ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪

শেখ হাসিনার শুভ জন্মদিনে

আমির হোসেন আমু

প্রকাশিত : ১১:৪৩, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০

বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। তেমনি বলা যায়, শেখ হাসিনার জন্ম না হলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের অভিযাত্রা সফল হতো না।

১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের মিছিলের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। শেখ হাসিনার বয়স তখন ছয় মাস। শৈশব কাটে টুঙ্গিপাড়ায়।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা এবং ধনাঢ্য ব্যক্তি জনাব ওয়াহিদুজ্জামানকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেন। ১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল শেরে বাংলা সরকার গঠন করেন। সর্বকনিষ্ঠ বঙ্গবন্ধু ১৪ মে কৃষি, বন ও সমবায়মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ঐ সময় বঙ্গবন্ধু পরিবার ঢাকায় নিয়ে আসেন। ১৯৫৬ সালে শেখ হাসিনা টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টবিরোধী আন্দোলন শুরু হয় এবং ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণে বহু ছাত্র নিহত হয়। তারপর থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এই আন্দোলনে শেখ হাসিনা একজন সক্রিয় নেতা ছিলেন এবং আজিমপুর গার্লস স্কুলের মেয়েদের নেতৃত্ব দিয়ে মিটিং-মিছিলে অংশগ্রহণ করতেন।

১৯৬৫ সালে শেখ হাসিনা আজিমপুর গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক মহিলা কলেজে (বর্তমানে বদরুন্নেসা কলেজ) ভর্তি হন। এ-সময় ছাত্রীদের মধ্যে ছাত্রলীগের অবস্থান ছিল অত্যন্ত দুর্বল। শেখ হাসিনাকে ঐ কলেজের সাংগঠনিক দায়িত্ব দেওয়া হয়।

৬-দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে ঐ সময় ঢাকা উচ্চ মাধ্যমিক মহিলা কলেজের ছাত্রী সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা হয়। ঐ নির্বাচনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে সহ-সভাপতি ক্যান্ডিডেট হিসেবে ঘোষণা করে। ঐ সময় ৬-দফা আন্দোলনকে নস্যাৎ করার যে দমননীতি আওয়ামী লীগের ওপর চলছিল, তার জন্য আওয়ামী লীগের অনেকেই এই সিদ্ধান্তে দ্বিধান্বিত ছিল। এই সময় ছাত্রদের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়ন শক্তিশালী ছিল। তারপরও শেখ হাসিনার মনোনয়ন ঘোষণার পর ছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে এবং শেখ হাসিনা বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কারাগারে গিয়ে তারা বঙ্গবন্ধুর দোয়া এনেছিলেন।

১৯৬৮ সালে বাংলাদেশের রাজনীতির এক উত্তাল সময়। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সেনানিবাসে (ক্যান্টনমেন্ট) নিয়ে যাওয়া হয়। এই মামলাকে (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা) নিয়ে সারাদেশে তখন আন্দোলনের অগ্নিগর্ভে পরিণত হয়েছে। এই আন্দোলনে তৎকালীন রোকেয়া হল শাখার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ হাসিনা ছিলেন আন্দোলনে একজন অকুতোভয় নেত্রী।

১৯৭৩ সালে শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ শেখ হাসিনা তার স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার সাথে তার ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে পশ্চিম জার্মানিতে যান।

১৯৭৫ সালের ভয়াল ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে, সেদিন জার্মানিতে থাকার কারণেই শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, দু’বোন প্রাণে বেঁচে যান।

বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে সামরিকতন্ত্র এই দেশের মানুষের বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মূল্যবোধ হত্যা করে সংবিধানের চার মূলনীতি ফেলে দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা পুনঃপ্রবর্তন করেছিল। এই অপশক্তি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করে, মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে নব্য পাকিস্তান সৃষ্টির প্রক্রিয়া করছিল। এ-সময় দেশে চলছিল দল ভাঙার রাজনীতি, যা থেকে আওয়ামী লীগও রেহাই পায়নি, রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরিত্র হনন, জিয়াউর রহমান ঘোষিত ওI shall make politics difficult for the politicians-এর মতো বিরাজনীতিকরণের হুঙ্কার। হুন্ডা-গুণ্ডা-স্টেনগানের মাধ্যমে ভোট ব্যবস্থা বিধ্বস্ত ও গণতন্ত্র হত্যা, জেল, জুলুম, গুম, হত্যা, নির্যাতন মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে উঠেছিল অতিষ্ঠ। তখনকার দেশের বিরাজমান এই পরিস্থিতিতে ১৯৮১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে সর্বসম্মতভাবে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। 

১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি পিতৃ-মাতৃহীন স্নেহের ভাই রাসেলসহ ভাইদের হারিয়ে স্বজনহারা বুকভরা বেদনা নিয়ে ঢাকায় অবতরণ করেন। ৬৫-৭০ মাইল বেগের ঝড়-ঝঞ্ঝা, প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাকে স্বাগত জানায়। মনে হচ্ছিল, মানুষ তাদের হারিয়ে যাওয়া বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পাওয়ার আশায় ছুটে এসেছে। বিমান বন্দর থেকে শেরে বাংলা নগরে ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যে বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় তার সম্বর্ধনা সভায় উপস্থিত হয়ে তিনি জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, খুনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকার জনগণের কোনো কল্যাণ করতে পারে না। তিনি জনগণের কাছে বিচার দাবি করেন, যেদিন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন হবে, শোষণমুক্ত সমাজ, শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সোনার বাংলা কায়েমের মধ্যেই সংগ্রামের ঘোষণা দিয়ে সকল ভেদাভেদ ভুলে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, আমি নেতা নই, সাধারণ মেয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠার একজন কর্মী। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্য আপনাদের নিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাব। এই সংগ্রামে জীবন দিতে আমি প্রস্তুত।

১৯৮১ সালের ৩০ মে একদল সশস্ত্র সেনা বিদ্রোহীদের হাতে প্রেসিডেন্ট জিয়া চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিহত হন। শেখ হাসিনা তাৎক্ষণিকভাবে দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক ধারা বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিবৃতি প্রদান করেন এবং যার ফলে তখন সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার অব্যাহত ধারায়ই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং বিচারপতি সাত্তার সাহেব রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক আইন জারি করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এরশাদের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদ মিছিলে গুলিবর্ষণ করলে জয়নাল, কাজল, দীপালি সাহা-সহ মারা যায় অনেকে।

শেখ হাসিনা খবর পাওয়ার সাথে সাথে ছুটে যান বিশ্ববিদ্যালয়ে, অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে দাঁড়িয়ে এই হত্যাকা-ের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন এবং অবিলম্বে সাংবিধানিক ধারা পুনঃপ্রবর্তনের আহ্বান জানান।

১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়, সহস্রাধিক ছাত্র গ্রেফতার করা হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্য শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ মিটিং করার সময় শেখ হাসিনাসহ আমাদের ৪২ জনকে গ্রেফতার করা হয় এবং কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। ১ মার্চ শেখ হাসিনা মুক্তিলাভ করেন এবং সবশেষে আমি ২৯ মার্চ মুক্তি পাই।

১৯৮৩ সালের ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শেখ হাসিনা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামের লক্ষে নেতাকর্মীদের শপথ পাঠ করান।

১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল দেশে ঘরোয়া রাজনীতি চালু হওয়ার সাথে সাথে ১৫-দলীয় জোট গঠন হয়। ১৯৮৩ সালের ১৪ নভেম্বর প্রকাশ্য রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সাথে সাথে জোটনেত্রী শেখ হাসিনা সর্বাগ্রে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ২৭ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করেন। হাজার হাজার মানুষ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঘেরাও কর্মসূচি সফল করে। ঐদিনই এই শান্তিপূর্ণ অবরোধ চলা অবস্থার শেষ পর্যায়ে শেখ হাসিনাকে লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করা হয়।

আমরা তাড়াতাড়ি ওখান থেকে তাকে নিয়ে ট্রাকে উঠে মিছিল শুরু করলে সেই ট্রাকের ওপরও গুলিবর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপ করা হয়। আমরা মতিঝিলে গিয়ে বিভিন্ন অফিসে গিয়ে কিছুক্ষণ থেকে তারপর চলে এলাম। এরশাদ রাতে সকল রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং শেখ হাসিনাকে তার মহাখালীর বাসায় গৃহবন্দি করা হয়। ১৪ ডিসেম্বর গৃহবন্দি থেকে মুক্তিলাভ করেন।

১৯৮৪ সালের ৭ জানুয়ারি পুনরায় ঘরোয়া রাজনীতি করার অনুমতি প্রদান করে এবং উপজেলা নির্বাচনের ঘোষণা দেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫-দলীয় জোট উপজেলা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে সর্বাগ্রে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানায়। এই আন্দোলনের ছাত্র মিছিলের ওপর ট্রাক উঠিয়ে দিয়ে সেলিম, দেলোয়ারকে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনা এ ঘটনাকে ফ্যাসিস্ট ও বর্বরোচিত বলে পরের দিন হরতালের আহ্বান জানান।

শেখ হাসিনা উপজেলার প্রার্থীদের প্রত্যাহারের আহ্বান জানালে ৭০০ জন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। এরশাদ সরকার বাধ্য হয়ে উপজেলা নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করেন।

১৯৮৬ সালের ২১ মার্চ ১৫-দল ও সাত-দলের লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। ১৫-দলীয় জোট ১৮০ ও সাত-দল ১২০টি আসন নির্ধারিত হয়। কিন্তু রাতে বিএনপি সাত জোট নির্বাচন থেকে পিছিয়ে যায়, এরশাদকে ছাড় দেয়। ৭ মে নির্বাচনে ১৫-দলের আট-দল নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাপক সহিংসতার মধ্যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যখন এগিয়ে যাচ্ছিল তখন নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা বন্ধ করা হয় এবং দীর্ঘ ১২ দিন পরে মিডিয়া ক্যুর মাধ্যমে সরকার ১৫৮টি সিট নেয়। ৪ সেপ্টেম্বর এরশাদ ১৫ অক্টোবর নির্বাচনের ঘোষণা দেন। শেখ হাসিনা প্রত্যাখ্যান করেন, সাত-দলীয় জোট ও পাঁচ-দলও প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৮৭ সালের ২৮ অক্টোবর ড. ওয়াজেদ মিয়ার মহাখালীর বাসভবনে শেখ হাসিনার সাথে খালেদা জিয়ার এক ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত হয়।

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর তিন জোটের ডাকে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি সচিবালয় ঘেরাও-সহ পালিত হয়। এইদিন যুবলীগ কর্মী নূর হোসেন ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক ও স্বৈরাচার নিপাত যাক’ বুকে-পিঠে লিখে শেখ হাসিনাকে সালাম করে ফিরে দাঁড়াবার সাথে সাথে শেখ হাসিনাকে লক্ষ করে গুলিতে নূর হোসেন শহিদ হয়। এরপর ঐদিনই কয়েক ঘণ্টা পর প্রেসক্লাবের সামনে ক্রেন দিয়ে শেখ হাসিনার গাড়ি টেনে তুলে ফেলা হয়। শেখ হাসিনা উত্তাল জনসমুদ্রে বলেন, এখন আমাদের এক-দফা দাবি এরশাদের পদত্যাগ।

১১ নভেম্বর শেখ হাসিনাকে আবার গৃহবন্দি করা হয়। ৬ ডিসেম্বর এরশাদ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন। ১৯৮৭ সালের ১০ ডিসেম্বর অন্তরীণ অবস্থা থেকে শেখ হাসিনা মুক্তিলাভ করেন। ১৯৮৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা আন্দোলনের কর্মসূচি অনুযায়ী চট্টগ্রামে জোটের মহাসমাবেশে যান। উত্তাল জনস্রোত নিয়ে শেখ হাসিনা সভাস্থলে যাওয়ার পথে মুসলিম হাই স্কুলের মোড়ে পুলিশ বাধা দেয়, একই সময় শেখ হাসিনাকে লক্ষ করে গুলি করা হয়, তাকে বাঁচাতে গিয়ে জীবন দেন যুবলীগ কর্মী আবুল হাসেম। শুরু হয় পুলিশি তা-ব, আইনজীবীরা শেখ হাসিনাকে আদালত ভবনে নিয়ে যান, ঐদিনও চট্টগ্রামে প্রাণ হারান ২৪ জন। ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট শেখ হাসিনা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে থাকা অবস্থায় ফ্রিডম পার্টি তাকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলা চালায়।

১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর তিন জোটের সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এই দিনই শেখ হাসিনার উদ্যোগে গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য। আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত দেন। ১৯৯০ সালের ৫ ডিসেম্বর তিন জোট বিচারপতি সাহাবুদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন। ৬ ডিসেম্বর নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন। ৭ মার্চ উপলক্ষে আয়োজিত জনসভায় শেখ হাসিনা সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তনের আহ্বান জানান। ১৯৯১ সালের ১৪ এপ্রিল শেখ হাসিনার নির্দেশে সংসদ উপনেতা আব্দুস সামাদ আজাদ একাদশ সংশোধনী বিল আনেন (সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন করার)। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট সংসদে সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হয়।

১৯৯৪ সালের ২১ মার্চ মাগুরা উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ৩০ মার্চ মাগুরা ও মিরপুর উপনির্বাচনের নজিরবিহীন কারচুপির প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ সংসদ বর্জন করে এবং এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

৫ এপ্রিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে শেখ হাসিনা ট্রেন মার্চ শুরু করেন এবং ঈশ্বরদীতে তার ট্রেনে বিএনপির সন্ত্রাসীরা গুলি চালায়। ১৯৯৪ সালের ৮ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া বলেন, একমাত্র পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নাই। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রস্তাব অবাস্তব, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধীদলীয় সকল সংসদ সদস্যরা শেখ হাসিনার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। ২৮ ডিসেম্বর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সব কয়টি বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা একযোগে পদত্যাগ করেন।

১৯৯৬ সালের ১ মার্চ শেখ হাসিনার ডাকে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ৯ মার্চ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের উদ্যোগে প্রেসক্লাবের সামনে গড়ে ওঠে জনতার মঞ্চ। অবশেষে খালেদা জিয়া আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ২৫ মার্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস হয় এবং ৩০ মার্চ সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। এই জয়কে শেখ হাসিনা আগামী ব্যালটের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে আহ্বান জানান।

১৯৯৬ সালের ১২ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে এবং ২৩ জুন বঙ্গবন্ধুর হত্যার দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।

১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর শেখ হাসিনার একক উদ্যোগে ভারতের সাথে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত ফারাক্কা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯৭ সালের ২৩ জুন বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধন করেন।

১৯৯৭ সালের ২২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, এই অঞ্চলে দীর্ঘ ২৫ বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাত নিরসনের জন্য শেখ হাসিনা UNESCO শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।

২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি UNESCO কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে মহান ২১ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃত হয়। ২০০০ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশ হিসেবে স্বীকৃত হয়। ২০০১ সালের ১৩ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম একটি সরকার মেয়াদ উত্তীর্ণ করে শান্তিপূর্ণভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বিএনপির সন্ত্রাসীরা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা চালায়। আল্লাহর রহমতে উনি বেঁচে গেলেও আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতা কুক্ষিগত করার লক্ষে ১ কোটি ২০ লাখ ভুয়া ভোটার, পছন্দমতো দলীয় লোককে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান করার জন্য বিচারপতির চাকরির বয়স বাড়ানো ও পছন্দমতো নির্বাচন কমিশন সাজানো এবং তারপর সব অপশন বাদ দিয়ে দলীয় রাষ্ট্রপতির অধীনে নির্বাচন ঘোষণার বিরুদ্ধে বিএনপি-জামাত জোট ছাড়া সমস্ত দল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তীব্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ফলে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীনের ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন সরকার।

২০০৭ সালের ১৬ জুলাই শেখ হাসিনা গ্রেফতার হন এবং আন্দোলনের মুখে ২০০৮ সালের ১৬ জুন তাকে চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেন। ২০০৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন। ২০০৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ক্ষমতায়।

বঙ্গবন্ধু-কন্যা দেশে এসে আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সকল ষড়যন্ত্র বানচাল করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আজকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা, চার মূলনীতি সংবিধানে পুনঃঅন্তর্ভুক্ত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের এবং যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার অনুষ্ঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে পাপমুক্ত করেছেন।

আজ শেখ হাসিনার নির্ভীক, তেজস্বী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের এবং সফল রাষ্ট্রনায়কোচিত সিদ্ধান্ত ও পরিচালনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার বাস্তব প্রতিফলন দেখিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাতা ও উন্নয়নের কাণ্ডারি, উন্নত, সমৃদ্ধ, মর্যাদাশীল বাংলাদেশ নির্মাণের রূপকার। শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে এবং দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহু লেন সড়ক টানেল নির্মাণ প্রকল্প, ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্প, দোহাজারি-রামু-ঘুমধুম রেল প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা বিদ্যুৎ নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা বন্দর, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দরসহ মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে।

তার সফল রাষ্ট্র পরিচালনার মধ্য দিয়ে তিনি খাদ্য নিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান, শিক্ষানীতি প্রণয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র, শান্তি, জঙ্গি দমন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে তিনি বহু মর্যাদাসম্পন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতির মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে গৌরবান্বিত করেছেন।

বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বে মর্যাদার নতুন মাত্রা দিয়েছেন। শেখ হাসিনা আজ বিশ্বে একজন নন্দিত সফল রাষ্ট্রনায়ক। তিনি সৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিশ্বে তৃতীয় স্থানের অধিকারী হয়েছেন।

বর্তমানে অত্যন্ত সফলতার সাথে করোনা পরিস্থিতি এবং পাশাপাশি উপর্যুপরি বন্যার মোকাবিলা করে যাচ্ছেন।

আজ তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়া যাবে- তার ঘোষিত ২০৪১ সালের আগেই উন্নত দেশে রূপান্তরিত হবে। তার দীর্ঘায়ু কামনা করি।

লেখক : সংসদ সদস্য ও উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

এমবি//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি