একজন বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন
প্রকাশিত : ১৭:০৫, ২৫ জানুয়ারি ২০২১
আসলে একজন নারী, বোরখা পরা নারী। তিনি যে কত বিপ্লবী হতে পারেন, কত বড় বিপ্লব করতে পারেন, নিজেই তার প্রমাণ! তিনি হচ্ছেন বেগম রোকেয়া। ৯ ডিসেম্বর জন্ম এবং ৯ ডিসেম্বর ১৯৩২-এ তিনি মারা যান। খুব যে দীর্ঘ জীবন তা নয়। মাত্র ৫২ বছরের জীবন।
বেগম রোকেয়া যখন স্বপ্ন দেখেছিলেন তখন তিনি সাহস করেননি ভবিষ্যৎ বলার জন্যে। তিনি এটাকে ‘স্বপ্ন’বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে কেউ এটার বিরোধিতা না করে। স্বপ্ন কতজনে কতকিছু দেখতে পারে। কিন্তু এই স্বপ্নের মধ্য দিয়ে তিনি আসলে সত্য, চমৎকার সত্যকে বলে গেছেন। যখন তিনি সুলতানার স্বপ্ন দেখেন, তখন আমাদের দেশে নারীর কোনো অবস্থানই ছিল না। এখন দেশের শীর্ষ পদে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, শিক্ষামন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী- কী হন নাই নারীরা!
হযরত ওমরের সময় তিনি মদিনার মার্কেট নিয়ন্ত্রণের জন্যে মার্কেট ইন্সপেক্টর নিয়োগ করেছিলেন এক নারীকে। তিনি ‘হান্টার’ নিয়ে মার্কেটে যেতেন। দেখা যাবে এরপরে মার্কেট নিয়ন্ত্রণের জন্যে এখনকার বাজার ব্যবস্থায়ও এমন মহিলাদের প্রয়োজন হচ্ছে। কারণ তারা জানেন যে, ঘরে কী কী জিনিস লাগে এবং কী কী জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে! তো কীভাবে! হাউ? একজন নারী, একজন মহিলা। স্বামী এবং বড় ভাই ছিলেন তার শিক্ষক ও অনুপ্রেরণার উৎস।
তখনকার রংপুর, দিনাজপুর উত্তরবঙ্গ হচ্ছে সবচেয়ে একটা অবহেলিত অঞ্চল। সেখানে পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেছেন অভিজাত পরিবারে। জমিদার পরিবার। তার বাবা উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। কিন্তু মেয়েদের শিক্ষা দিতে হবে এ ধারণা তার কখনো ছিল না।
অর্থাৎ আরবি ফারসি পর্যন্তই শিক্ষা ছিল বেগম রোকেয়ার যে, আরবি ফারসি জানলে কোরআন পড়তে পারবে, ওজু রোজা নামাজ এগুলো করতে পারবে। ঘরের বাইরে যাওয়ার কোনো অনুমতি ছিল না। এটাই ছিল তখনকার সমাজের চিত্র। রাতের বেলা যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ত, তখন তার ভাই মোমবাতির জ্বালিয়ে তাকে বাংলা ও ইংরেজি পড়তে শেখান।
যখন কিশোরী হলেন স্বাভাবিকভাবে জমিদার বাড়ির মেয়ে, বিয়ের প্রস্তাবের তো অভাব ছিল না। অনেক জায়গা থেকে প্রস্তাব আসতে লাগল। কিন্তু বড় ভাই অত্যন্ত প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি পছন্দ করলেন বিহারের ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনকে। তিনি উর্দুভাষী অবাঙালি ছিলেন এবং বিপত্নীক ছিলেন। বেগম রোকেয়ার চেয়ে ২০ বছর বয়সে বড় ছিলেন। কেন পছন্দ করলেন? কারণ সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে তার বড় ভাই ইব্রাহিম আলাপ-আলোচনা করে বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি তার লেখাপড়া বন্ধ করবেন না। লেখাপড়া করার সুযোগ দেবেন। হলোও তা-ই। বেগম রোকেয়া যাতে লেখাপড়া করতে পারেন, এজন্যে তাকে একটা আলাদা ঘরই দিয়ে দেয়া হলো। স্বামীর কাছেই তিনি ইংরেজি পড়া শুরু করলেন।
স্বামীর মৃত্যুর পাঁচ বছর পর ভাগলপুরে প্রথম তিনি সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল করেন। একটা বেঞ্চ এবং পাঁচজন ছাত্রী। তখন বাংলার মুসলমান নারীর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। বোরখা পরে বেগম রোকেয়া বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্রী সংগ্রহের চেষ্টা করতে লাগলেন, কিন্তু লাভ হলো না কিছুই। ভাগলপুরে থাকতে পারলেন না তিনি। কারণ পারিবারিক চাপ। অন্যান্য মানুষদের চাপ, যারা নারীশিক্ষাটাকে কোনোভাবেই পছন্দ করলেন না। কিন্তু বেগম রোকেয়া জানতেন যে, শিক্ষা ছাড়া মুক্তি নাই। প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলায় একমাত্র পুঁজি ছিল মনোবল এবং ইচ্ছাশক্তি।
তিনি কলকাতায় পাড়ি জমালেন। তখন তিনি ৩০ বছর বয়সী বিধবা। একজন বিধবা নারীর জীবন এখনই কতরকম সমস্যাসঙ্কুল। আর সেই সময়ে এই সমস্যা আরো অনেক বেশি ছিল।
কলকাতায় তার কোনো আত্মীয়স্বজন ছিল না। তিনি নতুন করে গার্লস স্কুলের কার্যক্রম শুরু করলেন কলকাতায়। আগের চেয়ে একটু ভালো অবস্থা হলো। দুটি বেঞ্চ, আটজন ছাত্রী। স্কুলের একমাত্র শিক্ষিকা বেগম রোকেয়া নিজে। তার না ছিল কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি, না ছিল বাড়ির বাইরে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা। একমাত্র পুঁজি ছিল অপরাজেয় মনোবল এবং ইচ্ছাশক্তি। যে মনের শক্তি একজন নারী যার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নাই, বাইরে কাজ করার অভিজ্ঞতা নাই এবং পুরো প্রতিকূল পরিবেশ, সেইখানে তিনি কাজ করেছেন।
কলকাতার তখনকার খানদানি মুসলমান পরিবারগুলো নারী শিক্ষার প্রবল বিরোধী ছিল। যার ফলে অধিকাংশ সম্ভ্রান্ত পরিবারে বেগম রোকেয়ার প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ হয়ে গেল। অবাঞ্ছিত তিনি। তাদের সবচেয়ে বড় আশঙ্কা ছিল যে, মেয়েদের পর্দা নষ্ট হবে। বেগম রোকেয়া নিশ্চিত করেছিলেন যে, তার স্কুলে কঠোরভাবে পর্দা মানা হবে এবং পর্দা মানা হতো। রোকেয়া নিজে বোরখা পরে বাইরে বেরোতেন। স্কুলে মিটিংও করতেন পর্দার আড়াল থেকে।
কী প্রতিকূল পরিবেশ! এই খানদানি মুসলমানরা যদি জানত যে, হযরত ওমর এক নারীকে মার্কেট ইন্সপেক্টর নিয়োগ করেছিলেন এবং সেই নারী ‘হান্টার’নিয়ে মার্কেট ভ্রমণ করতেন। নয়-ছয় করার কোনো সুযোগ ছিল না। হলেই বেত। পরে তাকে মক্কার মার্কেট ইন্সপেক্টর হিসেবে পাঠিয়ে দেয়া হয় মক্কার বাজার নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে। এটা যদি জানতেন তারা তাহলে তারা বিস্মিতই হতেন। আসলে অনেক তথ্য অনেক সত্য অনেকে তাদের নিজেদের স্বার্থে গোপন করে রাখে। কারণ এই সত্য জানলে তো আবার তাদের কর্তৃত্ব থাকবে না।
রোকেয়ার স্কুল চালু হলো বছর দুয়েক পরে। বিপর্যয় নেমে এলো। স্বামীর দেয়া ১০ হাজার টাকাসহ মোট ৩০ হাজার টাকা তার সঞ্চয় ছিল। সেই টাকা তিনি বার্মা ব্যাংকে জমা রেখেছিলেন। সেই ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেল। যার ফলে তার টাকা সব নষ্ট হয়ে গেল। পুঁজি শেষ। একজন মানুষ কত প্রতিকূলতা সহ্য করতে পারেন একটু গভীরভাবে অনুভব করলে আমরা তা বুঝতে পারি। কিন্তু সকল প্রতিকূলতার মুখে অনঢ়-অটল ছিলেন। তিনি তখনকার নারী জীবনের বাস্তবতার সাথে মিল রেখেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা, হস্তশিল্প, সেলাই, এমনকি শরীরচর্চার ব্যবস্থা করেন। সেই সময় মেয়েদের শরীরচর্চার শিক্ষা কত দূরদর্শী চিন্তা ছিল!
একটা সময় বেগম রোকেয়া বুঝতে পারলেন যে, একা কাজ করা যাবে না। সঙ্ঘ গড়তে হবে। নারীদের যদি সংগঠিত করতে না পারেন, তাহলে স্কুল টিকে থাকবে না। তিনি ১৯১৬ সালে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’(মুসলিম নারী সমিতি) নামে সংগঠন গড়ে তোলেন। নারীদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তোলাটাই ছিল এর লক্ষ্য।
কী পরিমাণ প্রতিকূলতা ছিল তখন! একটা ঘটনার বর্ণনা তিনি নিজে লিখে গেছেন যে-“একবার অনেক সাধ্য সাধনার ফলে নানা প্রকারে প্রলুব্ধ করিয়া একটি শিক্ষিত মুসলমান পরিবারের মহিলাকে আঞ্জুমানের মিটিংয়ে আনা গেল। যথাসময়ে মিটিংয়ের কাজ শেষ হইল। সমবেত মহিলারা গৃহে ফিরিবার জন্যে প্রস্তুত হইলেন। এই সময় নবাগত মহিলাটি রোকেয়ার সম্মুখে আসিয়া বলিলেন, ‘সভার নাম করিয়া বাড়ির বাহির করিলেন। কিন্তু ‘সভা’তো দেখিতে পাইলাম না!” অর্থাৎ সভা যে কী এটা সম্পর্কেও তাদের কোনো ধারণা ছিল
তিনি বলতেন,“যদি সমাজের কাজ করিতে চাও, তবে গায়ের চামড়াকে এতখানি পুরু করিয়া লইতে হইবে যেন নিন্দা, গ্লানি, উপেক্ষা, অপমান কিছুতেই তাহাকে আঘাত করিতে না পারে। মাথার খুলিকে এমন মজবুত করিয়া লইতে হইবে, যেন ঝড় -ঝঞ্ঝা, বজ্র-বিদ্যুৎ সকলই তাহাতে প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসে।”
এটা বেগম রোকেয়ার জীবনেও যে-রকম সত্য ছিল, নবী-রসুলদের যুগেও এটা সত্য ছিল এবং হাজার হাজার বছর ধরে এখনো এটা সত্য আছে। আমরা 'ওয়ার্কিং ডেথ' অর্থাৎ কর্মময় মৃত্যুর কথা বলি, বেগম রোকেয়ার মৃত্যু এর একটা বড় উদাহরণ।একজন নারী, তার মৃত্যু কীভাবে হতে পারে!
তিনি রাতের বেলা লিখতে বসতেন। প্রত্যেক রাতেই লিখতেন। ১৯৩২ সালের ৮ ডিসেম্বর রাতে তিনি লিখতে বসেছেন। পরদিন ভোরে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় টেবিলে এবং তার অসমাপ্ত লেখা ছিল ‘নারীর অধিকার।’
কালকে জয় করেছেন তিনি তার কর্ম দিয়ে। তিনি লেখা সমাপ্ত করে যেতে পারেন নাই। কিন্তু তার তিরোধানের ৬০ বছর পর থেকে নারীরাই অপ্রতিহত গতিতে আমাদের ওপর রাজত্ব করছে। তার ‘সুলতানার স্বপ্ন’স্বপ্ন নাই, স্বপ্নের চেয়েও বড় বাস্তবতা হিসেবে আমাদের জীবনে রয়েছে।
আসলে একজন মানুষ যখন সত্যের জন্যে কাজ করে, স্বপ্নের জন্যে কাজ করে, তার যতটুকু সাধ্য ততটুকু কাজ করে তিনি চলে গেলেও তারপরে যিনি আসেন তিনি তার পতাকা তুলে ধরেন। তারপরে তার পতাকা আরেকজন তুলে ধরেন এবং সে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
বেগম রোকেয়া কিন্তু খুব বেশি কাজ করতে পারেননি। তার স্বপ্নকে দেখে যেতে পারেন নি। কিন্তু তার স্বপ্ন কি হারিয়ে গেছে? হারিয়ে যায়নি। আরেকজন সে স্বপ্নকে লালন করেছেন। তারপরে আরেকজন সে স্বপ্নকে লালন করেছেন। আরেকজন সে স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিয়েছেন।
এই স্বপ্ন দেখতে পারা, লক্ষ্য ঠিক করতে পারা, তার পেছনে মেহনত করতে পারা- এই মেহনত করতে পারাটা হচ্ছে ইম্পর্টেন্ট। কতটুকু অর্জন আপনি আপনার জীবনে করলেন আনইম্পর্টেন্ট। আপনি আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করেছেন কিনা এটা হচ্ছে ইম্পর্টেন্ট।
যখন আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করবেন আপনার কাজ মূল্যায়িত হবে, আপনি স্মৃতিতে থাকবেন। লাখো মানুষের অন্তরে থাকবেন, যদি আপনি সেই বিশ্বাস অনুসারে কাজ করে যান।
এএইচ/