শেখ আবু নাসের-এর সংগ্রামী জীবনগাঁথা
প্রকাশিত : ১৪:৫৪, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | আপডেট: ১৭:৩৯, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৩
বাঙালি জাতীসত্তার উন্মেষ ও বিকাশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার এবং স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সুদীর্ঘ ২৩ বছরের পথপরিক্রমা ছিল বন্ধুর এবং কণ্টকাকীর্ণ। ২৩ বছরের নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে গর্ব ও অহংকারের আমাদের সুমহান মুক্তিযুদ্ধে যাদের সংগ্রাম ও অপরিসীম আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একমাত্র ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ শেখ আবু নাসের সংগ্রামী জীবন আজ আমাদের আলোচ্য।
ভারতীয় উপমহাদেশ তখনও ব্রিটিশ উপনিবেশ। সুদীর্ঘকালের শাসন-শোষণে নিষ্পেষিত ভারতবাসি পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে স্বাধীনতার মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস ফেলার জন্য সংগ্রামরত। ভারতের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বাংলা প্রদেশের অধিবাসীরাও তখন সংগ্রাম মুখর। মুক্তি পাগল সেই বঙ্গভূমির পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদীর পলিমাটি বিধৌত শস্য শ্যামল তদানীন্তন ফরিদপুর জেলাধীন গোপালগঞ্জ মহকুমার বাইগার নদীর তীর ঘেঁষে ছবির মতো সাজানো সুন্দর একটি গ্রাম। সে গ্রামটির নাম টুঙ্গিপাড়া। বাইগার নদী এঁকেবেঁকে গিয়ে মিশেছে মধুমতী নদীতে। এই মধুমতী নদীর অসংখ্য শাখা নদীর একটি নদী বাইগার নদী। নদীর দুপাশে তাল, তমাল, হিজল গাছের সবুজ সমারোহ। ভাটিয়ালি গানের সুর ভেসে আসে হালধরা মাঝির কণ্ঠ থেকে, পাখির গান আর নদীর কলকল ধ্বনি এক অপূর্ব মনোরম পরিবেশ গড়ে তোলে।
প্রায় দু’শত বছর পূর্বে মধুমতী নদী এই গ্রাম ঘেঁষে বয়ে যেত। এই নদীর তীর ঘেঁষেই গড়ে উঠেছিল জনবসতি। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে ধীরে ধীরে নদীটি দুরে সরে যায়। চর জেগে গড়ে ওঠে আরও অনেক গ্রাম। সেই দু’শত বছর আগে ইসলাম ধর্মপ্রচারের দায়িত্ব নিয়েই শেখ পরিবারের পূর্ব-পুরুষরা এসে এই নদী বিধৌত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সুষমামণ্ডিত ছোট্ট টুঙ্গিপাড়া গ্রামটিতে তাদের বসতি গড়ে তোলেন। শেখ পরিবারের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল কলকাতা বন্দরকে কেন্দ্র করে। শেখ পরিবারের সদস্যগণ গ্রামের বসবাসকারী কৃষকদের সাথে নিয়ে অনাবাদী জমা-জমি চাষাবাদ করে টুঙ্গিপাড়াকে বর্ধিষ্ণু গ্রামরূপে গড়ে তোলেন। টুঙ্গিপাড়া গ্রামে যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল নৌকা নির্ভর। শেখ পরিবারের পূর্ব পুরুষরা টুঙ্গিপাড়া গ্রামে কলকাতা থেকে কারিগর ও মিস্ত্রি এনে বিল্ডিং তৈরি করেন। যা সমাপ্ত হয় ১৮৫৪ সালে। ১৯৭১ সালের যে দুটো বিল্ডিং-এ বসতি ছিল পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী আগুন দিয়ে সে দুটোই জ্বালিয়ে দেয়।
এভাবে দালান কোঠায় বসবাস শুরু হবার পর ধীরে ধীরে বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে আর আশপাশে বসতির সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। এই বিল্ডিং এর উত্তর-পূর্ব কোণে টিনের চৌচালা ঘর তোলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দাদা শেখ আব্দুল হামিদ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পিতা শেখ লুৎফর এই বাড়িতেই সংসার গড়ে তোলেন। শেখ লুৎফর রহমান পেশাগত জীবনে ছিলেন দেওয়ানী আদালতের একজন সেরেস্তাদার। পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত তার জমি-জমাও ছিল প্রায় শতাধিক বিঘা। তাদের পরিবারে প্রাচুর্য ছিলো না, ছিল সচ্ছলতা। শেখ লুৎফর রহমানের নিজের জমির যে পরিমাণ ফসল তার গোলা ভরে উঠতো তা দিয়ে সারা বছরই স্বচ্ছন্দে চলে যেত। শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন খাঁটি বাঙালী, মুসলমান সুফি প্রকৃতি স্বভাবের। শেখ লুৎফর রহমানের স্ত্রীর নাম ছিলো শেখ সায়রা খাতুন। শেখ লুৎফর রহমানের ছিল ছয় সন্তান। চার মেয়ে ও দুই ছেলে।
ছয় সন্তানের নাম ছিল বড় মেয়ে ফাতেমা বেগম, মেজো মেয়ে আছিয়া বেগম, শেখ মুজিবুর রহমান, আমেনা বেগম হেলেন, খোদেজা বেগম লিলি ও শেখ আবু নাসের। শেখ লুৎফর রহমানের সন্তানদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয় সন্তান, কিন্তু পুত্র সন্তানদের মধ্যে প্রথম। দুজন কন্যা সন্তানের পর মুজিবকে শেখ লুৎফর রহমান ও তার স্ত্রী শেখ সায়রা খাতুন স্বভাবতই অত্যন্ত খুশী হয়েছিলেন এবং তার উপর আদর স্নেহের মাত্রাও একটু বেশি ছিলো। শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম পুত্র সন্তান হওয়ায় তাকে ঘিরেই মা-বাবার স্বপ্ন রচনা শুরু হয়। ছেলেদের মধ্যে বড় শেখ মুজিব এবং ছোট ছিলেন শেখ আবু নাসের।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার একমাত্র ছোট ভাই শেখ আবু নাসের এই দুই ভাইয়ের গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বঙ্গবন্ধুর জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ, আর শেখ আবু নাসেরের জন্ম ১৯২৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। বড় ভাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়ে বয়সে সাড়ে আট বছরের ছোট ছিলেন শেখ আবু নাসের। তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের যে অটুট ও মধুর সম্পর্ক আমৃত্যু ছিল তা পৃথিবীতে বিরল।
গ্রামের আলো ছায়ায় বেড়ে উঠা শেখ নাসের ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর পরই ব্যবসায়িক কারণে পাশ্ববর্তী শিল্প ও বাণিজ্য নগরী খুলনা আসেন। তখন খুলনায় পাট ব্যবসা বিশ্ববিখ্যাত। শেখ নাসের শিপিং ব্যবসা শুরু করেন। আর এভাবেই তার খুলনায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু।
বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় গ্রেফতার হয়েছিলেন। তখন শেখ আবু নাসের দশম শ্রেণির ছাত্র। সেই ১৯৪৮ সালের গোয়েন্দা নথিতে বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই হিসেবে শেখ আবু নাসেরের নাম লিপিবদ্ধ ছিল। আর তার পেশা দেখানো হয়েছিল ব্যবসা। সুতরাং অনুমান করা যায় শহীদ শেখ আবু নাসের অল্প বয়সে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি বড় ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার ছিলেন।
শৈশবে তার টাইফয়েড রোগ হয় এবং একটি পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে কেউ কেউ তাকে তৈমুর লং বলেও ডাকতেন।
বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বিশেষ করে তিনি যখন জেলে অন্তরীণ থাকতেন সেসময় আবু নাসের পিতৃস্নেহে বঙ্গবন্ধুর ছেলে-মেয়েদের দেখাশোনা করতেন। বঙ্গবন্ধু তার 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে এ বিষয়ের অবতারণা করেছেন এভাবে- “আমার ছোট ভাই নাসের ব্যবসা শুরু করেছে খুলনায়। সে আমার ছেলে-মেয়েদের দেখাশোনা করে। বাড়ি থেকে তার কোন টাকা পয়সা নিতে হয় না। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। মাঝেমাঝে কিছু টাকা বাড়িতে দিতেও শুরু করেছে।” বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্য থেকেই বুঝা যায় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে অল্প বয়সেই (১৯৫২ সালে যখন তার বয়স মাত্র ২৩-২৪ বছর) তিনি কতটা দায়িত্বশীল ছিলেন।
১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধু যখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, সে সময়ে শেখ আবু নাসের পাবনার বিখ্যাত হেরাজ ম্যানশনের মালিক হেরাজ বিশ্বাসের কন্যা বেগম রাজিয়া নাসের ডলির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বেগম রাজিয়া নাসের ডলি ছিলেন আধুনিক, সংস্কৃতমনা ও সুদর্শনা নারী। হেরাজ বিশ্বাস তখন খুলনায় থাকতেন। বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক কোন কর্মসূচীতে খুলনায় গেলে শেখ নাসেরের নূরনগরস্থ বাড়ীতে উঠতেন। খুলনা ও পাশ্ববর্তী এলাকার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল শেখ আবু নাসেরের বাড়িটি। স্বাধীনতা পরবর্তী খুলনা অঞ্চলের আওয়ামীলীগকে সংগঠিত করতে শেখ আবু নাসেরের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
শেখ নাসেরের ব্যবসা ভালই চলছিল। কিন্তু ভাগ্য তাকে সাহায্য করেনি। তাইতো ১৯৭১ এ পাক হানাদাররা শেখ নাসেরের সকল ব্যবসা বন্ধ করে দেয়।
১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার অপরাধে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানে আটক অবস্থায় ছিলেন, তখন শেখ আবু নাসেরের সকল ব্যবসা ধ্বংস করে দেয় পাকিস্তান আর্মি। সে সময়ে সরকারী ছাত্র সংগঠন এনএসএফ এর প্রচণ্ড প্রভাব ছিল। বিশ্বাস সিরাজুল হক পান্না (পান্না বিশ্বাস), লালু, ইসমত কাদির গামা সহ অন্যান্য ছাত্রনেতা যারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গোপালগঞ্জে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন তাদের সাথে এনএসএফ এর অসংখ্যবার সংঘর্ষ হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণার পর থেকে পান্না বিশ্বাসসহ অন্যান্য ছাত্রলীগের নেতারা গোপনে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। এ সময় ঢাকায় অবস্থান করা শেখ আবু নাসের টুঙ্গিপাড়ায় এসে উপস্থিত হন। ছেলেবেলা থেকে ডানপিঠে শেখ আবু নাসের গ্রামে ফিরে এসে যুবকদের সংগঠিত ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারনের চেষ্টা চালান।
কিছু দিনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালও এখানে এসে কেড়াইলকোপা গ্রামের সাবেক ইপিআর সদস্য কাজী মোস্তফা ও সেনা সদস্য রাসেককে সাথে নিয়ে যুবকদের সংগঠিত করেন।
ধানমন্ডি- ৩২ থেকে শেখ জামাল পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে তাকে খুঁজতে হানাদার বাহিনী ১৯ মে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে আসে। এ সময় তারা বঙ্গবন্ধুর বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়। ঐ দিন হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে গ্রামের ছয় জনকে গুলি করে হত্যা করে। শেখ বাড়ীর শেখ বোরহান উদ্দিনকে পাক বাহিনী ধরে ফেলে। তার ফুফু পাক বাহিনীর কমান্ডারকে কাজের ছেলে বলে ছাড়িয়ে রাখে। এ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর মা ও বাবাকে মৌলভী আব্দুল বারী বিশ্বাসের বাড়ীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঐ বাড়ী নিরাপদ না হওয়ায় কিছুদিন পর সেখান থেকে ঝিলু বিশ্বাসের বাড়ীতে আশ্রয় নেন তারা। এরপর মুক্তিযুদ্ধ যখন তুঙ্গে, হেমায়েত বাহিনীর দুই সদস্য আলম ও ফারুখ তাদেরকে শিবচরে ইলিয়াস চৌধুরীর বাড়ীতে রেখে আসে।
প্রায় মাসখানেক পর শেখ আবু নাসের ৭১ সালের ২৪ শে জুন পান্না বিশ্বাস সহ ভারতে চলে যান। তাকে ভারতের ৯ নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার ২৪ পরগনাস্থ টাকির গাঙ্গুলী বাড়িতে নিয়ে যান তারই ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত। সেখানে তার সাথে প্রায় দেড় মাস থাকার এবং তাকে দেখাশোনা করার সৌভাগ্য হয়েছিল পরবর্তীতে ৯নং সেক্টরের অধীন বৃহত্তর বরিশাল সাব সেক্টরের টুআইসি আব্দুল হক বীরবীক্রম এর। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এবং আব্দুল হক বীরবিক্রম উভয়ের বাড়ি বরিশালের গৌরনদীতে হওয়ায় তাকে শ্যালক শেখ নাসেরের দেখাশুনার দায়িত্ব দেন জনাব সেরনিয়াবাত।
শেখ আবু নাসের সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগপ্রবণ আব্দুল হক বলেন-
“অমায়িক ব্যবহার ছিল তার, কম কথা বলতেন। সারাদিন রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শুনতেন, যুদ্ধের অগ্রগতি জানতে চাইতেন। বঙ্গবন্ধুর জন্য সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকতেন। বাংলাদেশে থাকা তার স্ত্রী সন্তানদের জন্যও চিন্তা করতেন।”
আব্দুল হক বীরবিক্রম শেখ নাসেরকে চাচা ডাকতেন। শেখ নাসেরও তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তার খাওয়া দাওয়া, ঘুম, গোসল সবকিছু দেখভাল করতেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হক। প্রতিবেলায় শেখ নাসের তাকে একসঙ্গে নিয়ে খেতেন।
১৯৭১ সালের ৬ই আগষ্ট আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ৯ নং সেক্টর পরিদর্শন করেন এবং শেখ আবু নাসেরকে সেখান থেকে টাকি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের জন্য নিয়ে যান। টাকি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন শেখ আবু নাসের। প্রশিক্ষণ শেষে শেখ আবু নাসের ও পান্না বিশ্বাসকে ভারতীয় সেনা বাহিনীর ক্যাপ্টেন শেপা বাগুন্ডিয়া ক্যাম্পে নিয়ে আসেন। সেখান থেকে বাগেরহাটের সাহসি মুক্তিযোদ্ধা সামশু মল্লিক সহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চিতলমারী দিয়ে বাগেরহাটে প্রবেশ করেন তিনি। বাগেরহাটের মাধবকাঠি মাদ্রাসায় পাক সেনাদের সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। রাতে শুরু হওয়া যুদ্ধ চলে দুপুর পর্যন্ত। এ সময় আশপাশের লোকজন তাদেরকে শুকনা খাবার দিয়ে যায়। যুদ্ধে পাক বাহিনী পরাজিত হয় এবং শেষে পালিয়ে যায়। ভারতের বাগুন্ডিয়া ক্যাম্প থেকেই মূলত টুঙ্গিপাড়ার অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়েছিলেন। টুঙ্গিপাড়ায় বড় ধরনের কোন যুদ্ধ হয়নি। কারণ সে সময় এ অঞ্চল ছিল দুর্গম। এ কারণে হানাদার বাহিনী নদী দিয়ে গানবোট নিয়ে টহল দিত। এ অঞ্চলের যোদ্ধারা তাই দেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেছে।
আর একটি সূত্র থেকে জানা যায়, শেখ আবু নাসের ১৯৭১ সালে সাতক্ষীরা জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে দেখা করতে যান। শেখ নাসেরকে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দেবার দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে একজন ছিলেন কাশেম মোল্লা। এই ক্ষুদ্র ঘটনা থেকে বোঝা যায় শেখ নাসের তার দায়িত্বের প্রতি কতটা অবিচল ছিলেন।
সহজ সরল অবয়বের এই মানুষটির ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে বিদেশী গণমাধ্যমে একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করেছিলেন, তা পরবর্তী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল।
তিনি সচিত্র সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এখন হাজার হাজার ছেলে আসছে, তারা ট্রেনিং নিচ্ছে। হাজার হাজার মেয়েরা ট্রেনিং নিচ্ছে। আনসার, পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট সবাই এখন তারা নিজেরা ইচ্ছে করে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করছে। মুক্তিবাহিনীর জন্য যদি সাহায্য পাই পৃথিবীর সমস্ত দেশের থেকে যেমন- প্লেন, নেভাল এবং হেভী আর্মস অচিরেই বাংলাদেশ পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে সরকার বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ নেবে। বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট যে সমস্ত জায়গা মুক্তিবাহিনী দখল করে নিয়েছে সে সমস্ত প্রায় ৩০/৪০ মাইল পর্যন্ত ভিতরে দখল করে নিয়েছে আমাদের মুক্তিবাহিনী। সেখানে বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট একজন ডিষ্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট, এসপি, এসডিও, থানা অফিসার, পোষ্ট অফিস সব সে দিয়েছে সেখানে এবং তারা সেখানে এডমিনিষ্ট্রেশন চালাচ্ছেন এবং তার দ্বারা সেখানে সব দেখাশোনা সমস্ত রকমের মুক্তিবাহিনী সাহায্য করছে যাতে পাকিস্তান আর্মি আবার এসে এটাক না করতে পারে। সেজন্য সেখানে মুক্তিবাহিনীরা দেখছে এবং গভর্নমেন্টও সেভাবে চালাচ্ছে এবং সেখানে আমাদের ষ্টাম্প চলছে। সেখানে আমাদের হসপিটাল আছে এবং সমস্ত অফিসার আমাদের বাংলাদেশের গভর্নমেন্ট থেকে সেখানে এপয়েন্টমেন্ট দিয়েছে (শেখ আবু নাসেরর সচিত্র সাক্ষাৎকার,বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ওয়েবসাইট) ।
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার বয়ান থেকেই বুঝে নিতে খুব বেশী অসুবিধা হয়না যে, তার শরীরে বইছিল দেশকে স্বাধীন করার উত্তেজনা এবং আগ্রহ। যিনি বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ভাই। কতটা পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হলে এমনটি হতে পারে। আর এ ধরণের ভালোবাসার বন্ধনের কারণে টুঙ্গীপাড়ার খোকা একদিন বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেন।
অপর আর এক অনুচ্ছেদে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ আমি নিজেও খুব চিন্তাযুক্ত ছিলাম। কারণ আমরা ছয় ভাইবোনের মধ্যে পাঁচজনই তখন কলকাতা ও শ্রীরামপুরে। আমার মেজোবোনের জন্য চিন্তা নাই। কারণ সে বেনিয়া পুকুরে আছে। সেখানে এক বোন বেড়াতে এসেছে। এক বোন শ্রীরামপুরে ছিল। একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের ম্যাট্রিকে পড়ে। একেবারে ছেলেমানুষ। একবার মেজো জনের বাড়ী, একবার ছোটবোনের বাড়ী এবং মাঝে মাঝে আমার কাছে বেড়িয়ে বেড়ায়। কারো কথা বেশী শোনেনা। খুবই দুষ্টু ছিল ছোটবেলায়। নিশ্চয়ই গড়ের মাঠে এসেছিল। আমার কাছে ফিরে আসে নাই। বেঁচে আছে কি না কে জানে। শ্রীরামপুরের অবস্থা খুবই খারাপ। যে পাড়ায় আমার বোন থাকে, সে পাড়ায় মাত্র দুইটি ফ্যামিলি মুসলমান।’
এখানেও বুঝা যায়, বঙ্গবন্ধু তার ছোট ভাইকে কতটা স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন।
১৯৪৬ সালের ১৬ আগষ্ট সকালে থেকে কলকাতায় হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। ইতিহাসে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ বা ‘কৃষ্ণ ষোল’ নামে পরিচিত। কলকাতায় সেদিন গড়ের মাঠে যে সমাবেশ হয়েছিল সেই সমাবেশের কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু। মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের কলকাতা বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে সবাই গড়ের মাঠে সমবেত হয়েছিল ।
বঙ্গবন্ধু ২৬ জুলাই, ১৯৬৬ সালে তার গ্রন্থে লিখেছেন,‘আমার ছোট ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা কেমন, সংসার কেমন চলছে। অর্থাভাবে কি না?' এসব প্রশ্নও তাড়িয়ে বেড়াত বড় ভাইকে।
১৯৭৫ সালের ১৪ আগষ্ট ঢাকা থেকে যশোর হয়ে খুলনা যাবার কথা ছিল শেখ নাসেরের। কিন্তু পরদিন ১৫ আগস্ট সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠান থাকায় বঙ্গবন্ধু খবর পাঠিয়ে তাকে ধানমন্ডি -৩২ নম্বরের বাড়ীতে ফেরত আসতে বলেন এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ফিরে আসেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের গুলিতে সকলের সাথে তিনিও প্রাণ হারান।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বাসার কাজের সহকারী আবব্দুর রহমান রমা (বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ২ নং সাক্ষী) বলেন, 'গোলাগুলির এক পর্যায়ে আমি বঙ্গমাতার বাথরুমে আশ্রয় গ্রহণ করি। সেখানে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, বঙ্গমাতা এবং বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসেরকে দেখতে পাই। শেখ নাসের ঐ বাথরুমে আসার আগে তার হাতে গুলি লাগে এবং তাঁর হাত থেকে রক্ত ঝরছিলো। বেগম মুজিব তাঁর শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে শেখ নাসেরের গুলিবিদ্ধ জায়গাটিকে বেধেঁ দেন। এরপর আর্মিরা দরজা ধাক্কানোর এক পর্যায়ে দরজা খোলার পর শেখ নাসের, শেখ রাসেল ও আমাকে নিচতলায় নিয়ে যান। সেখানে শেখ নাসেরকে উদ্দেশ্য করে জানতে চায়, সে কে? তিনি শেখ নাসের বলে পরিচয় দিলে তাকে নিচতলার বাথরুমে নিয়ে যায়। একটু পরেই ঐ বাথরুমে গুলির শব্দ এবং ‘মাগো’ বলে আর্তচিৎকার শুনতে পাই।"
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ১ নং সাক্ষী মুহিতুল ইসলাম বলেন,"উপর হতে শেখ নাসেরকে এনে লাইনে দাঁড় করায়। শেখ নাসেরের হাতে তখন গুলির রক্তাক্ত জখম ছিল। শেখ নাসের বললেন,'স্যার, আমি তো রাজনীতি করি না - কোনোরকম ব্যবসা করে খাই।' তখন পাহারারত একজন আর্মি বলল,'শেখ মুজিব ইজ বেটার দেন শেখ নাসের।' যে অস্ত্রধারী আর্মি শেখ নাসেরকে নামিয়ে এনেছিল সে বলল,'ঠিক আছে, আপনাকে কিছু বলব না- আপনি ঐ কক্ষে গিয়ে বসুন।' এই বলে অফিসকক্ষ সংলগ্ন বাথরুমে নিয়ে শেখ নাসেরকে গুলি করে। শেখ নাসের 'পানি, পানি' বলে চিৎকার করতে থাকলে পাহারারত আর্মিদের একজন অন্য একজনকে বলল,'যা পানি দিয়ে আয়।' সে গিয়ে পানির পরিবর্তে আবারও শেখ নাসেরকে গুলি করে।
এভাবেই শেষ হয় শেখ নাসেরের জীবন। রেখে যান অন্তসত্ত্বা স্ত্রী এবং সাত সন্তান।
বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য, বাঙালির আজন্ম লালিত একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু টানা প্রায় সাড়ে ৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারে নির্মম নির্যাতন সহ্য করেছেন। দু দু’বার ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছেন, জীবন-যৌবনের প্রায় ১৩ বছর কারা অভ্যন্তরে কাটিয়েছেন। তাকে কোন বাঙালী হত্যা করতে পারে এমনটি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না বেগম রাজিয়া নাসের। বঙ্গবন্ধু এবং শেখ আবু নাসের এর ভাগ্নে খুলনার বয়রায় বসবাসকারী ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ও পরবর্তীতে ক্রন্দনরত অবস্থায় দৌড়াতে দৌড়াতে এসে ছোট মামী বেগম রাজিয়া নাসেরকে জানান ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের বাসায় ঘটে যাওয়া বাঙালির জন্য সবচেয়ে বেদনাদায়ক খবরটি। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে বেগম রাজিয়া নাসেরের। স্বামী হারানোর শোক, আতঙ্ক আর চরম নিরাপত্তাহীনতায় অস্থির সময় কাটতে থাকা রাজিয়া নাসের শুনতে পান ১৬ ই আগস্ট সকালে বঙ্গবন্ধুর লাশ টুঙ্গিপাড়ায় আনা হচ্ছে দাফনের জন্য। ভেবেছিলেন তার স্বামী শেখ আবু নাসেরের লাশও হয়ত আনা হবে।
স্বামীর লাশ একনজর দেখা এবং দাফনে অংশগ্রহণ করার জন্য ৭ মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা বেগম রাজিয়া নাসের নাবালক সন্তানদের নিয়ে লঞ্চে করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গিয়েছিলেন টুঙ্গিপাড়ায়। কিন্তু খুনীচক্রের বাধায় বেগম রাজিয়া নাসেরের লঞ্চ ঘাটে ভিড়তে পারেনি। ক্রন্দনরত অবস্থায় চোখের পানি ফেলতে ফেলতে তাকে আবার ফিরে আসতে হয় খুলনার শেরে বাংলা রোডস্থ স্বামীর বাসায়। কিন্তু স্বামী শেখ আবু নাসেরের বাসায়ও ঢুকতে পারেন নি। কারণ ততক্ষণে বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী গঠিত খুনীদের পৃষ্ঠপোষক অবৈধ সরকার শেখ আবু নাসেরের বাড়ি সিলগালা করে দিয়েছে। ফলে চলে যান বাবা হেরাজ বিশ্বাসের বাড়িতে। কিন্তু সেখানেও বেশিদিন থাকতে না পেরে এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে চলে যান পাবনায় দাদার বাড়িতে। সেখানেও সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হন।
শেখ আবু নাসেরের বড় ছেলে বর্তমান বাগেরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য জননেতা শেখ হেলাল উদ্দীন তখন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের দশম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র। খুনীচক্রের একটি দল সেখানে গিয়ে শেখ হেলালকেও উঠিয়ে এনে হত্যা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপ্যালের দৃঢ়তায় সেদিন শেখ হেলাল প্রাণে বেঁচে যান। এভাবে একের পর এক বৈরী পরিবেশ মোকাবিলা করতে হয়েছে শেখ আবু নাসেরের পরিবারকে। সরকারের নির্দেশে শেখ আবু নাসেরের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয় এবং সকল ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে নিদারুণ অর্থকষ্টও একসময় ভোগ করতে হয়েছে এই পরিবারকে। কিন্তু জীবন সংগ্রামী বেগম রাজিয়া নাসের একের পর এক সকল বাঁধা আর প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করেছেন ধৈর্য আর সাহসের সম্মিলন ঘটিয়ে।
নড়াইল সদর উপজেলা আওয়ামীলীগের ৬০’র দশকের সাধারণ সম্পাদক সাত্তার মোল্লা ওরফে বেদুইন সাত্তার ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত কাছের মানুষ। বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে তার আসা যাওয়া ছিল নিয়মিত।
বঙ্গবন্ধু পরিবার সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন-“শেখ আবু নাসের ছিলেন অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ। তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে খাওয়াতেন। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হওয়া সত্ত্বেও তার চলাফেরা ও জীবনযাপন ছিল অতি সাধারণ।”
শেখ আবু নাসেরকে হারিয়ে তার স্ত্রী এবং সন্তানেরা মানবেতর জীবন যাপন করেন। প্রতি পদে পদে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হন। নানা শ্বাপদসংকুল পথ পেরিয়ে সন্তানেরা বড় হন এবং নিজ আলোয় নিজেদের আলেকিত করেন এবং পিতার আদর্শে নিজেদের নিয়োজিত করছেন।
শেখ ওয়াহিদুজ্জামান আল ওয়াহিদ সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ’ গ্রন্থে শেখ নাসেরের জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ হেলাল উদ্দিন ‘বঙ্গবন্ধু ও আমার পিতা: একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন’ শিরোনামে ১৫৯-১৬২ পৃষ্ঠা জুড়ে লেখার এক পর্যায়ে লিখেন,‘আমার পিতা শেখ আবু নাসের শিপিং বিজনেস অর্থাৎ নৌ পরিবহন বাণিজ্য শুরু করেন। সপরিবারে খুলনাতে বসবাসের ফলে এখানেই আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে কয়েকজন জন্মগ্রহণ করেন। ’ অপর আর এক অনুচ্ছেদে লিখেন,‘আমার পিতা আমাকে যতখানি স্নেহ-মমতা দিয়েছেন, আমার চাচা বঙ্গবন্ধুও আমাকে ততখানি খুব স্নহ করতেন, ভালোবাসতেন।’ এই এতটুকু তথ্য থেকে একজন সন্তানের পিতাকে নিয়ে স্মৃতির দুয়ারে ফিরে যাওয়া এবং পারিবারিক মেলবন্ধনের অসাধারণ উদাহরণ।
অপরদিকে, শেখ নাসেরের বোনের মেয়ে আব্দুর বর সেরনিয়াবাতের কন্যা হুরুন্নেসা মঞ্জুর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, শেখ নাসের তাঁর বোনের মেয়েদের ভীষণ ভালোবাসতেন এবং বোনের মেয়েদের হাতের নানা রকমের রান্না খেতে পছন্দ করতেন এবং তিনি একজন ভীষণ মিশুক মানুষ ছিলেন।
শেখ আবু নাসেরের বড় পরিচয় তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকার একজন গর্বিত অহংকারের অংশীদার তিনি। যাদের সংগ্রামে আজ বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাড়িঁয়েছে।
ঘাতকের নির্মম বুলেটে বিদ্ধ হয়ে শাহাদাৎ বরণ করেছেন এই পরিবারের অভিভাবক স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং পঙ্গু বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের সহ ১৬ জন! স্বজন হারানো সদস্যরা দীর্ঘ ২১ বছর এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের বিচার চাওয়ার অধিকারটুকু পর্যন্ত পায়নি! আত্মস্বীকৃত খুনীদের রক্ষায় ‘ইনডেমনিটি আইন’ করেছিল তৎকালীন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী খন্দকার মোশতাক এবং মেজর জেনারেল জিয়ার সরকার।
এতটা নির্মমতা, পাশবিকতা, নিষ্ঠুরতা এবং অমানবিকতার শিকার হয়েও মানবিকতার জয়গান গেয়ে চলেছে পরিবারটি। খুলনার সাধারণ মানুষের ভাষ্যমতে, শেখ আবু নাসের ছিলেন একজন নির্লোভ ও নিরহংকার মানুষ। তিনি কখনও মানুষের সাথে ক্ষমতার প্রভাব দেখাননি। তিনি অতি সাধারণভাবে জীবনযাপন করতেন। শেখ আবু নাসের একজন সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে নানা ভাবে নেপথ্যে থেকে সহযোগীতা করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বড় ভাই বঙ্গবন্ধুর মতো দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি তাঁর ছিল অগাধ ভালোবাসা। যে কারণে তিনি জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সে কারণেই খুলনার আবাল বৃদ্ধ বণিতা তাঁকে বিশ্বাস করতেন ও ভালবাসতেন।
শেখ আবু নাসেরের সন্তানেরা আজ প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী। খুলনা তথা দক্ষিণ জনপদের আওয়ামী রাজনীতির পতাকা তাঁদের হাতে। আর এটা সম্ভব হয়েছে সাধারণ মানুষের ভালবাসার কারণে। শেখ নাসেরের বড় পুত্র শেখ হেলাল উদ্দিন বাগেরহাট ১ আসনের বার বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য। মেজ পুত্র সেখ সালাহ উদ্দিন জুয়েল খুলনা ২ আসনের সংসদ সদস্য। সেজ পুত্র শেখ সোহেল উদ্দিন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক। শেখ জামাল উদ্দিন রুবেল ও শেখ বেলাল উদ্দিন বাবু ব্যবসার সাথে জড়িত। দৌহিত্র শেখ সারহান নাসের তন্ময় বাগেরহাট ২ আসনের সংসদ সদস্য।
ইতিহাস এগিয়ে যায় তার নিজস্ব গতিতে। বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসেরের রণাঙ্গনে সাহসী ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় চির অক্ষয় হয়ে থাকবে। বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসেরের প্রতি রইল আমাদের অতল শ্রদ্ধা।
লেখক: এ্যাড. শেখ নবীরুজ্জামান বাবু
তথ্যসূত্র: শেখ মুজিবুর রহমান- অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান- কারাগারের রোজনামচা, নাছিমা বেগম- রেণু থেকে বঙ্গমাতা, নূহ-উল আলম লেনিন, রাজনীতিতে হাতেখড়ি ও কলকাতায় শেখ মুজিব, শেখ ওয়াহিদুজ্জামান আল ওয়াহিদ (সম্পাদিত), বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বড় কন্যা হুরুন্নেসা মঞ্জুর সাক্ষাৎকার।
এমএম//