নারায়ণগঞ্জে ভাষা আন্দোলনের নেত্রী মমতাজ বেগম
প্রকাশিত : ১২:৩৫, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | আপডেট: ১৬:২৩, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১
বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের সময়ে একুশে ফেব্রুয়ারির আগে থেকেই উত্তাল ছিল নারায়ণগঞ্জ। ঢাকার পার্শ্ববর্তী হওয়ায় সেই সময়ে এ জেলা ছিল উত্তাল। একুশে ফেব্রুয়ারির পরে শিক্ষিকা মমতাজ বেগমের মুক্তির দাবিতেও উত্তাল হয়েছিল নারায়ণগঞ্জ।
ওই সময় মর্গ্যান স্কুলের প্রধান শিক্ষক মমতাজ বেগম স্কুলের বাইরে এসেও শ্রমিকদেরকে ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত করার কাজ করতে থাকেন। তিনি আদমজী জুট মিলের তৎকালীন শ্রমিক নেতা আবুল হাশেম মোল্লার আহ্বানে শ্রমিকদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন এবং তাদেরকে বুঝাতে সক্ষম হন যে, এ আন্দোলন সফল না হলে শুধু ভাষা নয়, আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।
ভাষা সংগ্রামী ও চিত্রশিল্পী মুস্তফা মনোয়ার বলেছেন, ‘এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। অবিস্মরণীয় মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মমতাজ বেগম। শুধু যে ছাত্রী-শিক্ষিকা যোগ দিয়েছিলেন তা নয় বহু গৃহবধূরা এই মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। আমার মেজবুবু হাসিনা রহমানও যোগ দিয়েছিলেন। তার হাতে ছিল আমার আঁকা কার্টুন পোস্টার।’
মমতাজ বেগমের নেতৃত্বে একুশে ফেব্রুয়ারির মিছিলের পূর্বে নারায়ণগঞ্জে কখনো নারীদের মিছিল সংঘটিত হয়েছে বলে জানা যায়না। মমতাজ বেগমের এহেন সাহসী ভূমিকার কারণ তিনি মুসলীম লীগ সরকারের রোষানলে পড়েন। প্রথমে তারা মমতাজ বেগমকে প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে অপসারণের জন্য তার বিরুদ্ধে তহবিল তসরুপের অভিযোগ আনে।
২৯ ফেব্রুয়ারি সকালে মহকুমা প্রশাসকের নির্দেশে তাকে কর্মচ্যুত ও গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করা হয়। এ সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাস বর্জন করে মিছিল নিয়ে নারায়ণগঞ্জ কোর্ট প্রাঙ্গণে এসে হাজির হয়।
স্থানীয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে এ সংবাদ পৌঁছালে শফি হোসেন খান বিভিন্ন মিলের শ্রমিকদের কাছে এ সংবাদ পাঠিয়ে দেন। সংবাদ পেয়ে বিভিন্ন মিলের শ্রমিকরা কাজ বন্ধ রেখে মিছিল নিয়ে এসে নারায়ণগঞ্জ কোর্ট প্রাঙ্গণ ঘিরে ফেলে। পরিস্থিতি সামাল দিতে মহকুমা প্রশাসক ঢাকা থেকে ইপিআর পাঠানোর আহ্বান জানান। বিক্ষোভ দমনে পাঞ্জাব রেজিমেন্ট নারায়ণগঞ্জ আসার সংবাদে ছাত্ররা আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ঢাকার দোহার পুলের পর থেকে পঞ্চবটি পর্যন্ত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কে বড় বড় গাছ কেটে ছাত্র-জনতা ব্যারিকেড তৈরি করে। ১৬০টিরও বেশি গাছ ও ইট ফেলে রাস্তা আটকে দেয়া হয়।
এদিকে মমতাজ বেগমের জামিন আবেদনের জন্য নগদ ১০ হাজার টাকা প্রদান করা হলেও মুসলিম লীগ সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপে জামিনের আবেদন না মঞ্জুর হয়। নারায়ণগঞ্জে জামিনের অনিশ্চয়তা উপলব্ধি করে এ কে এম শামসুজ্জোহা ও ডা. মজিবর রহমানকে সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে ঢাকা জজকোর্টে জামিনের ব্যবস্থা করার জন্য পাঠানো হয় এবং তারা সেখানেও জামিন নিতে ব্যর্থ হন। আদালতের আদেশ শোনার সাথে সাথে নারায়ণগঞ্জবাসী উত্তেজনায় ফেটে পড়ে।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে গাছ ও ইটের ব্যারিকেড সরিয়ে পাঞ্জাবি সৈন্যরা নারায়ণগঞ্জে পৌঁছায়। মমতাজ বেগমকে বহনকারী ঢাকাগামী ইপিআর ও পুলিশের গাড়িটি চাষাঢ়া মোড়ে এলে হাজার হাজার জনতা গাড়িটি আটকে দেয়। পাগলা থেকে পঞ্চবটি পর্যন্ত সড়কের দু’পাশের গ্রাম থেকে হাজার হাজার জনতা এসে পথে অবস্থান নেয়। পুলিশের সাথে পাঞ্জাবি সৈন্যরা যুক্ত হয়ে ছাত্র জনতার উপর একযোগে হামলা চালায়। এতে করে পুলিশ-সৈন্যদের সঙ্গে ছাত্র জনতার সংঘর্ষ শুরু হয়।
চাষাঢ়া বাইতুল আমানে সভা বসে। তারা সে সভাতেও হামলা চালায়। শত শত লোক আহত হয়। শিশু, নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে বহু লোককে হত্যা করে তারা। সন্ধ্যার পর মমতাজ বেগমকে নিয়ে পুলিশ ভ্যানটি ঢাকায় রওয়ানা হয়।
ওই সময় দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়, ২৯ ফেব্রুয়ারি মমতাজ বেগমকে গ্রেফতারের পরে নারায়ণগঞ্জে যে হাঙ্গামা হয়েছিল তাতে দু’জন ছাত্রীসহ ১১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ধৃত ব্যক্তিদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ মিউনিসিপ্যাল কমিশনার অ্যাডভোকেট শ্রী বিনয় কৃষ্ণ রায় অন্যতম।
পরে সরকার মমতাজ বেগমকে মুচলেকার মাধ্যমে মুক্তির প্রস্তাব দেয়। মমতাজ বেগম সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তার স্বামী ঢাকার খাদ্য পরিদর্শক আব্দুল মান্নাফ তাকে মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে আসার জন্য অনুরোধ জানালে তিনি তাতেও অস্বীকৃতি জানান। এ ঘটনায় আব্দুল মান্নাফ মমতাজ বেগমকে ডিভোর্স দিয়ে তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ১৯৫৩ সালের শেষ দিকে দেড় বছর কারাভোগের পর মুক্ত হন মমতাজ বেগম।
মমতাজ বেগম সম্পর্কে ভাষা সৈনিক অলি আহাদ বলেছেন, ‘অধুনা পথে-ঘাটে অগ্নিকন্যা দাবি ভূষিত বহু নেত্রীর নাম শোনা যায়। কিন্তু তারা কি কেউ মিসেস মমতাজের ন্যায় অগ্নি অতিক্রম করে জনতার চেতনায় স্বামী ত্যাগ ও কর্মোদ্যম দ্বারা এবং জানমাল ইজ্জতের পূর্ণ ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলনের আগুন ছড়াতে সক্ষম হয়েছিল? সরকার মমতাজ বেগমের এ সাংগঠনিক শক্তি লক্ষ্য করেছিল।’
ভাষা আন্দোলন গবেষক ও লেখক বদরুদ্দিন উমর বলেছেন, ‘ভাষা আন্দোলনে নারীদের ভূমিকায় যে শীর্ষ ব্যক্তির নাম সর্বাগ্রে থাকা দরকার তার বিষয়ে বিশেষ কিছুই বলা হয় না। এমনকি অনেক আলোচনায় যার নাম কোন উল্লেখই থাকে না তিনি হলেন মমতাজ বেগম।’
এআই//