শেখ হাসিনা : অনুমান অসম্ভব রাষ্ট্রনায়ক
প্রকাশিত : ১১:৩০, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ | আপডেট: ২০:৪৮, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১
তখনও রাতের আঁধার কাটেনি ব্রাসেলসে। ব্রহ্মাণ্ডের কর্কশতম শব্দে যেনো বেজে উঠলো টেলিফোন। কুয়াশায় মোড়া সেই শীতভোরের টেলিফোনে এসেছিলো মর্মান্তিক দুঃসংবাদটি। ২৮ বছর বয়সী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তখনও জানতেন না, সব হারিয়ে নিঃস্ব তিনি।
ফোনটা করেছিলেন জার্মানির বন থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী। শেখ হাসিনাকে সরাসরি জানাতে চাইলেন না খবরটি। কথা বললেন, তার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে। ভীষণ উৎকণ্ঠা নিয়ে পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন শেখ হাসিনা। মন বলছিলো, খুব খারাপ কিছু একটা ঘটেছে। ওয়াজেদ মিয়া ফোন রেখে যখন জানালেন, বাংলাদেশে ক্যু হয়েছে; তখনই ইলেকট্রিক শকের মতো বেদনার শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে রক্তশিরায়।
ঠিক ধরেছিলেন তিনি। আর কেউ-ই বেঁচে নেই। মা-বাবা-তিন ভাইসহ পরিবারের কোনো আপনজনই আর নেই তার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বাঙ্গালীর ইতিহাসে কংলকময় কালো দিন। স্বাধীনতার স্থপতি বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে সপরিবারে হত্যা করে বিপৎগামী সেনাদের একটি দল।
এই দিন থেকে পাল্টে যায় শেখ হাসিনার জীবনের গতিপথ। পিতা-মাতাসহ পরিবারের সবাইকে হারানোর পথ ধরেই শুরু হয় অচেনা যাত্রা। অমানিশার অন্ধকারময় পথে...
ব্রাসেলসে ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাড়িতে। অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর, ওইদিন রাতে আনুষ্ঠানিক দাওয়াত স্থগিত করেন। একইসঙ্গে দুই কন্যা ও জামাতাকে কোনও ধরনের সাহায্য করতেও অস্বীকার করলেন হক। শেখ হাসিনার বক্তব্যে, “আমরা যেন উনার জন্য বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম”। দ্রুত তাঁদের চলে যেতে বলেন হক পরিবার। যাওয়ার কথা ছিলো, ফ্রান্সের প্যারিস। ফোন বাজার সাড়ে ৪ ঘণ্টা পর বোন শেখ রেহানা আর দুই ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা হন জার্মানির বনের উদ্দেশ্যে। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর বাসায় পৌঁছান তাঁরা। দু’বোনই তখন অঝোরে কাঁদছিলেন। চোখ বেয়ে নামছিলো অপার শূণ্যতার অশ্রু।
আবু আব্বাস ভূঁইয়া
মাত্র ১০ দিন জার্মানিতে থাকতে পেরেছিলেন শেখ হাসিনা-শেখ রেহানা। মাত্র ২৫ ডলার হাতে নিয়ে এসেছিলেন দুই বোন। রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদের কাছ থেকে হাজার খানেক জার্মান মুদ্রা নিয়ে চলে তাদের ওইদিনগুলো। নিরাপত্তার কথা ভেবে শুরু থেকেই তাঁদেরকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার পক্ষে ছিলেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। এরই ধারাবাহিকতায় কয়েক দফায় জার্মানিতে ভারতীয় দূতাবাসে যোগযোগ করেন ওয়াজেদ মিয়া।
২৪ আগস্ট দুই সন্তান ও বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে আসেন শেখ হাসিনা ও তার স্বামী ওয়াজেদ মিয়া। গন্তব্য গোপন রেখে শুরু হয় যাত্রা। পরদিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছান তারা। সপরিবারে পিতাকে হারানোর মাত্র ১০ দিনের মাথায় যে জীবন শুরু করেছিলেন, কেমন ছিলো তার সেই জীবন?
বিমানবন্দরে নামার পর, সেখানেই প্রায় চার ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় তাদের। দুপুরের দিকে নয়াদিল্লির ডিফেন্স কলোনীতে ছোট্ট একটা বাসায় জায়গা হয় তাদের। বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ, কারো কাছে পরিচয়ও দেয়া যাবে না, এমনকি দিল্লিতে কারো সাথে যোগাযোগ করা যাবে না- শেখ হাসিনার ছোট্ট পরিবারকে এমন তিন কড়া পরামর্শ দিয়েছিলো ভারত সরকার। এই সময়টায় জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা ও তার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়াকে নামও বদলে ফেলতে হয়েছিলো।
ভারতে তখন জরুরী অবস্থা চলছিলো। বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কোন খবর ছাপা হতো না দেশটির পত্রপত্রিকায়। তাই ভয়ানক দুশ্চিন্তা নিয়ে দিন পার করছিলেন তারা। দু’সপ্তাহ পর গোপনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎ পান শেখ হাসিনা। ১৫ আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য জানান গান্ধী। কষ্টের তীব্রতায় নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলেন না শেখ হাসিনা। ইন্দিরা গান্ধী তখন তাকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দেন। বলেন, ‘তুমি যা হারিয়েছো, তা আর কোনভাবেই পূরণ করা যাবে না। তোমার একটি শিশু ছেলে ও মেয়ে রয়েছে। এখন থেকে ছেলেকেই তোমার আব্বা এবং মেয়েকে তোমার মা হিসেবে ভাবতে হবে। আর তোমার সঙ্গে রয়েছে বাংলার কোটি জনতা।
১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে ওই একবারই সাক্ষাত হয়েছিলো শেখ হাসিনার। একপর্যায়ে ডিফেন্স কলোনী থেকে ইন্ডিয়া গেটের কাছে পান্ডারা পার্কে নতুন আবাস হয় শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের। নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত ছিলো দু'জন। নামে মাত্র সরকারী খরচে চলতো তাঁদের দিন। সেবছর দ্বাদশ শ্রেণীতে পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার। কিন্তু বাংলাদেশের ঘটনাবলীর জন্য বন্ধ হয়ে যায় তাঁর পড়াশোনা। শান্তি নিকেতনে ভর্তির কথা চললেও নিরাপত্তাজনিত কারণে তাও বাতিল হয়। ৭৬-এ শেখ রেহানার বিয়ে হয় লন্ডন প্রবাসী শফিক সিদ্দিকের সঙ্গে।
৭৭-এ ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচনে হেরে গেলে শেখ হাসিনা ও ওয়াজেদ মিয়ার ওপর চাপ বাড়তে থাকে। প্রথমে ফ্ল্যাটের বিদ্যুৎ বিল বন্ধ করে দেয়া হয়, এরপর তুলে নেয়া হয় গাড়ীর ব্যবস্থাও। বলতে গেলে, তাদেরেকে এক প্রকার ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য বাধ্যই করে নতুন সরকার। ফেরারী জীবন যেন শেষই হচ্ছিলো না আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। স্বামী, ছেলে-মেয়েকে নিয়ে লন্ডনে যান তারা। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এভাবেই ৬ বছর নির্বাসিত-যাযাবরের জীবন কাটান শেখ হাসিনা।
তবে এরিমাঝে শোকের পাথর বুকে বেঁধে নিজেকে তৈরি করতে শুরু করেছিলেন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে। স্বজনহারার যন্ত্রণা লয়ে সবহারা শেখ হাসিনা পা রাখেন পিতার গড়া স্বাধীন বাংলাদেশে। ঢাকা বিমানবন্দরে সেদিন ১৫ লাখেরও বেশি মানুষ তাঁকে স্বাগত জানাতে হাজির হন। নিষ্পেষিত মানুষের হাহাকার কণ্ঠে ধারণ করে, আকাশের দিকে দুই হাত তুলে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও বাংলার মানুষের কাছে বিচার চান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। পনের আগস্টের ন্যাক্কারজনক নৃশংসতায় আতংকিত ক্ষুব্ধ বাংলার মানুষ হয়ে ওঠে তাঁর আপনজন। আর এই ভালোবাসাকেই পুঁজি করেই রাজনৈতিক অঙ্গনে ও সাধারন মানুষের অন্তরে স্থান করে নেন জননেত্রী।
১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জন্ম শেখ হাসিনার। প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বিস্তৃত তার রাজনৈতিক কর্মজীবন। ছাত্রজীবনে ছিলেন তুখোড় নেতা। যার প্রমাণ দিয়েছেন ইডেন কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হয়ে।
১৯৮১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা ঐক্যের প্রতীক হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। তখনো দেশে আসেননি। পরে ১৭ মে বাংলাদেশে এসেই রাজনৈতিক মঞ্চে নিজেকে ও তার দলকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে লেগে যান শেখ হাসিনা। তবে খুব সহজ ছিলো না স্বৈরাচারী খুনি জিয়া সরকারের যাঁতাকলে পিষ্ট দেশে, স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর জেষ্ঠ্যকন্যা শেখ হাসিনার শুরুর পথচলা। ছুটে গিয়েছিলেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের রক্তস্নাত বাড়িতে। কিন্তু খুনী জিয়া সরকারের পেটোয়া বাহিনী বঙ্গবন্ধু ভবনে ঢুকতেই দেয়নি তাঁকে। ১৯৮২’র ফেব্রুয়ারিতে ড. ওয়াজেদ মিয়া বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের যোগ দেয়ায় মহাখালীতে দুই কামরার একটা বাসা বরাদ্দ পান। শেখ হাসিনা সেই ফ্ল্যাটেই স্বামীর সঙ্গে থেকেছেন। নতুন জীবনে দলকে পুনর্গঠন আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শেখ হাসিনা। সারাদেশে দলকে পুনর্জীবিত করার সংগ্রামে মনোনিবেশ করেন।
খুনী জিয়া ও মুশতাক সরকারের কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী এবং জেলহত্যাকারীদের বিচার করার প্রত্যয় ঘোষণা করেন। দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের কারাগার ও অভিযোগ থেকে মুক্তি, চিহ্নিত স্বাধীনতা বিরোধীদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তকরণ এবং স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাজনীতি করার সুযোগদানের বিরুদ্ধে শুরু করেন সংগ্রাম। রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট, ঘুষ-দুর্নীতি এবং অবৈধ ক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধেও দেশবাসীকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান।
১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতায় আরোহনকে অবৈধ ঘোষণা করে এরশাদবিরোধী দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন শেখ হাসিনা। ১৯৮৩ সালে তিনি পনেরো দলের একটি জোট গঠন করেন। তার নেতৃত্বে দেশজুড়ে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠায় ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সামরিক শাসকের নির্দেশে শেখ হাসিনাসহ ৩১ জন নেতা-কর্মীকে শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে সামরিক গোয়েন্দারা চোখ বেঁধে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায় এবং বিনা কারণে একটানা ১৫ দিন আটকে রাখে। ১৯৮৪-এর ফেব্রুয়ারি ও নভেম্বরে তাকে পুনরায় গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৮৫-এর মার্চে তাকে ৩ মাস মাস বিনাবিচারে আটক রাখে। জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকা সত্ত্বেও ১৯৮৬-এর ১০ নভেম্বর তিনি যখন সচিবালয় অবরোধ কর্মসূচির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তখন পুলিশ তাঁর প্রতি গুলিবর্ষণ করে এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গাড়িতে থাকা অবস্থায় ক্রেন দিয়ে সেই গাড়ি তুলে নেয়ার চেষ্টা চলে। পরদিন ১১ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে ১ মাসের আটকাদেশ দেয়া হয়। ১৯৮৮-এর ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে তাঁকে হত্যার উদ্দেশে তাঁর গাড়ি বহরে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যাকে রক্ষায় প্রায় অর্ধশত নেতাকর্মী প্রাণ বিসর্জন দেন। ১৯৮৯-এর ১১ আগস্ট রাত ১২টার দিকে ফ্রিডম পার্টির একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনে হামলা চালায়। বঙ্গবন্ধু কন্যা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তখন সেখানে ছিলেন। হামলাকারীরা ৭/৮ মিনিট ধরে বঙ্গবন্ধু ভবন লক্ষ্য করে গুলি চালায় ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। তবে সেটি বিস্ফোরিত হয় নাই। ১৯৯০-এর ২৭ নভেম্বর স্বৈরাচারী সরকারের জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু ভবনে অন্তরীণ করা হয়। অবশ্য প্রবল গণরোষের ভয়ে সামরিক সরকার ওইদিনই তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
এরপর আসে- খুনী জিয়ার পরম্পরার রাজনীতি নিয়ে খালেদা জিয়ার সরকার। শুরু হয় এবার জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার একের পর এক চেষ্টা। ১৯৯১ এর ১১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গ্রীণরোডে উপনির্বাচনে ভোটের পরিস্থিতি দেখতে গেলে বিএনপি’র কর্মীরা গুলিবর্ষণ ও বোমা বিস্ফোরণ করে। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪ তারিখে ঈশ্বরদী ও নাটোর রেল স্টেশনে প্রবেশের মুখে তাঁকে বহনকারী রেল গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়; স্টেশনে সমাবেশ পন্ড করার জন্য আগে থেকে অসংখ্য বোমা ফাটানো হয়। শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়। ১৯৯৫ এর ৭ ডিসেম্বর শেখ রাসেল স্কোয়ারে সমাবেশে ভাষণ দানরত অবস্থায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সাবেক বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার উপর গুলিবর্ষণ করা হয়। ১৯৯৬ এর ৭ মার্চ বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতার পর অকস্মাৎ একটি মাইক্রোবাস হইতে সভামঞ্চ লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপ করা হইলে অন্তত ২০ জন আহত হয়।
জেল-জুলুম, গৃহবন্দিত্ব এমনকি চোখের সামনে মৃত্যুর স্বরূপ বার বার দেখতে হয়েছে তাঁকে। তবে এসব যেনো তাঁকে আরো সাহসি ও আরো দৃঢ় করে তোলো। পিতা যেমন ধ্বংসস্তুপ থেকে মাত্র সাড়ে ৩ বছরে স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তেমনই স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠা করেন ভোট ও ভাতের অধিকার। ৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর জনতার রায় নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬-২০০১ পাঁচ বছর ছিল স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল সময়। এ’সময়কালের মধ্যে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের সাথে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, ১৯৯৮ সালে যমুনা সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা, ১৯৯৯ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করাসহ অনেকগুলো খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়। এসময় দ্রব্যমূল্য ছিল ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে। কৃষকের জন্য ন্যায্যমূল্যে সার, বীজ সরবরাহ এবং সেচ সুবিধা সম্প্রদারণের ফলে দেশ প্রথমবারের মতো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। প্রায় ২ হাজার ৬শ' মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। প্রথম মোবাইল প্রযুক্তির বাজার উন্মুক্ত করে দেয়া হয় এবং উল্লেখযোগ্য হারে কর সুবিধা প্রদান করা হয়। বেসরকারি খাতে টেলিভিশন চ্যানেল অপারেটরের অনুমতি প্রদান করে আকাশ সংস্কৃতিকে তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যওয়া হয়। পিতার সাথে মাতার নাম লেখা বাধ্যতামূলক করা হয়। কম্পিউটার আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক হ্রাসকরণের দ্বারা সাধারণের হাতে হাতে বিশ্বয়ানের মাধ্যম পৌঁছে দেয়া হয়। তবে এ দফায় মাত্র পাঁচ বছর ক্ষমতা থাকতে পারেন শেখ হাসিনা। দীর্ঘ দুই দশকের ষড়যন্ত্র আর ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার প্রবণতা থেকে বিএনপি-জামায়াত জোটকে হটানো কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা, বৈশ্বিক ষড়যন্ত্র আর জনমতামত উপেক্ষা করা নির্বাচনে হারিয়ে দেওয়া হয় আওয়ামী লীগকে। এরপর শুরু হয় বঙ্গবন্ধুকন্যাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার ফর্মুলা বাস্তবায়ন; থেমে থাকে না খুনী খালেদা ও জঙ্গি তারেকের ষড়যন্ত্র, নীলনকশা। চলে শেখ হাসিনাকে অন্তত ২১ বার হত্যার ষড়যন্ত্র ও অপচেষ্টা
২০০২-এর ৪ মার্চ নওগাঁয়, ২০০২ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার কলারোয়ায় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর হামলা চালানো হয়। ২০০৪ সালের ২ এপ্রিল বরিশালের গৌরনদীতে শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে গুলিবর্ষণ করে জামায়াত-বিএনপির ঘাতক চক্র। এরপর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে শান্তি সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। খালেদা-পুত্র তারেক জিয়ার প্রত্যক্ষ মদদে এদিন শেখ হাসিনা-সহ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূণ্য করার চেষ্টা চালানো হয়। কয়েকজন নেতা অল্পের জন্য ভয়াবহ এই হামলা থেকে বেঁচে গেলেও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমান এবং আরও ২৩ জন নেতাকর্মী নিহত হন। এছাড়াও ওই হামলায় আরও ৪শ’ জন আহত হন। যাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাদের কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি।
২০০৬ সালের ২৯ অক্টোবর ইয়াজউদ্দিনকে দিয়ে ক্যু ঘটিয়েছিল আওয়ামী লীগবিরোধী এবং বিএনপি-জামাতের পক্ষের শক্তি। এরপর আসে সেনা সমর্থিত অবৈধ সরকার। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই তারিখে অন্যায়ভাবে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করা হয় জননেত্রী শেখ হাসিনাকে। পরে সাব জেলে খাবারে স্লো পয়জনিং-এর মাধ্যমে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালের ১১ জুন এগারো মাস কারাভোগের পর শেখ হাসিনাকে প্যারোলে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের সরকার।
আর শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে ২০০৮ সাল থেকে টানা ৩ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বে সরকার পরিচালনা করছে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা যেন অবিকল পিতা বঙ্গবন্ধুরই প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধু যেমন ধ্বংসস্তুপ থেকে মাত্র সাড়ে ৩ বছরে স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়েছিলেন, কন্যা অনুসরণ করছেন পিতারই পদাঙ্ক। রাষ্ট্রদর্শনে প্রাধান্য দেন জনগণ ও দেশের উন্নয়নকে। বিশ্ব পরিমন্ডলে জননেত্রী শেখ হাসিনা আজ গণতন্ত্র, উন্নয়ন, ন্যায়বিচার ও শান্তির প্রতীক হয়ে উঠেছেন। পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বৈষম্যহীন এবং সকলের অংশগ্রহণমূলক ক্ষুধা, দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলা গঠনের কাজ করে যাচ্ছেন নিরলস।
বঙ্গবন্ধুকন্যা ঘুচিয়ে দিয়েছেন পশ্চিমাবিশ্বের তলাবিহীন ঝুড়ির গ্লানির অপবাদ। বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক কাঠামোর ধারাবাহিকতায় টেকসই অর্থনীতির ভিত গড়েছেন। ‘মানুষ নিয়েই কল্যাণ রাষ্ট্র’- বঙ্গবন্ধুর এই দর্শনই রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার মূলমন্ত্র।
স্থায়ী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্বনির্ভর খাদ্য ব্যবস্থা, নারীর ক্ষমতায়ন, গ্রামীণ জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, অবকাঠামো, তথ্য-যোগাযোগ ও প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানীসহ উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রেই শেখ হাসিনা সরকারের সাফল্যে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল।
স্বাধীনতার পরে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট এখন ৭২৩ গুন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার উপরে। সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার জিডিপির আকার হয়েছে প্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা। রপ্তানীর আকার ৩ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বৈদেশিক মূদ্রার বাজার ১ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ছাড়িয়েছে ১৮০ বিলিয়ে ডলারে।
বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম। জিডিপি-তে আমরা বিশ্বের ৪১তম। গত এক দশকে দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫ থেকে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এসময়ে আমাদের মাথাপিছু আয় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২,২২৭ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ সর্বকালের সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে।
মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- তিন সূচকের মানদন্ড পুরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছেছে।
পদ্মাসেতুর মতো মেগা প্রজেক্ট এখন আর স্বপ্ন নয় বাস্তব। অদম্য সাহসী শেখ হাসিনা বৈশ্বিক ঋন ও দাতা সংস্থাগুলোকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প দৃশ্যমান করেছেন। আর একবছর পরই সেতুর উপর দিয়ে একইসাথে চলবে বাস-ট্রেন।
রাজধানীতে দৃশ্যমান মেট্রোরেলের পথও। যানজট এড়ানো এবং নগরবাসীর ভোগান্তি কমাতে একাধিক উড়াল সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও ফ্লাইওভার নির্মাণ দ্রুতগতিতে অগ্রসরমান।
ঢাকার বাইরে দেশব্যাপী চলমান নানান বড় বড় সব প্রকল্প। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীতে টানেল নির্মাণ, পাবনায় রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা সমুদ্র বন্দর, দোহাজারি-রামু-কক্সবাজার ঘুমধুম রেলপথ, মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং চট্টগ্রামে এলএনজি টার্মিনাল। দেশজুড়ে গড়ে উঠছে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল। সময়মত এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা। উন্নয়নের গতি ধরে রাখতে ১০০ বছরের ডেল্টা প্ল্যানও রয়েছে সরকারের।
দুর্যোগে-মহামারিতেও বিচক্ষণ নেতৃত্বে সংকট কাটিয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক রেখেছেন হাসিনা সরকার। করোনা মহামারি মোকাবেলায় বিশ্বের অনেক বড় বড় অর্থনীতির দেশ যেখানে খেই হারিয়ে ফেলেছিল, বাংলাদেশ সেখানে জীবন-জীবিকা রক্ষায় মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়ে চলেছে। একদিকে অর্থনীতি সচল রাখতে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে বিভিন্ন খাতে। আবার ভ্যাকসিন নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিপুল চাহিদার মধ্যেও দ্রুততম সময়ে দেশের মানুষের জন্য তা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
প্রায় দেড় বছরের করোনার ধাক্কার পরও বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ধারণা উড়িয়ে, এশিয়ার সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি। এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত ও সঠিক নির্দেশনায়।
২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর শুরু করা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার মিশন বাস্তবায়নের ফলাফল মহামারীকালীন সময়ে শিক্ষা, চাকরীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এনে দেয় নতুন সফলতা। মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটালাইট উন্মুক্ত করে প্রযুক্তির আরেক দ্বার।
শুধু অর্থনীতি আর উন্নয়ন নয়, নিজেরাই নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে থেকেও ছোট্ট এই দেশটির প্রধানমন্ত্রী, ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সাড়ে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার জন্য খুলে দেন মানবতার দ্বার।
এমন মানবিক, দৃঢ়চেতা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অধিকারী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রংশসা কুড়িয়েছেন। শেখ হাসিনা পরিণত হয়েছেন বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের একজন। বিশ্বের ক্ষমতাধর ১০০ নারীর তালিকায় বার বার এসেছে তাঁর নাম। বিশ্ব পরিমন্ডলে তিনি আজ গণতন্ত্র, উন্নয়ন, ন্যায়বিচার ও শান্তির প্রতীক।
দূরদশী জননেত্রীর স্বপ্ন বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি জ্ঞানভিত্তিক উন্নত দেশ ও ২১০০ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ ও টেকসই বদ্বীপে রূপান্তর করা। তার নেতৃত্বেই কল্যাণ রাষ্ট্রের সব উপাদান নিয়ে বাংলাদশে এখন টেকসই অর্থনীতির দেশ। স্বজন হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে দেশে ফিরে জনমানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ে শুরু করা তাঁর নিরন্তর সংগামের ফল মিলছে। বঙ্গবন্ধুর দর্শনই বাস্তবায়ন হচ্ছে আধুনিক বাংলাদেশে, যার রূপকার তাঁরই সুকন্যা প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৭৫তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা অপার, জননেত্রী। কামনা করি, সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু। শতবর্ষের জয়ন্তীর শুভকামনা। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। জয়তু দেশরত্ন শেখ হাসিনা।
(লেখক- সাবেক ছাত্রলীগ নেতা)
এসএ/