ঢাকা, শুক্রবার   ০৮ নভেম্বর ২০২৪

শুভ জন্মদিন

বাঙালির অমূল্য ইতিহাসের ধারক কবি বেলাল মোহাম্মদ 

কাজী ইফতেখারুল আলম তারেক

প্রকাশিত : ২৩:০৫, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও শব্দসৈনিক, পুঁথি পাঠক, ঋষিতুল্য মানব চরিত্রের অধিকারী প্রয়াত কবি বেলাল মোহাম্মদের জন্মদিন আজ। তিনি ১৯৩৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার মুছাপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে  জন্মগ্রহণ করেন। জন্মদিন উপলক্ষে যখন কিছু লিখছি, ঠিক সে মুহূর্তে আপনি এই সবুজ গ্রহ থেকে যোজন যোজন দূরে রয়েছেন।

বাঙালির ক্রান্তিকালে, ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনের সময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ  মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল সে লড়াইয়ের অগ্রণী কণ্ঠ সেনাপতি ছিলেন তিনি। ঠিক সময়ে তিনি প্রেরণার বাতিঘর হিসেবে জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য দিতে, মুক্তিকামী জনতাকে প্রেরণা দেয়ার লক্ষ্যে "স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র" প্রতিষ্ঠা করেন।

বাঙালি জাতির ক্রান্তিলগ্নে যে অবিস্মরণীয় কাজটি করেছেন তা বিশাল পরিসরে আলোচনার দাবি রাখে। তাঁর সাহসী ও দূরদর্শী  সিদ্ধান্তের ফলে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সুরক্ষিত হয়েছে। তিনি একাধারে  মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক, সাংবাদিক ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মহান সাক্ষী।তিনি নিজেই একটি ইতিহাস ও ইতিহাসের উপাদান। শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের জন্যে তিনি নিরন্তর লিখেছেন বহু গ্রন্থাবলি। 

যুদ্ধকালীন সময়ে জীবনবাজি রেখে তিনি বাঙালির অমূল্য ইতিহাসের ধারক ও বাহকের ভূমিকা পালন করে গেছেন। বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে  হত্যার পরে তাঁকে দিয়ে মিথ্যা ইতিহাস লেখাতে চেয়েছে। জীবন বাঁচাতে তিনি নির্বাসনে ছিলেন কিন্তু অপশক্তির সঙ্গে আপোষ করেননি। তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে কাজ করেছেন,তাই সত্যে অবিচল থেকে জাতিকে বিতর্কের কলংক থেকে বাঁচিয়েছেন।

তিনি একাধারে কবি, পুঁথিপাঠক ও সুসাহিত্যিক ছিলেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭৬টি।মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসমান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১০ সালে কবিকে  স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। পুরস্কারটি তিনি বাংলাদেশ বেতারকে দান করে গেছেন। এমনকি প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে "মুজফ্ফর - লালমোহন ওয়ার্কশপ" করে গেছেন। দেরীতে হলেও তাঁর অবদানের প্রতি সুবিচার করা হয়েছে।

 চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য তাঁর দেহটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে গেছেন। তিনি আমার অন্তর মানস গড়ে দিয়েছিলেন। কবির মোহময় সান্নিধ্যে এসে তাঁর উন্নত জীবনবোধ,মানবতাবোধ সম্পর্কে  সুগভীর ধারণা পেয়েছি।মৃত্যু শয্যা অবধি বেলাল ভাইয়ের পাশে থেকেছি। এখনো তাঁর স্মৃতি, ছবি ও কর্ম, দেশ মাতৃকার প্রতি তাঁর অবদানকে স্মরণ করি।

কবি বেলাল মোহাম্মদ সম্পর্কে বিশিষ্টজনরা  ব্যক্তিগত মতামত ব্যক্ত করেছেন: লেখক, সাংবাদিক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মী কামাল লোহানী বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র  এক অনন্য ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে যেটি ছিলো বাঙালির একমাত্র আশ্রয় স্থল। এজন্য মুক্তিযুদ্ধে স্বপক্ষীয় প্রত্যেক মানুষ তাঁকে আজীবন স্মৃতিতে ধারণ করবে।

বিশিষ্ট অভিনেতা ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মী সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, বেলাল মোহাম্মদ যা বিশ্বাস করতেন তার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতার ঘোষণা পাল্টে দেওয়ার জন্য তাঁকে যেমন প্রলোভন দেখানো হয়েছিল, তেমনি চাপও প্রয়োগ করা হয়েছিল তার উপর। তিনি এতটাই দৃঢ়চেতা মানুষ ছিলেন যে, কোন প্রলোভন বা চাপ তাকে দমাতে পারেনি। অবশ্য এ জন্য তাকে বহু বছর বিদেশে থাকতে হয়েছে।

এছাড়াও প্রমুখ  বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোন শক্তিকে এ দেশে কখনো মাথাচারা দিয়ে উঠতে না দিলেই তাঁর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জানানো হবে এবং তাঁর বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে।

বেলাল মোহাম্মদ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এমন একটি মূল্যবান ব্যক্তিত্ব, যাঁকে বিশ্লেষণ করলে ত্যাগ আর মানব প্রেমের পরিণত সংজ্ঞা খুঁজে পাওয়া যাবে।মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপর প্রতিক্রিয়াশীল জনগোষ্ঠী যখনি উঠে পরে লেগেছে ঠিক তখনি জাতির ক্রান্তিকালে তিনি কলম ধরে জাতির সম্মুখে যথার্থ ইতিহাস তুলে ধরে সদা পাহারা দিয়েছেন। সত্য বলার অপরাধে তার একমাত্র সন্তানকে হারাতে হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই অনন্য মানুষটির সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছিলো আমার। জাতির এই বীরকন্ঠ সেনাপতিকে নিজ বাসভূম সন্দ্বীপে সম্মান জানাতে ও সন্দ্বীপের তরুণ প্রজন্মের সামনে  মুক্তিযুদ্ধের এই জীবন্ত কিংবদন্তী কবি বেলাল মোহাম্মদকে তুলে ধরতে সন্দ্বীপ ফ্রেন্ডস সার্কেল এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে  ২০১০ সালের ২০ নভেম্বর সন্দ্বীপ পাবলিক হাই স্কুলের অডিটোরিয়ামে নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে  "ফ্রেন্ডস সার্কেল অ্যাওয়ার্ড -২০১০ "আজীবন সম্মাননা  পুরস্কার প্রদান করা হয়। সংবর্ধনার জবাবে তিনি আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেছিলেন," আমি তরুণদের দলে যোগ দিলাম, আমি আপনাদেরই সন্তান। আপনাদের পাশে থাকব সব সময়।" তিনি কথা রেখেছেন, মৃত্যু অবধি আমাদেরকে ভালোবাসা দিয়ে, উৎসাহ- অনুপ্রেরণা দিয়ে সংগঠনটির পাশে থেকেছেন। এরপর এই সংগঠনটি দিনে দিনে পত্র-পল্লবে বিকশিত হয়েছে।

এছাড়া তিনি আমার সম্পাদিত 'উত্তর ফাল্গুনী' সাহিত্য ম্যাগাজিনের মোড়ক উন্মোচন করেন। সেদিনের সংবর্ধনায় তিনি বলেছিলেন- "স্বাধীনতার ঘোষণার জীবন্ত সাক্ষী আমি"। আপনাকে নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি মনের গহীনে উঁকি দিচ্ছে। আপনি বেঁচে থাকবেন আজীবন আমাদের মনমন্দিরে । একজন বেলাল মোহাম্মদ আমার কাছে আলোর দিশারি এবং একই সাথে ভালোবাসার মানুষ । আপনার কাছ থেকে অনেক কিছুই শিখেছি। কি করে মানুষকে ভালবাসতে হয়,ক্ষমা করতে হয়।

সুমহান মুক্তিযুদ্ধের  ইতিহাসের সাক্ষী ২০১৩ সালের এই দিনে রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভোর ৪টা ১০ মিনিটে  চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। আজও বেলাল ভাইকে মনে পরে দেশের যেকোনো রাজনৈতিক কিংবা মানবিক সংকটে। কারণ মানবিক কবির লেখা ও জীবন দর্শন আজকের বাংলাদেশে অত্যন্ত বিরল। আপনি আমাদের বলিষ্ঠতম বন্ধু হয়ে যেভাবে ভালোবাসতেন তার প্রতিদান সামান্য লেখনী কিংবা স্মৃতিচারণে সম্ভব নয়। প্রসঙ্গত বলতে হয়, আপনি আমার অন্তর মানসে ভালোবাসার দ্বীপ জ্বেলে গেছেন। আপনার কাছে আমি চিরঋণী।আপনার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন আপনাকে জান্নাতবাসি করুন। আমিন।। 

লেখক-সাংবাদিক।।


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি