ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

বধির হয়েও বিশ্বসেরা সব সংগীতের স্রষ্টা বেটোফেন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২২:০০, ১৬ ডিসেম্বর ২০২০

পশ্চিমের ধ্রুপদী সংগীতের জগতে উজ্জ্বলতম এক জ্যোতিষ্কের নাম লুডভিগ ফান বেটোফেন৷ জন্ম তাঁর জার্মানির বন শহরে৷ মৃত্যু অস্ট্রিয়ার সংগীত নগরী ভিয়েনায়৷

তার যখন জন্ম তখন মানুষের কাছে সংগীতের খুব একটা গুরুত্ব ছিলনা৷ একদিকে হয়তো চলছে তাস খেলা কিংবা গল্পগুজবে মেতে আছে লোকে নেপথ্যে ভেসে আসছে হালকা কোনো গান৷ দৃশ্যটা ছিল অনেকটা এই রকম৷ কিন্তু বেটোফেন চেয়েছিলেন সংগীতকে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে৷ সৃষ্টি করেছেন তিনি সোনাটা, সিম্ফনি, বাজিয়েছেন পিয়ানো অর্কেস্ট্রা৷ তাঁর রচিত কালজয়ী সব সিম্ফনি ও অন্যান্য সংগীত রচনা যুগে যুগে সংগীতকার ও শিল্পীদের প্রণোদিত করেছে, দিয়েছে দিকনির্দেশনা৷ তাঁর নামেই বন শহরে গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক বেটোফেন সংগীত উত্‌সব৷ বিবিসি বাংলা অবলম্বনে লুডভিগ ফান বেটোফেনকে নিয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হলো।

স্মরণীয় এক রাত

ভিয়েনার ইম্পেরিয়াল এন্ড রয়্যাল কোর্ট থিয়েটারে জড়ো হয়েছেন দেশের রাজপরিবারের সদস্যরা, অভিজাতবর্গ এবং নগরীর সাংস্কৃতিক জগতের নামকরা লোকজন। এক অসাধারণ অনুষ্ঠান সেদিন সেখানে হতে চলেছে। লুডভিগ ফন বেটোফেনের 'নাইনথ সিম্ফোনি' প্রথমবারের মতো সেখানে বাজানো হবে।

যারা এই অনুষ্ঠানে এসেছেন, তারা আজ দারুণ এক সুরমূর্চ্ছনা শুনবেন বলে প্রত্যাশা করছেন।

এই সুরস্রষ্টা এবং সঙ্গীত পরিচালক এর আগে দীর্ঘদিন যাবৎ কোন সিম্ফনি বা ঐকতান সৃষ্টি করেননি। শুধু তাই নয়, তাকে ১২ বছর ধরে কোন মঞ্চেই দেখা যায়নি।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি মঞ্চে এলেন। ভিয়েনায় সেদিন যে অর্কেস্ট্রা সাজানো হয়েছে, তখনো পর্যন্ত বিশ্বে সেটাই সবচেয়ে বড়। এরকম কনসার্টও এর আগে বিশ্ব কখনো দেখেনি।

আর এই প্রথম কোন অর্কেস্ট্রার আয়োজনে পরিবর্তন এনে সেখানে যন্ত্রের পাশাপাশি মানুষের কণ্ঠও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বেটোফেন দর্শকদের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালেন এবং বিপুল আবেগে তার সঙ্গীত দলকে পরিচালনা করতে শুরু করলেন। তিনি তার শরীর ঝাঁকাচ্ছিলেন এবং তার হাত নেড়ে সঙ্গীত পরিচালনা করছিলেন।

নিজের সঙ্গীত পরিচালনায় তিনি এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন যে, যখন সুর থেমে গেল, তখনো তিনি তার শরীর আন্দোলিত করে যাচ্ছিলেন।

তাকে থামাতে এক পর্যায়ে তার অর্কেষ্ট্রা দলেরই একজন বাদক এগিয়ে এলেন তার দিকে। মনে করা হয় তিনি ছিলেন কনট্রান্টো ক্যারোলাইন আঙ্গার। বেটোফেনকে তিনি ঘুরিয়ে দর্শকদের দিকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেন, যাতে করে তিনি দেখতে পান কিভাবে দর্শকরা তুমুল করতালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন।

এই করতালির কিছুই বেটোফেন শুনতে পাচ্ছিলেন না, কারণ অসাধারণ এই ঘটনাটি যেদিন ঘটেছিল, ততদিনে বেটোফেন একেবারেই বধির।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীতের অধ্যাপক এবং বেটোফেনকে নিয়ে লেখা এক জীবনীগ্রন্থের লেখক প্রফেসর লরা টানব্রিজ বিবিসিকে বলেন, এই ঘটনার তিন ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়।

"নাইনথ সিম্ফোনি যেদিন প্রথমবারের মতো বাজানো হয়, সেদিন তিনি মঞ্চে ছিলেন। তবে তার পাশেই একজন সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন, যিনি সবকিছু সুশৃংখলভাবে পরিচালনা করছিলেন। কারণ ততদিনে এটি জানা হয়ে গেছে যে বেটোফেন আর কনডাক্টর বা সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে মোটেই নির্ভরযোগ্য নন," বলছিলেন প্রফেসর টানব্রিজ।

সেই সন্ধ্যাটি হয়তো ছিল খুবই বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। কারণ যিনি সঙ্গীত পরিচালক এবং সঙ্গীতস্রষ্টা তিনি বধির। আর যে সঙ্গীতটি তিনি রচনা করেছেন, সেটিও অস্বাভাবিক রকমের দীর্ঘ এবং জটিল। আর সেসময় সচরাচর যেটি ঘটতো- এরকম একটা বড় অনুষ্ঠানের আগে এর সঙ্গে যুক্ত সঙ্গীতবাদকরা রিহার্সেল করার খুব কম সুযোগই পেতেন।

"কিন্তু কোন প্রস্তুতি ছাড়াই যে সবকিছু শেষপর্যন্ত ঠিকঠাক মতো শেষে হয়েছিল, সেটা আসলেই অবাক করার মতো", বলছিলেন প্রফেসর টানব্রিজ।

'সঙ্গীত আর বিনোদন নয়, শিল্প'

বেটোফেনের জীবনের গৌরব আর বেদনাকে যেন একসঙ্গে ধরে রেখেছিল সেই মূহুর্তটি।

তার জন্ম ২৫০ বছর আগে জার্মানির বন শহরে। যদিও তার সঠিক জন্ম তারিখ নিয়ে একটু সংশয় আছে। কেউ বলেন এটি ১৬ ডিসেম্বর। তবে এমন রেকর্ড আছে, যাতে দেখা যায়, ১৭৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর খ্রীস্টধর্ম অনুযায়ী তার জন্মের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছিল।

তিনি ছিলেন এমন একজন সঙ্গীতজ্ঞ, যিনি বিপুল কল্পনাশক্তি, আবেগ এবং ক্ষমতার অধিকারী। একইসঙ্গে তার ব্যক্তিত্ব ছিল খুবই জটিল এবং বিপরীতমুখী দ্বন্দ্বের এক সংমিশ্রন।

তিনি যখন বেড়ে উঠছেন তখন ইউরোপে চলছে নেপোলিয়ন যুগের যুদ্ধ। পুরো ইউরোপ জুড়ে তখন মারাত্মক রাজনৈতিক অস্থিরতা।

যদিও তিনি জার্মান বংশোদ্ভূত, তাকে ভিয়েনার সবচাইতে মহৎ সঙ্গীতস্রষ্টাদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ভিয়েনায় এরকম স্বীকৃতি পাওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। কারণ ভিয়েনার আছে গর্ব করার মতো সব সঙ্গীতজ্ঞ- ওলফগ্যাং আমাডিউস মোৎজার্ট, ইউসেফ হাইডেন, ফ্রান্টস শুবার্ট অথবা আন্তনিও ভিভালডির মতো সর্বকালের বিশ্বখ্যাত সব কম্পোজার।

প্রফেসর টানব্রিজের মতে, "অনেকভাবে দেখতে গেলে বেটোফেন আসলে শব্দ এবং এবং এর মাত্রার বিবেচনায় সঙ্গীতকে বৈপ্লবিক ভাবে পাল্টে দিয়েছিলেন।"

"তার উচ্চাকাঙ্খা এবং সঙ্গীত যে মানুষের ভাবনা এবং অনুভূতিকে প্রকাশ করতে পারে, এটি তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, সঙ্গীত কেবল বিশুদ্ধ বিনোদন নয়, এটি তার চাইতে গভীরতর কিছু।"

"আসলে সঙ্গীতকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করতে মৌলিক অবদান রাখেন বেটোফেন" বলছেন প্রফেসর টানব্রিজ।

তবে একইসঙ্গে অবশ্য তখন বেটোফেনের অনেক দুর্নাম ছিল। তিনি ছিলেন বদমেজাজী, স্বার্থপর। তিনি ছিলেন আত্মপ্রেমে ভোগা মানুষ। তিনি ছিলেন অসামাজিক এবং তার ব্যবহার ছিল জঘন্য। প্রেমে ব্যর্থতার কারণে তিনি ছিলেন হতাশাগ্রস্ত, তার জীবন যাপন ছিল উচ্ছৃঙ্খল। তিনি ছিলেন তীব্রভাবে মদপানে আসক্ত।

"তবে এগুলো আসলে বেটোফেনকে ঘিরে যে রোমান্টিক মিথ, তারও অংশ‍," বলছেন প্রফেসর টানব্রিজ।

"কারণ আমরা একজন শিল্পীকে এমনভাবেই দেখতে পছন্দ করি, যিনি তার নানা রকম চারিত্রিক দুর্বলতা এবং শারীরিক অসুস্থতার কারণে দগ্ধ হতে থাকেন।"

বেটোফেনকে এমন এক মহান সঙ্গীতজ্ঞ বলে গণ্য করা হয় যিনি যার সবকিছু ছেড়ে কেবল সঙ্গীতের সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। যিনি এমন সব সঙ্গীত সৃষ্টি করেছেন যা আমাদের কল্পনার সীমার বাইরে। বেটোফেন যেন আমাদের চেনা পৃথিবীর বাইরের কোন জগত থেকে আসা মানুষ।

অসুস্থতায় জর্জরিত জীবন

কাজেই বেটোফেনের দুর্নাম ছিল খুব জটিল এক চরিত্রের মানুষ বলে। তবে সত্যি কথা বলতে কী, তিনি অনেক ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছিলেন। আর তাকে চিকিৎসার নামে অনেক যন্ত্রণা আর অপচিকিৎসার শিকার হতে হয়েছিল, তার ফলে তার স্বাস্থ্য আরও ভেঙ্গে পড়েছিল।

বেটোফেনের ব্যাপারে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ফরেনসিক তদন্ত সাম্প্রতিককালে হয়েছে। এগুলোর উদ্দেশ্য ছিল তিনি আসলে কি ধরনের অসুস্থতায় ভুগেছেন, পরবর্তীকালে তার বধির হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এগুলোর কী প্রভাব ছিল এবং কীভাবে তার ব্যক্তিত্ব এবং সঙ্গীত সৃষ্টির ক্ষেত্রে এগুলোর প্রভাব পড়েছে তা জানা।

বেটোফেনের যেসব স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছিল, আজকের দিনে চিকি‍ৎসকরা সেগুলো কিভাবে নির্ণয় করতেন, তার একটি তালিকা তৈরি করেছেন ব্রিটিশ নিউরো-সার্জন হেনরি মার্শ।

বিবিসির জন্য বেটোফেনকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেন তিনি। তার মতে, বেটোফেন মলাশয়ের প্রদাহে ভুগছিলেন। তার ছিল ইরিটেবল বোওল সিনড্রোম (আইবিএস)। সেই সঙ্গে মারাত্মক ডায়ারিয়া। তিনি একই সঙ্গে হুইপলস রোগ, বিষন্নতা, সীসার বিষক্রিয়া এবং হাইপোকন্ড্রিয়াতেও ভুগছিলেন।

বেটোফেন মারা যান ১৮২৭ সালের সালের ২৭ শে মার্চ।

মৃত্যুর পরদিন সেসময়ের নামকরা চিকিৎসক ইয়োহানেস ওয়াগনার তার মরদেহের একটি ময়নাতদন্ত করেন। তিনি দেখেন বেটোফেনের তলপেট ছিল বেশ ফাঁপা। তার লিভার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। এটি সংকুচিত হয়ে স্বাভাবিক আকারের চারভাগের একভাগ হয়ে গেছে। এ থেকে বোঝা যায় ব্যাপক মদ্যপানের কারণে তিনি লিভার সিরোসিসে ভুগছিলেন।

মদ্যপানে আসক্তির এই সমস্যা ছিল তাদের পুরো পরিবারে। তার দাদীমা এই একই সমস্যায় ভুগেছেন। তাঁর বাবাও ছিলেন মদে আসক্ত।

বেটোফেন নিয়মিত ঘরে এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে ওয়াইন খেতেন। এটি সেসময় একটা স্বাভাবিক ব্যাপারই ছিল। কারণ তখন পানি ছিল পানের অযোগ্য, বলছেন প্রফেসর টানব্রিজ।

ইউনিভার্সিটি অফ স্যান হোসের বেটোফেন স্টাডিজের একজন গবেষক উইলিয়াম মেরেডিথ গবেষণা করে ওয়াইন পান করার সঙ্গে সীসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার মধ্যে একটা সম্পর্ক দেখতে পেয়েছেন।

তিনি বেটোফেনের চুলের একটি নমুনা নিয়ে সেটির রাসায়নিক বিশ্লেষণ করেছেন এবং দেখেছেন সেখানে সীসা আছে।

সেই যুগে যারা ওয়াইন প্রস্তুত করতো, তারা যেসব ব্যারেল বা পিপের ভেতরে আঙুরের রস জারিত করতো, সেসব পিপের ভেতরের গাত্রে সীসার প্রলেপ দিয়ে রাখতো। এর উদ্দেশ্য ছিল মদে যাতে কিছুটা মিষ্টি এবং সিরাপের মতো স্বাদ হয়। কিন্তু এই মদ যারা পান করছিল, এর ফলে যে তাদের ক্ষতি হচ্ছিল, সেটা তারা জানতো না।

আর এরকম সীসার দূষণ মানুষের স্নায়ুবিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না যে বেটোফেন এতে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

যেভাবে তিনি তার শ্রবণ শক্তি হারিয়ে ছিলেন

বেটোফেনের শ্রবণশক্তি যে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তার প্রমান পাওয়া গেছে। ডক্টর ওয়াগনার ময়নাতদন্তের সময় তা দেখেছেন এবং পরবর্তীকালে তা জানিয়েছেনও।

মিস্টার মেরেডিথ বিবিসিকে জানিয়েছেন, তার এই বধিরতার সমস্যা হয়তো তার পাচকতন্ত্রের অসুস্থতার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। কারণ এই দুটি সমস্যা একসঙ্গে দেখা দিয়েছিল।

"এর পাশাপাশি বেটোফেন সব সময় জ্বর এবং মাথাব্যাথার অভিযোগ করতেন। তার বাকি জীবন ধরেই তিনি এই দুটি সমস্যায় ভুগেছেন‍।"

ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের স্কুল অব মেডিসিনের ডঃ ফিলিপ ম্যাকুইয়াক আরেকটি তত্ত্ব হাজির করেছেন। তিনি বলছেন, এটা হয়তো কনজেনিটাল সিফিলিসের একটা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া।

এই রোগটি এসেছিল আমেরিকা মহাদেশ থেকে। এটি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে যায় এবং মানুষের ব্যাপক মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ডঃ ম্যাকুইয়াক বলেন, বেটোফেনের বেলায় এই রোগটি তার গ্যাস্ট্রো-ইনটেস্টাইনাল সমস্যা এবং বধিরতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

তবে নিউরো-সার্জন হেনরি মার্শের বিশ্বাস, এর কোন প্রমাণ এখনো নেই। এগুলো কেবলই জল্পনা মাত্র।

বধির হওয়ার যন্ত্রনা

তবে যেটা নিশ্চিত ভাবে জানা যায় তা হলো, বেটোফেনের শ্রবণশক্তির সমস্যা শুরু হয় ১৭৯৭ এবং ১৭৯৮ সালের মাঝে।

ডাক্তারের পরামর্শ মতো ১৮০২ সালে বেটোফেন ভিয়েনা ছেড়ে কাছের একটি শান্ত নির্জন শহর হেইলিজেনস্ট্যডটে চলে যান। সেখানে তিনি তার অসুস্থতার সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিলেন।

এখানে বসে তিনি তার ভাইদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লেখেন। এই চিঠিটি হেইলিজেনস্ট্যডটের প্রমাণ বলে পরিচিত। চিঠিতে তিনি তার আত্মহত্যার চিন্তা ভাবনা এবং অন্য লোককে কেন এড়িয়ে যেতে চান, সেসব বিষয়ে লেখেন।

"প্রায় ছয় বছর আগে আমি এক সর্বনাশা রোগে আক্রান্ত হই। যার চিকিৎসা করতে গিয়ে অযোগ্য ডাক্তাররা আমার অবস্থা আরও সংকটাপন্ন করে তোলে।"

চিঠিতে তিনি তার যন্ত্রণার কথা খুলে প্রকাশ করেন। তিনি আরও লিখেছিলেন, কিভাবে বধিরতা তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। তার অস্থির এলোমেলো আচরণের পেছনে যে এটাই কারণ, সেকথাও লেখেন তিনি।

তবে শ্রবণশক্তি হারানোর বেদনা নিয়েও তিনি বেঁচে থাকতে এবং তার সঙ্গীতের সাধনা চালিয়ে যেতে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

ভাইদের কাছে লেখা এই চিঠিটি তার পাঠানো হয়নি কোনদিন। তবে মৃত্যুর পর তার কাগজপত্রের মধ্যে এটি খুঁজে পাওয়া যায়।

শ্রবণশক্তি হারানো শুরু করার পর প্রথমদিকে বেটোফেন কেবল কিছু কিছু ফ্রিকোয়েন্সির শব্দই শুধু শুনতে পেতেন না। কিন্তু ক্রমে তিনি তার পুরো শ্রবণশক্তিই হারিয়ে ফেলেন।

"এমন অনেক রিপোর্ট আছে যেখানে বলা হচ্ছে তিনি বধির এবং জোরে চিৎকার করে কথা বলতেন‍," বলছেন প্রফেসর টানব্রিজ। "কিন্তু আসলে তার প্রকৃত অবস্থা কি ছিল সেটি সঠিকভাবে জানা যায় না।"

তবে যেটা জানা যায়, তা হলো, ১৮১৮ সাল নাগাদ তিনি আর কারও কথা মোটেই বুঝতে পারছিলেন না। সুতরাং তিনি লোকজনকে অনুরোধ করতেন হাতে লিখে তাকে প্রশ্ন করতে এবং কথা বলতে।

তার শেষ জীবনের দিকের কিছু কিছু ঘটনার উল্লেখ আছে, যেখানে বলা হচ্ছে, তখনো তিনি হয়তো কিছু কিছু শব্দ শুনতে পেতেন। তবে খুবই অস্পষ্টভাবে। যেমন একবার তিনি খুব তীব্র শব্দের এক চিৎকার শুনে অবাক হয়েছিলেন।

কম্পনের মাধ্যমে সঙ্গীতের সাধনা

এতদিন তার হতাশা ছিল বিয়ে করতে না পারা নিয়ে। তার সঙ্গে এখন যুক্ত হলো শ্রবণশক্তি হারানোর বেদনা।

কিন্তু এর মধ্যেও বেটোফেন ক্রমাগতভাবে নতুন নতুন সঙ্গীত সৃষ্টি করে যাচ্ছিলেন। এই সময়টাতেই তিনি তার সবচাইতে ভাবপ্রবণ, মর্মস্পর্শী এবং পরীক্ষামূলক কিছু সঙ্গীত সৃষ্টি করেন।

প্রফেসর টানব্রিজ বলেন, "ভাইদের কাছে লেখা চিঠিটিতে তিনি লিখেছিলেন, তার কাছে তখনো জীবনের মূল্য আছে। তিনি সঙ্গীত সৃষ্টি করে যাবেন। তার সঙ্গীতই তাকে রক্ষা করবে।"

বিটোফেনের সবচাইতে বেশি দক্ষতা ছিল পিয়ানোতে। তিনি এই পিয়ানো বাজিয়েই তার সঙ্গীত সৃষ্টি করে চললেন। তিনি নানা ধরনের যন্ত্র যুক্ত করে তার পিয়ানোর শব্দ অনেকগুন বাড়াতে পেরেছিলেন।

কিন্তু সবকিছুর পরেও বেটোফেনের কাছে তার মস্তিস্কই ছিল সবচাইতে শক্তিশালী যন্ত্র।

প্রফেসর টানব্রিজ বলেন, "আপনাকে মনে রাখতে হবে যে যারা সঙ্গীত তৈরি করেন, তাদেরকে নিজের কল্পনাশক্তির উপর অনেকখানি নির্ভর করতে হয়। তারা কিন্তু তাদের মাথার ভেতরে শব্দ শুনতে পান। বেটোফেন কিন্তু একেবারে ছোটবেলা থেকেই তার মাথার ভেতরে এরকম সঙ্গীত তৈরি করে যাচ্ছিলেন।"

"তিনি হয়তো বাইরের বিশ্বের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই যে তিনি তার মনের ভেতর সঙ্গীত শোনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন, অথবা তার সঙ্গীত সৃষ্টির যে মেধা সেটা কমে গিয়েছিল।"

ক্ষমতা এবং উচ্ছ্বাস

যে সঙ্গীত তিনি তৈরি করছেন, সেই সঙ্গীত যে তিনি নিজের কানে শুনতে পাচ্ছেন না, এটি ছিল তার জন্য চরম হতাশার। কিন্তু এর মধ্যেই বেটোফেন নতুন চ্যালেঞ্জ নিলেন। তিনি তার সঙ্গীতে এমন ধরণের শক্তি আর ভাবনা সঞ্চারিত করলেন, যেটা এর আগে কেউ কখনো দেখেনি।

বেটোফেনের সঙ্গীত বিশ্লেষণ করে সাম্প্রতিককালে কয়েকজন তো এমন কথা বলছেন যে, বধির হওয়ার পর তার সঙ্গীত সৃষ্টির প্রতিভা যেন আরো অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছিল।

একজন ব্রিটিশ সঙ্গীতস্রষ্টা রিচার্ড আইরেস বলেন, "আপনি যদি ঠিকমত শুনতে না পারেন, তখন আপনি আপনার সঙ্গীত প্রকাশের জন্য অন্য মিউজিশিয়ানদের শক্তির উপর নির্ভর করেন।"

রিচার্ড আইরেস নিজেও বধির। নিজের শ্রবণশক্তি হারানোর পর তিনি বেটোফেনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

তিনি বলছেন এই মহান সঙ্গীতস্রষ্টা শ্রবণশক্তি হারানোর পর আরও উচ্ছ্বাসপূর্ণ সঙ্গীত তৈরিতে ঝুঁকে পড়েন।

তিনি বলেন, বেটোফেন চাইতেন যারা তার সঙ্গীত বাজাবেন, তারা যেন আরও বেশি শরীর দোলায় এবং তাদের বাজনায় যেন আরও বেশি আবেগ এবং শক্তি ঢেলে দেয়।

বেটোফেনের সঙ্গীতের মধ্যে যেন একধরণের স্পন্দন তৈরি হলো, তিনি তার সঙ্গীতকে নিয়ে গেলেন এমন সব অচেনা পথে, যা মর্মস্পর্শী এবং হৃদয়বিদারক কিছু মূহুর্ত তৈরি করলো। বিশেষ করে তার একেবারে শেষের দিকে তৈরি করা সঙ্গীতে এই বৈশিষ্ট্য বেশ স্পষ্ট।

যেমন তার 'হেইলিগার ডাংকগেসাং' (স্ট্রিং কোয়ার্ট্রেট নম্বর ১৫, ওপাস ১৩২) খুবই মন ভালো করে দেয়ার মতো একটি সুর। এটি তিনি সৃষ্টি করেন তার অসুস্থতা থেকে সেরে উঠতে সাহায্য করার জন্য সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা হিসেবে।

মানবতা এবং আশাবাদ

"এরকম প্রমাণ অনেক আছে যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, 'তিনি বেশ অসামাজিক এবং অসুস্থ‌' ছিলেন," বলছেন প্রফেসর টানব্রিজ।

"কিন্তু বেটোফেন আসলে ছিলেন অনেক বিরাট এক মানুষ।"

"তার চরিত্রের আরেকটি দিকও কিন্তু ছিল, তিনি ছিলেন বন্ধুবৎসল এবং আমুদে। এমন অনেক উদহারণ আছে যেগুলো তার এই মানবিক দিকগুলোর ওপর আলোকপাত করে," বলছেন প্রফেসর টানব্রিজ।

বেটোফেন তার 'অড টু জয়' সঙ্গীতটি তৈরি করেন জীবনের খুবই সংকটময় এক মূহুর্তে। এ থেকে বোঝা যায়, সংকটের মধ্যেও তিনি ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা ছেড়ে দেননি। প্রফেসর টানব্রিজ বলেন, তার পরবর্তী কাজগুলোতেও এই অনুভূতির প্রকাশ দেখা গেছে।

'খুব অল্প বয়স থেকেই বেটোভেন ফ্রেডরিক শিলারের 'অড টু জয়' কবিতাটিকে সঙ্গীতে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। এবং শেষ পর্যন্ত তিনি তার নাইনথ সিম্ফনিতে' এটি অন্তর্ভুক্ত করার উপায় খুঁজে পেলেন।

"আমার মনে হয় এই কবিতার কথায় যেসব ভাবনার কথা আছে, ভ্রাতৃত্ববোধ আর সুখের কথা আছে, বেটোফেন আসলে রাজনৈতিকভাবে এবং সমাজের জন্য সেরকমই কিছু ভাবতেন‍।"

"জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি এই আশা ধরে রেখেছিলেন এবং এই বিষয়টিকে আমরা আসলে উপেক্ষা করতে পারি না।"


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি