আমার মা
প্রকাশিত : ১৪:৫৮, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮
২০০৬-এর ২৫ ডিসেম্বর সবার মায়া ত্যাগ করে তিনি এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমার বাবা মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭০-এর ২৫ এপ্রিল। সেদিন অর্থাৎ ২৫ এপ্রিল জনসভা ছিল চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। সেখানে আমার বক্তৃতা শেষে এমএ আজিজ ভাই বললেন, আমি যেন অনতিবিলম্বে ভোলা চলে যাই। ২৬ এপ্রিল সকালবেলা গ্রামের বাড়ি পৌঁছাই। ততক্ষণে বাবার দাফন হয়ে গেছে।
যখন আমার বয়স মাত্র ১৩, তখন আত্মীয়-স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীর বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করতে হয়েছে। কষ্ট হলেও মা আমাকে লেখাপড়ায় নিয়মিত উৎসাহ জোগাতেন। মা আমাকে আদর করে `মনু` বলে ডাকতেন। সবসময় বলতেন, `মনু, মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করো।` মায়ের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম। তার ফল পেয়েছি পরীক্ষায় ভালো করে। বার্ষিক পরীক্ষায় হয় প্রথম, নয় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করি। জীবনের প্রথম হোস্টেল জীবন। মন পড়ে থাকত মায়ের কাছে। অপেক্ষায় থাকতাম, কখন মায়ের কাছে যাব। তখনকার ভোলাতে বিদ্যুৎ ছিল না। বৈদ্যুতিক বাতি, পাখা এর কিছুই ছিল না। হারিকেনের স্বল্প আলোয় লেখাপড়ার কাজ চালিয়েছি।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জাতীয় চার নেতাসহ আমরা ছিলাম গৃহবন্দি। ১৫ আগস্টের দু`দিন পর ১৮ আগস্ট আমার বাসভবনে এসে খুনিদের অন্যতম মেজর শাহরিয়ার (বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ফাঁসি কার্যকর হয়েছে) এবং ক্যাপ্টেন মাজেদ (পলাতক) বল প্রয়োগে আমাকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে আমার ওপর অকথ্য নির্যাতন করা হয়। আমাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় মা বেহুঁশ হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। `৭৫-এর পর চরম দুঃসময়। আমি তখন কারাগারে। দেশজুড়ে কারফিউ, হত্যা, গুম, গ্রেফতার আর ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা। আমার স্ত্রীকে কেউ বাড়ি ভাড়া দেয়নি। তোফায়েল আহমেদের স্ত্রীকে বাড়ি ভাড়া দিলে আর্মি ধরে নিয়ে যাবে।
আমার বড় ভাই ১৯৭৫-এর ১১ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। বড় ভাই যখন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে, মা তখন অসুস্থ। আমাকে বলেছিলেন, মাকে দেখতে চাইলে তাড়াতাড়ি চলে এসো। আমি গিয়েছিলাম। মা বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু বড় ভাই মায়ের আগেই মৃত্যুবরণ করেন। বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর একটি ছেলের জন্ম হয়। তার নাম `মইনুল হোসেন বিপ্লব`। শৈশব থেকে আমি তাকে পিতৃস্নেহে বড় করেছি। সে এখন আমারই ছেলে। আমার মেয়ে `ডা. তাসলিমা আহমেদ জামান মুন্নী` যখন ছোট, আমার মায়ের সঙ্গে ঘুমাত। এখনও মায়ের স্মৃতি আমার মেয়েটি ধরে রেখেছে। মা যখন চিকিৎসাধীন, আমার মেয়ে ও জামাতা উভয়েই আমার মায়ের যে সেবাযত্ন করেছে, তা অকল্পনীয়।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর আমি ৩৩ মাস কারাগারে বন্দি ছিলাম। জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর, ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আমাকে গ্রেফতার করে প্রথমে সেনানিবাসে, পরে সিলেট কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সিলেট কারাগারে গিয়ে মা আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। সেদিন ড. কামাল হোসেনের বাসভবন থেকে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আমাদের ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর `৮৪-এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে সাভার স্মৃতিসৌধে গ্রেফতার করা হয়। `৮৫তে আমাকে গ্রেফতার করে ১৫ দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রেখে পরে কুমিল্লা কারাগারে দীর্ঘদিন বন্দি করে রাখা হয়।
৮৭তে ভোলা থেকে গ্রেফতার করা হয়। আমি তখন সংসদ সদস্য। গ্রেফতার সংবাদে বিক্ষুব্ধ জনতা রাস্তায় নেমে এলে আমাকে বরিশালের কারাগারে একটি নির্জন কক্ষে বন্দি করে রাখা হয়। `৯৬-এ নির্দলয়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করলে আমাকে গ্রেফতার করে রাজশাহী কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আবার ২০০২-এ সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা শেষে যখন ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করি, আমাকে গ্রেফতার করে কাশিমপুর কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কাশিমপুর থেকে যখন কুষ্টিয়া কারাগারে পাঠায়, তখন গোয়ালন্দ ফেরিঘাটে একটি পতাকাবাহী গাড়ি দেখি। যে গাড়িটি ছিল জামায়াত নেতা ও খালেদা জিয়া সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদের।
তার গাড়িতে পতাকা আর আমার হাতে ছিল হাতকড়া। স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বমোট সাতবার আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং প্রত্যেকটি জায়গায় আমার বৃদ্ধ মা ছেলেকে দেখার জন্য ছুটে গিয়েছেন। সে কী কষ্ট! জেলগেটে যখন মা আমার সঙ্গে দেখা করতেন সর্বক্ষণ আমার মাথাটা মায়ের বুকে থাকত। তারপর যখন তিনি আমাকে রেখে বিদায় নিতেন, তখন তার দুই চোখে অশ্রুর নদী। দুই ছেলে মৃত্যুবরণ করেছে, এক ছেলে কারান্তরালে। কী নিঃস্ব-রিক্ত আমার মা!
সেই কঠিন দিনগুলোর কথা মনের পাতায় ভেসে ওঠে। মায়ের স্মৃতিকে আমি ধরে রাখতে চাই। বাবা-মায়ের নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মায়ের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। জীবনে স্বপ্ন ছিল বৃদ্ধাশ্রম করার। যেখানে আমার মায়ের মতো মায়েদের সেবা-শুশ্রূষা করতে পারব। ২০০২-এ মায়ের বয়স তখন ৮৮ বছর। অসুস্থ শরীরেও তিনি বৃদ্ধ বয়সে আমাকে দেখতে কুষ্টিয়া কারাগারে ছুটে গিয়েছেন। একনজর মায়ের মুখখানি দেখে মনে অনাবিল শান্তি অনুভব করেছি।
মা ছিলেন ধর্মপরায়ণ এমন একজন মানুষ, যিনি সর্বদাই অপরের কল্যাণের কথা ভাবতেন। গ্রামের বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন-প্রতিবেশী যে কারও দুঃখে তিনি ছুটে যেতেন। সাধ্যমতো সাহায্য করতেন। আমাকে সবসময় বলতেন,`তুমি একা বড় হতে পার না। সবাইকে সঙ্গে করেই তোমাকে এগিয়ে যেতে হবে।` মা সুখে-দুঃখে আমায় ছায়া দিতেন বটবৃক্ষের মতো। প্রতিদিন মায়ের আদর নিয়ে তবেই দিনের কাজ শুরু করতাম। সকালে ঘুম ভাঙার পর মায়ের স্নেহের আলিঙ্গন, আদর ছিল নিত্যদিনের পাথেয়।
আমি না ফেরা পর্যন্ত মা জানালার কাছে হাতে তসবিহ নিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে থাকতেন কখন ফিরি। আমার বন্ধু-বান্ধব-স্বজন প্রত্যেককেই মা অন্তর থেকে ভালোবাসতেন, আদর করতেন। মা আমার জীবনে অনুপ্রেরণার নিরন্তর উৎস হয়ে সদা বিরাজমান। মা যখন অসুস্থ, তখন প্রত্যেকেই তার সেবা-শুশ্রূষা করেছেন। পরম শ্রদ্ধাভাজন `জনাব জয়নাল আবেদীন শিকদার` যাকে আমি চাচা বলে সম্বোধন করি। তিনিও আমাকে পুত্রবৎ স্নেহ করেন।
তারই গুলশানস্থ শিকদার হাসপাতালে মায়ের শেষ জীবনের চিকিৎসাদি চলে। মৃত্যুর দু`দিন আগে আমি যখন নিজ হাতে মাকে খাওয়াচ্ছিলাম, তখন তিনি ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় মা আমাকে বলেছিলেন, `তুমি কি আমাকে মরতে দেবে না?` আমি উত্তরে বলেছিলাম, মা আপনি যদি মৃত্যুবরণ করেন, তখন আমাকে দোয়া করবে কে? মা আমাকে বলেছিলেন, `তোমাকে আমি আল্লাহর কাছে রেখে গেলাম। আল্লাহই তোমাকে হেফাজত করবে।` এটাই ছিল মায়ের সঙ্গে আমার শেষ কথা। মায়ের মৃত্যুদিনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বনানীর বাড়িতে এসে মাকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর চেতনায় গড়ে উঠেছে আমার রাজনৈতিক জীবন। আর মায়ের মানবিক গুণাবলির প্রভাবে বিকশিত হয়েছে ব্যক্তিজীবন। `৭৩-এ ভোলার বাংলাবাজারে মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেছি একটি গার্লস হাই স্কুল, যার নাম `ফাতেমা খানম গার্লস হাই স্কুল`। আজ সেখানে ৬০ বিঘা জমির ওপর মায়ের নামে `ফাতেমা খানম ডিগ্রি কলেজ`,`ফাতেমা খানম হাসপাতাল`,`ফাতেমা খানম এতিমখানা`, `ফাতেমা খানম জামে মসজিদ`, `ফাতেমা খানম বৃদ্ধাশ্রম`সহ বিশাল এক কমপ্লেক্স।
এই কমপ্লেক্সেই গরিব-দুঃখী মানুষের চিকিৎসাসেবায় পিতামাতার নামে `আজহার আলী-ফাতেমা খানম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল` প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। মায়ের নামে স্থাপিত হতে যাচ্ছে `ফাতেমা খানম মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র`। এর লাগোয়া স্থানে নির্মিত হয়েছে অপূর্ব স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন `স্বাধীনতা জাদুঘর`; যা এ বছরের ১৭ জানুয়ারি মহামান্য রাষ্ট্রপতি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।
ভোলায় গ্রামের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে আমার পরম শ্রদ্ধেয় মা-বাবা যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত, সেখানে কবরফলকে হৃদয়ের শ্রদ্ধাঞ্জলি উৎকীর্ণ আছে এভাবে- `মা, বাবা চলে গেছেন অনেক আগে/চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন তোমারই পাশে/তুমিও চলে গেলে আমাদের/ সকলকে কাঁদিয়ে,/তবুও তোমরা আছো সর্বক্ষণ/আমাদের হৃদয় জুড়ে।/মা, প্রতি মুহূর্ত তোমাদের অভাব/অনুভব করি।` তোমার মনু (তোফায়েল)।
আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার