second Book of Translation ৬১. মক্তব সাহিত্য (১ম-৩য় খন্ড) ৬২. বাংলা সাহিত্য (১ম-৪র্থ খন্ড) ৬৩. প্রাইমারী সাহিত্য (১ম-৩য় খন্ড) ৬৪. ছুফি (তাছাওয়াফ) ৬৭. সৃষ্টি তত্ত্ব ৬৮. আমার শিক্ষা ও দীক্ষা (তাছাওয়াফ) ৬৯. বঙ্গভাষা ও মুসলমান সাহিত্য ৭০. টিচারস্র্ ম্যানুয়েল (১৯১৬) ৭১. নীতি শিক্ষা ও চরিত্র গঠন (ধর্ম ও নীতি) ৭২. শিক্ষা ক্ষেত্রে বঙ্গীয় মুসলামন ৭৩. আহ্ছানিয়া মিশনের মত ও পথ ৭৪. আহ্ছানিয়া মিশনের মূলনীতি ৭৫. ভক্তের পত্র ৭৬. প্রেমিকের পত্রাবলী ৭৭. তরীকত শিক্ষা ৭৮. অমীয় বাণী ৭৯. ইসলামের বাণী ও পরমহংসের উক্তি ৮০. বিভিন্ন ধর্মের উপদেশাবলী ৮১. মানবের পরম শত্রু ৮২. হেজাজ ভ্রমণ ও ৮২.গীত গুচ্ছ ইত্যাদি

ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের প্রতিষ্ঠা
শৈশব থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি অধ্যাত্মিক চিন্তা ও সাধনায় জীবন অতিবাহিত করেছেন। শুধু আল্লাহ্র সাধনাই নয়, তাঁর সৃষ্ট জীবকে ভালোবাসা, তাদের কল্যাণে আত্ম নিবেদিত হওয়াতে মানব জীবনের পূণর্তা এই ছিল তাঁর জীবন সাধনা। এই ভাবাদর্শের ভিত্তিতে ‘স্রষ্টার এবাদত ও সৃষ্টের সেবা’এই মূলমন্ত্র নিয়ে ১৯৩৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশন’। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন চট্টগ্রামে ১৯৫৯ হবিগঞ্জে ১৯৬১ আহ্ছানিয়া মিশনের কার্যক্রম বিস্তৃত হয়। বর্তমানে দেশে-বিদেশে আহ্ছানিয়া মিশনের তিন শতাধিক শখা রয়েছে। ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন যার সামাজিক ও আত্মিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড আজ বাংলাদেশের গন্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর পরিসরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিব্যাপ্ত।

সুফিবাদের প্রভাব
আধ্যাত্নচর্চা ও আধ্যাত্মিক জীবন যাপনের প্রতি বাল্যকাল থেকেই তাঁর প্রবল আকর্ষণ লক্ষণীয়। খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা ছিলেন একজন সুফি নিবেদিতপ্রাণ মুসলমান। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক এবং একটি উদার মুসলিম জীবনবাদী দর্শনের প্রবক্তা। ‘সৃষ্টির সেবা’ তথা সমগ্র মানব সমাজের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক সেবার মহান ব্রত নিয়ে খান বাহাদুর আহছানউল্লা (রহ) আজীবন আধাত্ম সাধনায় ইনসানই কামিল এর পর্যায়ে উপনীত হন। ভক্তের হৃদয় মন ও জীবনমানে ঐশ্বরীয় প্রেমের প্রোজ্জ্বল আনন্দ বিতরণে তাঁর জীবন সাধনাকে উৎসর্গ করেন। ধার্মিক পুরুষ খান বাহাদুর আহছানউল্লা সুফী দর্শনের অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন। তাঁর মতে শরীর মন ও আত্মা নিয়ে মানুষ গঠিত। শরীরের জন্য যেমন ব্যায়াম আবশ্যক, আত্মার জন্য তেমন আবশ্যক আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও সাধনার। শরীরের আয়ু সীমাবদ্ধ, কিন্তু আত্মার মৃত্যু নেই। শ্বাশ্বত কাল যে আত্মার প্রসার তার যথাযথ পরিচর্যা প্রয়োজনের তাগিদেই তরীকত আদায়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। ‘প্রেম ধর্ম ও মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মার উৎকর্ষতা সাধন জরুরী। সুফীতত্বের এ মর্মবাণী তিনি উপলব্ধি করেই আধ্যাত্মিক সাধনায় সিদ্ধিলাভে আজীবন চেষ্টায়রত ছিলেন। কমর্ জীবনকাল ছিল এই সাধনার প্রস্তুতিপর্ব। অবসর জীবনকালে সৃষ্টির সেবাকে স্রষ্টার ইবাদত বলে জ্ঞান করে মানুষেরই কল্যাণে তার রুহানী খেদমত নিবেদন করেন। সমাজের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সাধনাসিদ্ধ খাঁটি মানুষের প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি মানতেন বলেই খোদাওন্দ করিমের নৈকট্য লাভের সাধনায় নিয়ত নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। নিজে ধর্মীয় শিক্ষা ও দর্শন সম্পর্কে পুস্তক রচনা ও আহছানিয়া মিশন এর মাধ্যমে সমাজের সেবা ও আধ্যাত্মিক সাধনার মধ্যে সমন্বয় সাধন তার অনন্য অবদান হিসেবে পরিকীর্তিত হবে বহুকাল।

মখদুমী লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা
খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক এবং একটি উদার মুসলিম জীবনবাদী দর্শনের প্রবক্তা। ‘সষ্ট্রার এবাদত মুছলিম শিক্ষা ও সাহিত্য বিস্তারে তাঁর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ’ মখদুমী লাইব্রেরী ও আহ্ছানউল্লা বুক হাউজ লিমিটেড প্রতিষ্ঠা। মখদুমী লাইব্রেরীর উৎসাহ ও উদ্দীপনায় অনেক মুসলমান লেখক সৃজনশীল লেখার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। বহু সাহিত্যিক, লেখক, কবি এই লাইব্রেরীর সাথে সংশ্লিষ্ট হন। তৎকালীন আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ আনোয়ারা ও বিষাদ সিন্ধু এই লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও এই লাইব্রেরি থেকে কাজী নজরুল ইসলামের ‘জুলফিকার’, ‘বনগীতি’, ‘কাব্য আমপারা’, খ্যাতনামা কথা শিল্পী আবু জাফর শামসুদ্দিনের ‘পরিত্যক্ত স্বামী’, সৈয়দ আলী আহছানের ‘নজরুল ইসলাম’, শেখ হাবিবুর রহমানের ‘বাঁশরী’, ‘নিয়ামত’ প্রভৃতি বই প্রকাশিত হয়। এই লাইব্রেরি থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণীর বহু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। শুধু তাই নয় অনেক নতুন লেখকদের লেখা গ্রন্থও এখান থেকে প্রকাশিত হয়। মখদুমী লাইব্রেরীর কার্যক্রম তৎকালীন মুসলিম সমাজে সাহিত্য সৃষ্টি ও সাহিত্যের প্রসারের ক্ষেত্রে একটি দ্রুত ও মৌলিক পরিবর্তন আনতে সমর্থ হয়েছিল।

ইসলাম ধর্ম প্রচার-প্রসার ও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদান
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য ছিল। তাঁর লিখিত অন্যান্য গ্রন্থগুলো ছাড়াও বঙ্গভাষা ও মুসলমান সাহিত্য শীর্ষক গ্রন্থটি তার বিশেষ স্বাক্ষর বহন করে। এ গ্রন্থে আছে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রাজ্ঞতা ও সাহিত্য বিনির্মাণে মূল্যবান দিক নির্দেশনা। তাঁর লেখা সব গ্রন্থে আছে ভাষা শৈলী বির্নিমাণে পান্ডিত্যের প্রমাণ। সেকালের অন্যতম শক্তিধর লেখক হজরত খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) সমাজ ও দেশ বাংলা ভাষা সাহিত্য-সংস্কৃতি ইতিহাস শিক্ষা ধর্ম জীবন কথা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে ৭৯টি অতি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। এ সকল গ্রন্থ ‘খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা রচনাবলী’ নামে ১২ খন্ডে প্রকাশ করা হয়েছে।

সমাজসেবা ও মানব কল্যাণ
খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা ইসলাম ধর্ম প্রসার সমাজসেবা, মানবকল্যাণ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য যেমন প্রভূত অবদান রেখেছেন, তেমনি তৎকালীন সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গেও নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। তিনি একই সময়ে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি এবং বাংলা সাহিত্য সমিতির ১৯১৭-১৮ সালের নির্বাহী পরিষদের সহ-সভাপতি ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৬০ সালে তিনি বাংলা একাডেমীর ফেলো মনোনীত হন। তাঁর নামে ঢাকাসহ দেশের নানা স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বিশেষায়িত হাসপাতাল নানা প্রতিষ্ঠান।

সমাপনী কথা
পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ উপনিবেশিক শাসনে দিশেহারা বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশে নক্ষত্রের মতো উদয় হলেন খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা। সুদীর্ঘ তেত্রিশ বছরের চাকরি জীবনে তিনি একদিকে ছিলেন আদর্শবাদী ও কর্তব্যনিষ্ঠ, অন্যদিকে ছিলেন অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ মুসলমানদের শিক্ষা সম্প্রসারণে অত্যন্ত তৎপর। তিনি মুসলমানদের শিক্ষার উন্নয়নে নানাবিধ কল্যাণমুখী ও সুদূরপ্রসারী সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেন। এভাবে তিনি একটি বিশাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন এবং প্রায় পুরো এক শতাব্দীকালের সূর্যস্নাত এ মহাপুরষ পরিণত হন শিক্ষার প্রসার সংস্কার ও উন্নয়নের মহীরুহে। শতাব্দীর মহান নকিব তাঁর কালজয়ী সংগ্রামী কর্মময় স্বর্ণালী আলোময় অধ্যায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পরম শ্রদ্ধার সাথে ও স্মরণ করবে। ১৯৬৫ সালের ৯ ফেব্রয়ারি ৯২ বছর বয়সে এ মহান সাধক মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে পারি জমান মৃত্যু যবানিকার ওপারে।

এমএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি