জ্ঞান, সাধনা ও সমর্পণের অনন্য দৃষ্টান্ত ইমাম গাজ্জালী
প্রকাশিত : ১৫:৫০, ২২ নভেম্বর ২০২০

গত সহস্রাব্দের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ তিনি। ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ বা ‘ইসলামের সত্যায়নকারী’ অভিধায় তিনি ভূষিত। সর্বসাধারণ্যে ইমাম গাজ্জালী নামে খ্যাত হলেও তার প্রকৃত নাম আবু হামিদ মোহাম্মদ। তার জন্ম ইরানের তুস নগরে ১০৫৮ সালের ১ নভেম্বর।
শৈশবে তার বাবা মারা যান। মা ও নানার কাছে বেড়ে ওঠেন তিনি। সে-সময়ে জ্ঞান অন্বেষণে শিক্ষার্থীরা দূরদূরান্তে বেরিয়ে পড়ত। ইমাম গাজ্জালীও ১৫ বছর বয়সে তুস থেকে যান পাঁচশ কি.মি. দূরে গুরগানে। সেখানে ইমাম আবু নসর ইসমাইলির তত্ত্বাবধানে পাঁচ বছর শিক্ষালাভ করেন। এরপর তিনি পাড়ি জমালেন তখনকার সময়ে জ্ঞানচর্চার একটি খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান জামেয়া নিজামিয়া নিশাপুরে। সেখানে ইমামুল হারামাইন আল জুয়াইনির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তৎকালে মক্কা-মদিনার প্রাজ্ঞ ইমামদের নেতাকেই অভিহিত করা হতো ‘ইমামুল হারামাইন’ নামে। অল্পদিনেই তিনি ইমামুল হারামাইনের প্রিয় শিষ্যে পরিণত হন। গাজ্জালীও তাকে খুব ভালবাসতেন। যখন ইমামুল হারামাইন মারা গেলেন, দুঃখে তিনি নিশাপুর ছেড়েই চলে গেলেন।
জ্ঞান, খ্যাতি আর বিত্তের চূড়ায় রিক্ত হৃদয়
তখন সেলজুক সুলতান মালিক শাহের শাসনকাল। সুলতানের প্রধানমন্ত্রী নিজামুল মুলকের দরবার সমসাময়িক জ্ঞানীদের দ্বারা অলংকৃত থাকত। ইমাম গাজ্জালী সেই জ্ঞানীদের সাথে যোগ দিলেন এবং অল্প দিনের মধ্যেই হয়ে উঠলেন তাদের নেতা। ছয় বছর তিনি নিজামুল মুলকের সাথে থাকলেন।
ইমাম গাজ্জালীর অগাধ পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে নিজামুল মুলক তাকে জামেয়া নিজামিয়া বাগদাদে অধ্যাপনার সুযোগ করে দিলেন। তৎকালীন বিশ্বে জামেয়া নিজামিয়া বাগদাদ ছিল একালের অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ এবং হার্ভার্ডের সমতুল্য। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপাচার্য পদে অধিষ্ঠিত হলেন। এসময় তার বাহন এবং পোশাকের মূল্য ছিল পাঁচশ দিনার (স্বর্ণমুদ্রা)।
ইমাম গাজ্জালী ছিলেন তীক্ষ্ন মেধার অধিকারী ও ওস্তাদ তার্কিক। দূরদূরান্ত থেকে আলেমরা তার কাছে আসতেন ফতোয়া বা পরামর্শের জন্যে। দেমাগী জ্ঞানে প্রখর ও যুক্তি প্রয়োগে এত সিদ্ধহস্ত ছিলেন যে, কেউ তার সাথে বিতর্কে পেরে উঠত না। প্রচলিত দর্শনকে খণ্ডন করে গাজ্জালী বই লিখলেন তাহফুত আলফালাসিফা অর্থাৎ দর্শনের বিনাশ।
ইমাম গাজ্জালী খ্যাতির তুঙ্গে পৌঁছলেন। কিন্তু এত খ্যাতি আর বৈভবের মাঝেও তিনি অনুভব করতে শুরু করলেন আত্মিক শূন্যতা। উপরন্তু শিক্ষক হারানোর বেদনাও আচ্ছন্ন করল তাকে। ক্রমশ তিনি সুফিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। এসময় তিনি শেখ আল ফারাবির শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন।
সত্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন এক কাপড়ে ॥
মগ্ন হলেন ধ্যান ও মৌনতায়
একদিকে দুনিয়ার শানশওকত, অন্যদিকে আধ্যাত্মিক তৃষ্ণা। এ দুটোর সংঘাতে অসুস্থ হয়ে পড়লেন ইমাম গাজ্জালী। একসময় তার জন্যে চিকিৎসক পাঠালেন স্বয়ং খলিফা। ছয় মাস পর চিকিৎসক জানালেন, এ রোগ ওষুধে সারবে না, এটা অন্তরের রোগ। ৩৮ বছর বয়সে তার অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রবল রূপ ধারণ করে। তিনি উপলব্ধি করলেন, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে ঈমানের সর্বোচ্চ স্তর ইয়াকিনে পৌঁছানো যায় না। ইয়াকিনের স্তরে পৌঁছতে প্রয়োজন আত্মশুদ্ধি এবং স্রষ্টায় পরিপূর্ণ সমর্পণ। তিনি স্পষ্টতই বুঝলেন, দলিল-প্রমাণ-যুক্তি দিয়ে অন্যকে মোহিত করা যায় বটে, কিন্তু অন্তরাত্মা পরিতৃপ্ত হয় না। পার্থিব শানশওকত পদমর্যাদা খ্যাতি জনপ্রিয়তা- ইয়াকিনের স্তরে পৌঁছানোর পথে নিশ্চিত প্রতিবন্ধক।
তিনি মৌন হতে শুরু করলেন এবং প্রায়ই ধ্যানে হারিয়ে যেতেন। সমস্ত জৌলুস ছেড়ে একদিন রাতের অন্ধকারে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়লেন। কাফেলার সাথে হেঁটে গেলেন বাগদাদ থেকে দামেস্ক পর্যন্ত। দামেস্কের এক মসজিদে ঝাড়ুদারের কাজ নিলেন। ঝাড়ু দেন আর মসজিদের বাইরে বিশ্রাম নেন।
মসজিদে আলেমদের কাছে সাধারণ মানুষ আসত দৈনন্দিন নানা সমস্যার সমাধান পেতে। একবার এক লোক বড় আলেমদের কাছেও তার প্রয়োজনীয় একটি ফতোয়া পাচ্ছিল না। ইমাম গাজ্জালী তার অস্থিরতা খেয়াল করে তার কাছে গিয়ে সমস্যা জানতে চাইলেন। প্রথমে লোকটি বলতে চাইল না। কিন্তু পরে তাকে খুলে বলল। ইমাম গাজ্জালী তাকে সহজ সমাধান বলে দিলেন। লোকটি বিস্মিত হলো এবং আলেমদের কাছে
গিয়ে জানতে চাইল সমাধানটা শরিয়তসম্মত কিনা।
আলেমরাও শুনে বিস্মিত হলেন এবং জানতে চাইলেন এ সমাধান কে দিয়েছে! এভাবে ইমাম গাজ্জালীর পরিচয় সবাই জেনে গেল। সব আলেমরা তার ছাত্র হওয়ার জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ইমাম গাজ্জালী হেসে বললেন, এখানে আমার রিজিক শেষ। রাতের অন্ধকারে আবার এক কাপড়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। পৌঁছলেন জেরুজালেম। এরপর সেখান থেকে গেলেন মক্কা-মদিনায়। ইব্রাহিম (আ)-এর মাজারে গিয়ে তিনি তিনটি প্রতিজ্ঞা করলেন-
এক. কোনো শাসকের দরবারে কখনো যাবেন না।
দুই. কোনো শাসকের দেয়া উপহার নেবেন না।
তিন. কখনো ধর্মীয় বিতর্কে অংশ নেবেন না।
একসময় তিনি ইয়াকিনের স্তরে পৌঁছলেন। ১০ বছর পর ৪৮ বছর বয়সে তিনি বাগদাদে ফিরলেন। তখন তার বাহন, পোশাকসহ সবকিছুর মূল্য ছিল দেড় দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা)। বাকি জীবন ঐ দেড় দিরহামের পোশাক পরেই তিনি কাটিয়েছেন।
কালজয়ী গ্রন্থ এহইয়াউ উলুমুদ্দীন
এই ১০ বছর সাধনার পর তিনি রচনা করলেন কালজয়ী গ্রন্থ এহইয়াউ উলুমুদ্দীন। শরিয়া ও ফিকাহ-র সাথে সাধনার সমন্বয় করলেন। যে ধ্যান, তাকওয়া ও সমর্পণ ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, তাকে শরিয়ার সাথে যুক্ত করলেন তিনি। আত্মশুদ্ধির এ সমন্বিত প্রক্রিয়ার নামই এহইয়াউ উলুমুদ্দীন। এটিসহ তার রচিত মোট গ্রন্থসংখ্যা ৭০টিরও বেশি।
এহইয়াউ উলুমুদ্দীন প্রকাশকালে তিনি নিশাপুরে ছিলেন। নিশাপুরের আলেমরা বইটি নিষিদ্ধ করে পুড়িয়ে ফেললেন এবং তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলেন। তখন তিনি নিশাপুর ছেড়ে জন্মভূমি তুসে ফিরে গেলেন। শুধু যারা তার কাছে আসত, তাদেরকেই শিক্ষা দিতেন। আত্মশুদ্ধির জন্যে এহইয়াউ উলুমুদ্দীনের চেয়ে উন্নত কোনো বই এখনো প্রকাশিত হয় নি। রুমি, সাদী, ফরিদ উদ্দীন আত্তার, হাফিজ সিরাজিসহ পরবর্তীকালের জ্ঞানী সাধকদের সবাই এই বই দ্বারাই সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত ছিলেন।
আসলে একজন মানুষ কতটা তৃপ্তি নিয়ে মারা যান, তা-ই তার জীবনের সার্থকতা নির্দেশ করে। ১৯ ডিসেম্বর ১১১১ সালে ৫৩ বছর বয়সে তিনি মারা যান। ঐতিহাসিক জাওযির বিবরণ অনুযায়ী- দিনটি ছিল সোমবার। ফজরের সময় তিনি বিছানা ত্যাগ করলেন। ওজু করে নামাজ পড়লেন। এক শিষ্যকে বললেন কাফনের কাপড় আনতে।
কাপড় আনা হলে তিনি তা চোখে স্পর্শ করে ও চুমু দিয়ে বিছিয়ে দিলেন। ‘হে আল্লাহ! আমি এই সময়ের জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। তোমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।’ -বলে ওখানেই শুয়ে পড়লেন এবং শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
এসএ/